25/02/2024
শবে বরাত সম্পর্কে বিভ্রান্ত হতে হবে না। এই লেখাটি সুন্দর সমাধান দেবে, ইনশাআল্লাহ।
☑ শবে বরাত কি মর্যাদাপূর্ণ?
রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা শাবানের মধ্যরাতে (১৪ তারিখ দিবাগত রাত, যা শবে বরাত নামে প্রচলিত) তাঁর সৃষ্টির প্রতি (দয়ার) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক/বিদ্বেষপোষনকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’’ [ইমাম ইবনু হিব্বান, আস-সহিহ: ৫৬৬৫; বিভিন্ন সম্পূরক ও শাহিদ হাদিসকে সামনে রেখে এই হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন—শায়খ আলবানি (সিলসিলা সহিহাহ: ১১৪৪), শায়খ শুয়াইব আরনাউত্ব (তালিক মুসনাদে আহমাদ: ৬৬৪২) এবং অন্যান্য অনেক মুহাদ্দিস]
এই হাদিস অনুযায়ী, আল্লাহ সকল মুসলিমের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন—দুই শ্রেণি ছাড়া। তারা হলো: হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তি ও আল্লাহর সাথে শির্ককারী (মুশরিক)। অতএব, শবে বরাতে আল্লাহ কর্তৃক ঘোষিত সাধারণ ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত হতে চাইলে এই দুটো (হিংসা ও শির্ক) জঘন্য কাজ ত্যাগ করা অপরিহার্য। তবে, এই হাদিসটির অন্যান্য বর্ণনাসূত্রে আরও কিছু গুনাহের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তির কথা এসেছে, যারা এই ক্ষমার আওতায় আসতে পারবে না। তারা হলো: মদপানকারী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, আত্মহত্যাকারী, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, অহংকারবশত টাখনুর নীচে কাপড় পরিধানকারী (পুরুষ)। সুতরাং, এই রাতের সাধারণ ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত হতে এই গুনাহগুলো থেকেও বেঁচে থাকা জরুরি।
🕗 শবে বরাতের রোজা:
অত্যন্ত দুর্বল হাদিসে এই রাতের রোজার কথা এসেছে। এরকম দুর্বল হাদিসের দলিল দিয়ে এই রাতে রোজা রাখাকে সুন্নাত বলা যাবে না। তবে, যেহেতু নবিজি শাবান মাসে খুব বেশি পরিমাণে রোজা রাখতেন (সহিহ বুখারি: ১৯৬৯), সেহেতু এই মাসের যেকোনো দিনেই রোজা রাখা উত্তম। আর, প্রতি চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ (আইয়ামে বীযের) রোজা রাখা তো সুন্নাত। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে যারা রোজা রাখতে ইচ্ছুক, তাদের নিয়ত থাকবে—তাঁরা আইয়ামে বীযের নফল রোজা অথবা শাবান মাসের সাধারণ কোনো নফল রোজা রাখছেন।
⚠️ যে বিষয়গুলো জানা দরকার:
(১) খুব ভালো করে বুঝুন—শবে বরাতে পালনের জন্য নির্দিষ্ট কোনো আমল সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তবে, এই রাতটির ফজিলত বা মর্যাদা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যেহেতু রাতটির মর্যাদা আছে, সেহেতু এই রাতে যেকোনো নফল ইবাদত করা বৈধ এবং মুস্তাহাব (উত্তম); এমনটিই বলেছেন—ইমাম শাফিঈ, ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল, ইমাম আউযাঈ, ইমাম নববি, ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, ইমাম ইবনু রজবসহ অন্যান্য আলিমগণ। রাহিমাহুমুল্লাহ। এজন্য, কেউ চাইলে এই রাতে দু‘আ, দরুদ, নামাজ, রোজা, যিকর, তিলাওয়াত, ইস্তিগফার, কবর যিয়ারত ইত্যাদি নফল আমল করতে পারেন। কিন্তু এগুলোর কোনোটিকেই নির্দিষ্ট করে ‘‘শবে বরাতের আমল’’ মনে করে করা যাবে না।
বিপরীতে, অনেক ইমাম এই রাতকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে ইবাদত করা বিদ‘আত মনে করতেন। তাঁদের মাঝে অন্যতম হলেন—ইমাম আত্বা, ইমাম ইবনু আবি মুলাইকা, ইমাম মালিক, ইমাম আবদুর রহমান প্রমুখ রহিমাহুমুল্লাহ। সালাফদের অনেকের কাছে এই রাতটির বিশেষত্ব ছিলো না। তাঁরা এ সংক্রান্ত হাদিসকে দুর্বল সাব্যস্ত করতেন।
তাহলে আলিমগণের মাঝে দুটো মত পেলাম।
প্রথম মত: শবে বরাতের কোনো বিশেষ আমল সহিহ হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত নয়, কিন্তু এই রাতটির মর্যাদা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এজন্য এই রাতে “শবে বরাতের আমল” মনে না করে যেকোনো নেক আমল করা যাবে। এটিই অধিকাংশ আলিমের মত।
দ্বিতীয় মত: এই রাতের বিশেষ আমল নেই এবং এই রাতটিও বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ নয়। তাঁদের মতে, এ সংক্রান্ত সব হাদিস দুর্বল। আলিমগণের একটি অংশ মত দিয়েছেন।
যেহেতু দুটো মতের পক্ষেই নির্ভরযোগ্য আলিমগণের অবস্থান ছিলো এবং আছে, সেহেতু এ নিয়ে কারও উপর আক্রমণাত্মক হওয়া উচিত নয়। এটি এমন ইখতিলাফ (মতভিন্নতা), যেটি নিন্দনীয় নয়।
(২) এই রাতে গোসল করার ফজিলতের কথা হাদিসে আসেনি। ‘‘সওয়াব হবে’’ মনে করে এই রাতে গোসল করলে তা বিদ‘আতি কাজ হবে।
(৩) এই রাত ভাগ্যরজনী নয়। ভাগ্যরজনী বা ভাগ্যের রাত হলো, লাইলাতুল কদর। প্রত্যেক যুগের আলিমগণ স্পষ্টভাবে বলেছেন, ভাগ্যরজনী হলো লাইলাতুল কদর, যাকে আমরা শবে কদর বলি। শবে কদর শব্দের অর্থই হলো, “কদরের রাত”। শব অর্থ রাত আর কদর অর্থ: ভাগ্য। সুরা কদরের তাফসিরে এ ব্যাপারে বিস্তারিত পাবেন।
আলিমগণ বলেন, মূলত “শবে বরাত” পরিভাষাটি হওয়া উচিত ছিলো ‘‘শবে বারাআত’’ বা ‘‘লাইলাতুল বারাআত’’। শব/লাইলাতুন অর্থ রাত আর বারাআত অর্থ মুক্তি। অর্থাৎ ‘‘মুক্তির রাত’’। যেহেতু এই রাতে অসংখ্য মুসলিমের (গুনাহ থেকে) মুক্তির সুসংবাদ দেওয়া হয়, তাই এই নামকরণ যৌক্তিক। কিন্তু ‘‘শবে বারাআত’’-এর জায়গায় ‘‘শবে বরাত’’ পরিভাষাটি প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং ‘শবে বরাত’ মানে ভাগ্যরজনী ভেবে বিভ্রান্ত হবেন না। ভাগ্যরজনী একটিই, তা হলো—লাইলাতুল কদর বা শবে কদর।
আমরা যেটিকে “শবে বরাত” বলি, হাদিসে সেটিকে ‘‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’’ বা “মধ্য শাবানের রাত” বলা হয়েছে।
(৪) এই রাত উপলক্ষে হৈ-হুল্লোড় করা, আতশবাজি ফোটানো, হালুয়া-রুটি করা—এগুলোর কোনোটিই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। কোনো সওয়াব বা ইবাদতের নিয়ত ব্যতীত কেবল এই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের মুসলিম সংস্কৃতির অংশ হিসেবে কেউ যদি হালুয়া-রুটি বা অন্য কোনো খাবারের আয়োজন করে, তবে সেটি বিদ‘আত কিংবা নিন্দনীয় হবে না। কিন্তু সমস্যা হলো: মানুষ সংস্কৃতি আর ইবাদতের পার্থক্য বুঝে না। তারা এসব কাজকেও ইবাদত মনে করে। তাই, এগুলো থেকে দূরে থাকাই সতর্কতার দাবি।
(৫) ‘‘শবে বরাতের নামাজ’’ বলতে বিশেষ পদ্ধতির নির্দিষ্ট সংখ্যক রাকাতের কোনো নামাজ নেই। তবে, যেহেতু এই রাতের বিশেষ মর্যাদা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, তাই কেউ চাইলে সাধারণভাবে নফল নামাজ পড়তে পারেন, অন্য সময় যেভাবে পড়েন। আরেকটি কাজ করা যেতে পারে। সেটি হলো: ইশা এবং ফজরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা। হাদিসে এসেছে, এই দুই নামাজ জামাতে পড়লে সারা রাত নামাজ আদায়ের নেকি হয়। [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ১৩৭৭]
সারকথা: শবে বরাতের নির্দিষ্ট কোনো আমল সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়, তবে শবে বরাত (মধ্য শাবানের রাত)-এর বিশেষত্ব ও মর্যাদা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং রাতটি মর্যাদাপূর্ণ হওয়ায় কেউ চাইলে যেকোনো নফল আমল করতে পারেন। এটি মুস্তাহাব (উত্তম) হিসেবে গণ্য হবে। তবে, এগুলোর কোনোটিকেই ‘‘শবে বরাতের রোজা’’ বা “শবে বরাতের নামাজ” হিসেবে নির্দিষ্ট বা সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। অধিকাংশ ইমাম এই মতই দিয়েছেন।
আল্লাহু আলামু বিস সওয়াব।