25/11/2024
মক্কার মা'লা কবরস্তান (আমাদের দেশের লোকজন যেটাকে জান্নাতুল মুআল্লা বলে থাকে) যিয়ারতে মোটামুটি সব হাজী সাহেবই যেয়ে থাকেন; কিন্তু কোথায় যে কে শায়িত —এটা জানেন খুব কম মানুষই। জাহেলি যুগের এই ঐতিহাসিক কবরস্তানে শায়িত আছেন সাহাবী, তাবেঈ, মুহাদ্দিস ও প্রসিদ্ধ শাসকসহ রসুলে হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবার ও বংশের বেশ কিছু প্রিয় মানুষ। শায়িত আছেন রাসুলে হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অত্যন্ত মুহব্বতের হযরত খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা-ও।
এর কাছেই খায়ফু বানি কিনানাহ এলাকাতে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের সময় তাঁবু খাটিয়েছিলেন, যাকে বর্তমানে মুআবাদা বলা হয়। এই মুআবাদাতেই কুরাইশরা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামসহ বনু মুত্তালিবের সদস্যদের বয়কটের ঘৃণ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
এ কবরস্তানে শায়িত আছেন উম্মুল মুমিনিন খাদিজা রা., কাসিম বিন মুহাম্মাদ রা., আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ রা., আবু তালেব, আবদুল মুত্তালিব, হাশেম, আবদে মানাফ, কুসাই বিন কিলাব, আবদুর রহমান বিন আবু বকর রা., আসমা বিনতে আবু বকর রা., আবদুল্লাহ বিন যুবাইর রা., সুমাইয়া রা. ইয়াসির রা. ও তাঁদের পরিবারবর্গ, মোল্লা আলি কারি রহ., ইবনে হাজার মাক্কি রহ., হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কি রহ. ও মাওলানা রহমাতুল্লাহ কিরানবি রহ. প্রমূখ।
একসময় এতে নামফলক ও গম্বুজ বানোনো ছিল। এখন তো তা নাই-ই, কার কবর কোনটা যে, তা বোঝার উপায়ও নেই। তবে সাধারণ ব্যক্তিদের কবরের চেয়ে সাহাবীদের কবরগুলো সামান্য ভিন্ন; অনুমান করা যায়, বিশেষ কারো হবে। প্রায় পুরোটা এক এক করে কয়েক ঘণ্টা ধরে, ঘুরে যিয়ারত করে এসে যখন মূল ফটকের কাছে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি আর টেলিগ্রাম ঘেঁটে বের করার চেষ্টা করছি—হাজী সাহেব রহ.-এর কবর কোনটা? তখন একজন খাদেম বললেন, "কবরস্তানের একটা বড় অংশই তো আপনারা দেখেননি! যেটা রাস্তার অপর পার্শ্বে। রাস্তার নিচের টানেল-সদৃশ পথ দিয়ে ওপারে গেলে পাবেন। এপারের দেখতে বিশেষ কবরদুটোর একটি হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর রা. -এর, অপরটি তাঁর মা হযরত আসমা বিনতে আবু বকর রা. -এর।"
আমরা আবার যাই। রাস্তার ওপারে যেয়ে দেখি, এরচেয়েও বড় অংশ রয়েছে এদিকটাতে। এরমধ্যে একটা অংশ বড় প্রাচীর ঘেরা। বড় বড় ফটকগুলোও বন্ধ। বন্ধ ফটকের কাছে বসেই এক বিহারি হিন্দুস্তানি খুব আবেগ জড়িত কণ্ঠে গজল গাইছে। যিয়ারত করে ফেরার সময় দেখি, সুরঙ্গপথের কাছে এক বিশেষ ধরনের কবরের কাছে দাঁড়িয়ে ইসালে সওয়াব করছে এক ইয়েমেনি। দুআর পর কৌতুহল নিয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইলে জানালেন, এখানে শায়িত হযরত আবদুর রহমান বিন আবু বকর রা.(٩٩ رقم), আর তাঁর পাশেই শায়িত মাসজিদুল হারামের মুআজ্জিন।
হঠাৎ ভাবনারা জড়িয়ে ধরে! মনে পড়ে— এই এখানেই তো তাহলে প্রিয় ভাইয়ের কবর যিয়ারত করতে এসে, তাঁর শিয়রে দাঁড়িয়ে আয়েশা রা. আবৃত্তি করেছিলেন —
وكنا كندماني جذيمة حقبة ... من الدهر حتى قيل لن يتصدعا
فلما تفرقنا كأني ومالكا ... لطول اجتماع لم نبت ليلة معا
এরপর সেই ইয়েমেনি আরো দেখালেন, বন্ধ চত্বরে ঢুকতেই প্রথমে যে চৌহদ্দি পড়ে, তাতে শায়িত আছেন হযরত খাদিজা রা. এবং তাঁর দুই পুত্র কাসিম ও আব্দুল্লাহ রা.। তার বামে অর্থাৎ বন্ধ চত্বরের নিচের দিকের কোনায় দেয়াল ঘেরা ও কিছুটা নিচু অংশে শায়িত হযরত সুমাইয়া রা. ও ইয়াসির রা. এবং তাঁদের পরিবারের অন্য সদস্যরা। আর এর বরাবর উপরের দিকে গাছের নিচে শায়িত আবু তালেব (আল্লাহ! আমাদের প্রিয় নবীজির প্রতি তাঁর ইহসানের সর্বোত্তম বিনিময় দান করো তাঁকে...), তাঁর পাশে অর্থাৎ একই সারিতে আছেন আবদুল মুত্তালিব, হাশেম, আবদে মানাফ ও কুসাই।
অনেক খুঁজেও পেলাম না হাজী সাহেবকে! শুধু এতটুকু জানতে পারলাম, হাজী সাহেব রহ. মাদরাসা সওলাতিয়্যার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা রহমাতুল্লাহ কিরানবি রহ. -এর পাশেই শায়িত। ভাবলাম, মাদরাসা সওলাতিয়্যায় গেলে হয়তো কোনো দায়িত্বশীল থেকে জানা যাবে; কিন্তু দুইদিন পর সওলাতিয়্যায় যেয়ে আরো দুঃখ হলো!
ফেরার সময় মন মানছিল না। আবদুল্লাহ বিন যুবাইর রা -এর প্রতি দুর্বলতার কারণে আবার যাওয়া হয় তাঁর শিয়রে ও সামান্য খুসুসি হাদিয়া পেশ করা হয়। ইচ্ছা তো ছিল সবার জন্যই আলাদা আলাদা হাদিয়া পেশ করার। কিন্তু আমার হাতে ছাতা ছিল, ডা. বদরুদ্দোজা ভাইয়ের হাতে ছাতা ছিল না। দীর্ঘ প্রায় তিন ঘন্টা ধরে রোদে পুড়ে কষ্ট করছেন —ভেবে ফিরে আসি। তাছাড়া কাছেই মাসজিদুল জিনে যোহর পড়ার তাড়াও ছিল কিছুটা।
(কবরের স্থানগুলো মনে রাখতেই একটু দীর্ঘ করে লেখা; হয়তো কারো কাজে লাগবে)