12/10/2023
ফিলিস্তিন বিষয়ক কোন ইস্যু সামনে এলেই ফেসবুকে একটা কথা খুব ভাইরাল হয়ঃ সোনালী গম্বুজের মসজিদটা নাকি মসজিদুল আকসা না, কালো গম্বুজের মসজিদটাই নাকি আল আকসা। ‘ষড়যন্ত্র’ করে নাকি ভিন্ন মসজিদকে আল আকসা বলে চালানো হয়! অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার যে অধিকাংশ মুসলিমেরই ধারণা নেই “মসজিদুল আকসা” আসলে কী। আমরা কোনটা ‘ষড়যন্ত্র’ আর কোনটা ‘অজ্ঞতা’ সেটাই বুঝি না। তাই ভুলভাল তথ্যে ভরা ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো ভাইরাল হয়।
‘মসজিদুল আকসা’ যে আসলে কী, সেটা কুরআনেই আছে। আমরা খেয়াল করে পড়ি না বিধায় বুঝি না। কালো গম্বুজের মসজিদটা প্রথম নির্মাণ করেন উমার(রা.), তাঁর খিলাফতকালে ফিলিস্তিন বিজয়ের পরে। সোনালী গম্বুজের মসজিদটা (কুব্বাতুস সাখরা/Dome of Rock) নির্মাণ করেন উমাইয়া শাসক আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান, ৭২ হিজরিতে। [১] এর একটা মসজিদও রাসুল(ﷺ) এর জীবদ্দশায় ছিলো না। অথচ রাসুল(ﷺ) মসজিদুল আকসায় গিয়েছেন বলে কুরআনে উল্লেখ আছে! তিনি মসজিদুল আকসায় গিয়েছিলেন ইসরা-মিরাজের রাতে।
“পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে #মসজিদুল_আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।”
[আল কুরআন, বনী ইস্রাঈল (ইসরা) ১৭ : ১]
কালো গম্বুজ বা সোনালী গম্বুজ - এই ২ মসজিদ নির্মানেরও আগে থেকে “মসজিদুল আকসা” ছিল বলে আল কুরআন থেকেই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে! “মসজিদুল আকসা” তাহলে কোনটা? 🤔
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়া(র.) বলেছেন,
“মসজিদুল আকসা সেই পুরো এলাকার নাম, যেখানে সুলাইমান(আ.) মসজিদ বানিয়েছিলেন।”
[মাজমু’আতুর রাসাইল আল কুবরা ২/৬১]
ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশ্বকোষ ‘মাউসুআতুল ফিলাসতিনিয়্যাহ’তে বলা হয়েছে,
“”মসজিদুল আকসা” এই নামটি ঐতিহাসিকভাবে পুরো হারাম শারিফ এলাকাটিকে এবং এর মাঝের ইমারতগুলোকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।”
[মাউসুআতুল ফিলাসতিনিয়্যাহ ৪/২০৩] [২]
Islamqa (Hanafi) ওয়েবসাইটের এক ফতোয়াতে অনেক পূর্বযুগের উলামার রেফারেন্স উল্লেখ করে বলা হয়েছেঃ
Masjid al-Aqsa covers one-sixth of the south east area of old Jerusalem. The whole area within the compound walls (a total area of 144,000 m2) is Masjid al-Aqsa. Masjid al-Qibli, Dome of the Rock, Masjid al-Buraq are all inside the compound of Masjid al-Aqsa. Some people have a misconception that Masjid a-Qibli is only the Masjid. This is incorrect. The entire compound is a Masjid.
অর্থঃ পুরাতন জেরুজালেমের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের এলাকার ৬ ভাগের ১ অংশ জুড়ে মসজিদুল আকসা অবস্থিত। সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা পুরো এলাকাটিই (মোট ১৪৪,০০০ বর্গমিটার) ‘মসজিদুল আকসা’। মসজিদুল কিবলি, কুব্বাতুস সাখরা, মসজিদুল বুরাক এই সবগুলোই ‘মসজিদুল আকসা’ এলাকার মধ্যে অবস্থিত। কারো কারো একটি ভুল ধারণা আছে যে মসজিদুল কিবলি (কালো গম্বুজের) বুঝি একমাত্র , মসজিদ (আল আকসা)। এমন ধারণা সঠিক নয়। পুরো এলাকাটিই মসজিদ (আল আকসা)। [৩]
অর্থাৎ, নির্দিষ্ট কোনো ইমারত না বরং পুরো এলাকাটিই ‘মসজিদুল আকসা’। এর মাঝের যে কোনো ইমারত বা মসজিদ, খালি জায়গা – সবই ‘মসজিদুল আকসা’র অন্তর্ভুক্ত। ঠিক যেমন মক্কায় মসজিদুল হারাম একটা নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে অবস্থিত। এই এলাকার মধ্যে কাবা ঘর আছে, ইমারত আছে, খালি জায়গাও আছে। এই নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে সবটাই ‘মসজিদুল হারাম’। মসজিদুল আকসার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। রাসুল(ﷺ) ইসরা-মিরাজের রাতে যখন মসজিদুল আকসায় গিয়েছিলেন, তখন কিন্তু সেখানে কোনো ইমারত ছিলো না। সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা খালি স্থানটিই ছিলো 'মসজিদ'। [৩.৫] ঐ স্থানেই বহুকাল পূর্বে সুলাইমান(আ.) এবং বনী ইস্রাঈলের নবীদের মসজিদ ছিলো। মসজিদুল আকসা এলাকার মধ্যেই উমার(রা.) একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। সেই মসজিদেরই বর্তমান রূপ কালো গম্বুজের মসজিদটি। এই মসজিদটি উমারী মসজিদ ও কিবলি মসজিদ নামে পরিচিত। সোনালী গম্বুজের মসজিদটির নাম কুব্বাতুস সাখরা (Dome of Rock)। উমারী মসজিদ, কুব্বাতুস সাখরা – উভয়ই মসজিদুল আকসা এলাকার মাঝে। কাজেই এর যে কোনোটিতে সলাত আদায় মানেই ‘মসজিদুল আকসা’তে সলাত আদায় করা। এমনকি ঐ এলাকার মাঝের খালিও জায়গায় সলাত আদায় করলেও তা ‘মসজিদুল আকসা’তে সলাত আদায় রূপে গণ্য হবে। বাইতুল মুকাদ্দাস/বাইতুল মাকদিস কথাটি মসজিদুল আকসাকে বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়।
The Palestinian Academic Society for the Study of International Affairs (PASSIA) থেকে প্রকাশিত ট্র্যাভেল গাইডেও জনসাধারণের এই ভুল ধারণার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। ট্র্যাভেল গাইডের ৪-৫ নং পৃষ্ঠায় পুরো আল আকসা এলাকার ছবি উল্লেখ করে এর নিচে বলা হয়েছেঃ
“Al-Aqsa Mosque is often confused with the silver domed Al-Qibly Mosque which from an Islamic point of view is incorrect as it comprises the entire compound.” [৪]
কাজেই ফেসবুক বা অন্যান্য স্থানে যেভাবে বলা হয়ঃ কালো মসজিসদটাই ‘আসল’ আল আকসা মসজিদ, অন্য মসজিদটা না!” – এমন কথা নিতান্তই অজ্ঞতাপ্রসূত। উভয় মসজিদই আল আকসা এলাকার ভেতরে। আফসোসের বিষয় হলো আমরা জেরুজালেম ও ফিলিস্তিন বিজয় করতে চাই অথচ আল আকসা মসজিদ কী এটাই জানি না! আমাদের প্রথম কিবলা যে কেমন ছিলো এই ধরণের বেসিক জ্ঞানই আমরা অনেকে আজ পর্যন্ত অর্জন করিনি।
পোস্টের ছবিটি islamiclandmarks সাইট থেকে নেয়া হয়েছে। সেখানে এ বিষয়ে চিত্রসহ বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। [৫]
__ __ __
[১] https://islamqa.info/en/20903/
[২] https://www.palestinapedia.net//المسجد-الأقصى/
[৩] https://islamqa.org/hanafi/askimam/127616
[৩.৫] এখানে একটা প্রশ্ন আসতে পারে, সেই খালি জায়গা যদি মসজিদুল আকসা হয়, তাহলে ইসরা-মিরাজের পরে রাসুল(ﷺ) এর কাছে কুরাঈশরা কোন 'দরজা'র কথা জিজ্ঞেস করেছিলো যদি সেখানে তখন কোনো মসজিদের ইমারত না থেকে থাকে?
এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছেঃ সেখানে পুরো আল আকসা এলাকা যে সীমানাপ্রাচীর দ্বারা ঘেরা ছিল, সেই সীমানাপ্রাচীরের দরজার কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে দলিলসহ বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এখানেঃ https://is.gd/2yRYYs
[৪]http://www.passia.org/media/filer_public/5d/18/5d18192f-efb4-4d3d-abc5-08f7d2122576/aqsa-en-compressed.pdf
[৫] https://www.islamiclandmarks.com/palestine-masjid-al-aqsa/masjid-al-aqsa
✍️তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করেছেন মুহতারাম Muhammad Mushfiqur Rahman Minar