25/06/2024
"—সর্বশেষ প্রশ্ন। জ্ঞানীরা বিনয়ী হয়, এরকম একটি কথা এ দেশে খুব জনপ্রিয়। এ বিষয়ে অভিমত জানতে চাই।
—না, জ্ঞানীরা বিনয়ী হয়— এ কথার সাথে আমি একমত নই। জ্ঞানের সাথে বিনয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। বিনয়ী মাত্রই জ্ঞানী নয়। বরং বিনয় হলো অজ্ঞানতা ঢাকার একটি প্রাচীন কৌশল। এটি একপ্রকার অভিনয়, যা দিয়ে নিজের সম্পর্কে অন্যের কাছে সত্য গোপন করা হয়। নিজেকে ইচ্ছে করে ছোট করে দেখা, নিজের সক্ষমতা ও মূল্য সম্পর্কে সারাক্ষণ অস্বস্তিতে ভোগা, সর্বদা এক ধরনের সেলফ-ডিনাউন্সমেন্টের মধ্য দিয়ে যাওয়া, এটিই বিনয়। বিনয়ের ইংরেজিটা দেখুন, হিউমিলিটি, কী চমৎকার শব্দ! হিউমিলিটির মূল উৎস কিন্তু হিউমাস, যার অর্থ মাটি। নিজেকে মাটির মতো পদদলিত ভাবাটাই বিনয়। বাঙালি আদিকাল থেকেই পদদলিত জীবনযাপন করে আসছে। রাজা-বাদশাহদের পায়ের চাপে তার মানসিকতা চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। এমন কোনো শাসক বাঙালি পায় নি, যার সামনে গিয়ে সে বুক টানটান করে দাঁড়াতে পেরেছে। রাজা-বাদশাহদের দেখলেই মুখ কাঁচুমাচু করে সে মাটিতে মিশে যায়। তার কবিতা ও গান ভরে আছে ‘চরণ ধূলি’ নামক একটি শব্দে। পদধূলি তার খুব পছন্দ। ‘মাননীয়’ শব্দটি এখানে এতো বেশি ব্যবহৃত হয় যে, মনে হয়, কোনো অদৃশ্য রাখাল বুঝি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ষোলো কোটি ভেড়া। কান পাতলেই শোনা যায় স্যার স্যার স্যার স্যার স্যার। সে-হিসেবে আমি বিনয়ী নই। কারণ আমি অভিনেতা নই। কাউকে যাচাই বাছাই না করে সম্মান করি না। আমার মনে পড়ে না, সর্বশেষ কবে কাকে ‘মাননীয়’ ডেকেছি। কারও সাথে ভালো ব্যবহার করা, হাসিমুখে কথা বলা, এগুলো বিনয়ের অংশ নয়। এগুলো সাধারণ সৌজন্যতা। সাধারণ ভদ্রতা। কিন্তু আমরা এতোই অভদ্র, এতোই শিষ্টাচারবর্জিত যে, সাধারণ ভদ্র আচরণকেও এখানে বিনয় বলে ভুল হয়। যাকে চিনি না, জানি না, যার সাথে কোনোদিন ভালো-মন্দ আচরণই করি নি, সে-ও বলছে, আপনি তো বিনয়ী নন! বিনয়ের জন্ম স্লেইভ মোরালিটি থেকে। আমি কি স্লেইভ? কারও সাথে কি আমার দাস-প্রভু সম্পর্ক আছে? কারও সাথে কি আমি খারাপ ব্যবহার করেছি? চড়-থাপ্পড় মেরেছি? গালিগালাজ করেছি? মামলা ঠুকেছি? বাড়িতে বেড়াতে এলে কাউকে না খাইয়ে ছেড়েছি? তারপরও রিকশাওয়ালাকে কিল-ঘুষি মারা লোকজন এসে বলছে, আপনি তো বিনয়ী নন! কারণ আমি তাদের পীর বা প্রভুর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছি। দাসের সামনে যেমন প্রভুর সমালোচনা করা যায় না, মুরিদের সামনেও তেমনি পীরকে দুই কথা বলা যায় না। বললেই শুনতে হয়, জ্ঞানীরা বিনয়ী হয়। নির্বোধ বিনয়ীর চেয়ে চক্ষুষ্মান অহংকারী যে উত্তম, এ খবর বাঙালি রাখে না। মানুষের অহং থাকতে হয়। যে একেবারেই অহংশূন্য, সে শরীর বয়ে বেড়ায় মানুষের, কিন্তু আত্মা বয়ে বেড়ায় ইতরের। রাজা-বাদশাহদের সামনে যে আমাদের সাংবাদিকরা সারাক্ষণ আল্লাহ আল্লাহ করেন, ঘাইঘুই প্রশ্ন করেন, এর মূল কারণ তাদের অহং নেই। অহংহীন মানুষ ইঁদুরের সমান।
—তাহলে কি আপনি মানুষকে অহংকারী হতে বলছেন?
—না, তা বলছি না। অহং ও অহংকার এক জিনিস নয়। অহংকার একটি বদগুণ। অহং হলো স্বাভাবিক আত্মমর্যাদা, যেটি মানুষকে সৎ থাকতে সাহায্য করে। ক্ষমতা ও লোভের পায়ে লুটিয়ে পড়তে নিষেধ করে। সারাক্ষণ কারও প্রশংসা করা বিনয়ের লক্ষণ নয়। এটি সুবিধাবাদ ও চাটুকারিতার লক্ষণ। অহংকার একপ্রকার ভান, যা দিয়ে তিলের সমান ব্যক্তিরা তালের আকার ধারণ করেন। কেউ আত্মবিশ্বাসী, একা একা চলেন, কারও ধার ধারেন না, চুপচাপ থাকেন, কথা কম বলেন, এর মানে এই নয় যে তিনি অহংকারী। আবার কেউ বিশেষ কোনো দেবতার নামে ভক্তিতে গদগদ করছেন, সারাক্ষণ মানুষের মন জুগিয়ে চলছেন, মুখ কাঁচুমাচু করে ‘আমি বিনয়ী! আমি বিনয়ী!’ বলে চিৎকার করছেন, তার অর্থ এই নয় যে লোকটি বিনয়ী। বিনয় হলো স্বাভাবিক ভদ্রতা, সাধারণ শিষ্টাচার। বাংলা ভাষায় বিনয়ের অর্থ পাল্টে গেছে। মতলববাজদেরকে এখন বলা হচ্ছে বিনয়ী।”copy
—মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
পৃষ্ঠা ৩০২-৩০৪, অধ্যায়: বিনয়ী বাঘ
বই: ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠো রে