17/09/2021
ছবিটির ডান পাশের ভদ্রলোকের নাম কাজী হামিদুল হক। তাঁকে বলা হয় বাংলাদেশের অ্যাডভেঞ্চার গুরু।
বিখ্যাত বাংলা চ্যানেলের আবিষ্কারক, কীর্তিমান আণ্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার ও বরেণ্য স্কুবা ডাইভার কাজী হামিদুল হক।
সেই যে যৌবনে সাগর টেনেছিল কাজী হামিদুল হককে, সেই টান ছিল আমৃত্যু। দেশে ফেরার পর ছুটে যান সমুদ্রে। চষে বেড়িয়েছেন কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন এলাকার বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরের এই পথে নৌকায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তাঁর মাথায় খেলা করে সাঁতারে সাগর পাড়ি দেওয়ার একটা রুট। সঙ্গে ছিলেন কামাল আনোয়ার।
কামাল আনোয়ার বলেছিলেন, ‘টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে ভাটার সময় সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত সাঁতরে পার হওয়া যাবে, এটা হামিদ ভাই বের করলেন। কখন কোথায় স্রোত কোন দিকে যায়, তা-ও আমরা বের করে ফেলি বিভিন্ন রঙের বোতল ভাসিয়ে। এই পথে স্রোতের দুটি ধারা আছে, এর একটা যায় আরাকানের দিকে। হামিদ ভাই সঠিক রুটটা বের করে ফেলেন।’
নৌকা চালিয়ে সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার পরই সাঁতারের এই রুট বের করার দিকে মন দেন তিনি। ‘ওরা যেমন ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়, আমরাও এমন একটা সাঁতার চালু করতে পারি।’ বলতেন কাজী হামিদুল হক।
২০০৬ সালে প্রথম সাঁতারের আয়োজন করা হয়। সে দলে সাঁতারু হিসেবে ছিলেন লিপটন সরকার, ফজলুল কবির ও সালমান সাইদ। দলে বয়সে সবচেয়ে ছোট সালমান সাইদ। তিনি বলেছিলেন, ‘দলে আমিই ছিলাম অনভিজ্ঞ সাঁতারু। কিন্তু হামিদ ভাই মানসিকভাবে এত শক্তি জোগাতেন যে কোনো ভয়ই লাগেনি।’
২০০৬ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি এই দলটি শাহপরীর দ্বীপ থেকে বঙ্গোপসাগরে ১৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার সাঁতার কেটে পৌঁছায় সেন্ট মার্টিনে। তখনো সাঁতারের এ পথের নামকরণ হয়নি। পরে ঢাকায় কাজী হামিদুল হক এর নাম দেন বাংলা চ্যানেল।
২০০৪ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। বুড়িগঙ্গা নদী থেকে একটি নৌকা পাড়ি জমায় বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে। শুনলে অবাক লাগে কারন নৌকাটি দৈর্ঘ্যে ছিলো মাত্র ২১ ফুট আর প্রস্থে নয় ফুট। সেই নৌকায় ছিল না কোনো বাথরুম বা রান্নাঘর। স্টোভ জ্বালিয়ে রান্নার ব্যবস্থা। কাজী হামিদুল হকের নেতৃত্বে এই নৌকায় অভিযাত্রী ছিলেন ১৩ জন। সে যাত্রায় অংশ নেন বাংলাদেশের পর্বতারোহী মুসা ইব্রাহীম। তাঁর কাছ থেকে জানা গিয়েছিলো সেই যাত্রার ইতিবৃত্ত ।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জাহাজ ভাঙার জায়গা থেকে একটা লাইফ বোট (বড় জাহাজের সঙ্গে এগুলো বাঁধা থাকে) কিনে আনেন। এরপর ঢাকায় নিয়ে এসে সেটায় ইঞ্জিন লাগানো হয়। নৌকাকে নদী-সমুদ্রে চলাচলের উপযোগী করতে নানা কারিগরি ফলানো হয়। এসব কাজ নিজেই করেছিলেন হামিদুল হক।
রাতে বুড়িগঙ্গা থেকে নৌকা ছাড়ার কথা, কিন্তু যাত্রা শুরু হলো ভোরে। এই অভিযাত্রায় সে সময় অংশ নিয়েছিলেন হামিদুল হক, মুসা ইব্রাহীম, ইমরান, ফজলুল কবির, কামাল আনোয়ার, রফিক, রবিউল হুসাইন, একুশে টিভির দুই সাংবাদিক এবং আরও কয়েকজন। রুট চেনার কারণে সারেং আনা হয়েছিল সীতাকুণ্ড থেকে।
মুসা ইব্রাহীম বলেছিলেন, ‘ভোরে রওনা দিয়ে সেদিনই পৌঁছাই চাঁদপুরে। আমাদের হিসাব ছিল দুই দিনে সেন্ট মার্টিনে যাব। কিন্তু দেখা গেল, সন্দ্বীপ পর্যন্ত পৌঁছাতেই লেগে গেল পাঁচ-ছয় দিন। কারণ, নৌকার গতি ছিল খুব ধীর। সন্দ্বীপ থেকে পরের দিন যাচ্ছিলাম চট্টগ্রামের দিকে। কর্ণফুলীতে নৌকা যখন পৌঁছাল, তখন দেখি কর্ণফুলী চ্যানেল থেকে সব জাহাজ মিছিল করে গভীর সমুদ্রে যাচ্ছে। আমাদের নৌকায় জিপিএস, কম্পাস ছিল, কিন্তু রেডিও ছিল না। তাই আমরা কোনো খবরই পাচ্ছিলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখি সমুদ্র পুরো উত্তাল। ১৫ থেকে ২০ ফুট উঁচু একেকটা ঢেউ। হামিদ ভাই সবাইকে নৌকার পেছনে জড়ো হয়ে থাকতে বললেন। নিজেদের জান হাতে নিয়ে আমরা তা-ই করলাম।’
সমুদ্রের তাণ্ডব থামার পর কাজী হামিদুল হকের নৌকা কর্ণফুলী জেটিতে পৌঁছাল। তখন জানা গেল, সেই দিনটিতে ইন্দোনেশিয়ায় ভারত মহাসাগরে ঘটে প্রলয়ংকরী সুনামি।
চট্টগ্রামে গিয়ে সারেং তাঁর বাড়িতে ঘুরতে যান, কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। হামিদুল হক নিজে আবার সীতাকুণ্ডে গিয়ে আরেকজন সারেং নিয়ে আসেন। এরপর মহেশখালী হয়ে টেকনাফ, তারপর সেন্ট মার্টিনে পৌঁছায় হামিদুল হকের নৌকা। হামিদুল হক ও আরও কয়েকজন নৌকা চালিয়েই আবার ফিরে আসেন ঢাকা।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে নিউইয়র্কে এক প্রবীণ স্কুবা ডাইভারের (ডুবুরি) সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিলো কাজী হামিদুল হকের। তাঁর কাছেই হাতেখড়ি ডুবসাঁতারে। এরপর তাঁর আগ্রহ তৈরি হয় অতল জলের বিচিত্র-বর্ণিল জগতের প্রতি। এ সময়টাতেই জলের নিচে ছবি তোলার কৌশল শিখে ফেলেন। ডুব দেওয়া আর জলের নিচে ছবি তোলাই হয়ে ওঠে হামিদের পেশা। তিনি সাগরের ২০০ ফুট নিচ পর্যন্ত ডুব দেওয়ার জন্য লাইসেন্সধারী ছিলেন।
১৯৪৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আসামে জন্মগ্রহণ করা অ্যাডভেঞ্চার গুরু কাজী হামিদুল হক মারা ২০১৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী শেরপুর থেকে ঢাকা ফেরার পথে বাসে মারা যান।
আজ বাংলাদেশের অ্যাডভেঞ্চারের মহারথীর জন্মদিন। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই তাঁর প্রতি। 🙏💕
©Collcected