17/04/2023
অর্থনীতি
শিল্প :-
প্রকৃতপক্ষে টাঙ্গাইল শাড়ি জেলার গর্বের বস্ত্ত। টাঙ্গাইলের শাড়ির কদর দেশ জোড়া। এক সময় বাংলাদেশের খ্যাতি ও গৌরব ছিল মসলিন এবং জামদানিরজন্য। তন্মধ্যে জামদানি টিকে থাকলেও মসলিন শুধু এখন ইতিহাসের সামগ্রী। তবে মসলিন ও জামদানির পর বাংলাদেশের বস্ত্র খাতে টাঙ্গাইল শাড়ি নতুনমাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়েছে।
টাঙ্গাইল শাড়ি ছাড়া টাঙ্গাইলের বিভিন্ন গ্রামে যেমন, আদি টাঙ্গাইল, পাথরাইল, নলশোধা, আকদ, ঘারিন্দা, ছাতিহাটি, গোলরা, রামপুরা, জোয়াইর, মোমিননগর, করটিয়া প্রভৃতি এলাকায় মোটা বস্ত্র তৈরি হয়। এ-সব কাপড়ের রং পাকা এবং মজবুত। শাড়ি ছাড়াও টাঙ্গাইলের লুঙ্গি, গামছা ইত্যাদি তৈরি হয়।
টাঙ্গাইল জেলার কুটির শিল্প বলতে বর্তমানে তন্তুবায়ীদের বোঝায়; যারা হিন্দু সম্প্রদায়ের তাদেরকে তাঁতি এবং যারা মুসলিম সম্প্রদায়ভূক্ত তাদের জোলা বা কারিগর বলা হয়ে থাকে।
তাঁত শিল্প :-
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই হচ্ছে টাঙ্গাইলের আদি তাঁতি অর্থাৎ আদিকাল থেকেই এরা তন্তুবায়ী গোত্রের লোক। এরা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদে এসে তাঁতের কাজ শুরু করেন। তারপর চলে আসেন বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে। সেখানেও আবহাওয়া অনেকাংশে প্রতিকূল দেখে বসাকরা দু’দলে ভাগ হয়ে একদল চলে আসে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, অন্যদল ঢাকার ধামরাইয়ে। তবে এদের কিছু অংশ সিল্কের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজশাহীতেই থেকে যায়। ধামরাইয়ে আবার ভাগ হয়ে অনেক বসাক চলে যান প্রতিবেশী দেশের চোহাট্টা অঞ্চলে। এর পর থেকে বসাক তাঁতিরা চৌহাট্টা ও ধামরাইয়া’ এ দু’গ্রুপে স্থায়ীভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এর মধ্যে কিছু বসাক টাঙ্গাইলে এসে বসতি স্থাপন করেন। টাঙ্গাইলে বংশানুক্রমে যুগের পর যুগ তারা তাঁত বুনে আসছেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশভাগ ও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর অনেক বসাক তাঁতি ভারত চলে যান।
বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাং তাদের ভ্রমণ কাহিনীতে টাঙ্গাইলের বস্ত্র শিল্প অর্থাৎ তাঁত শিল্পের উল্লেখ করেছেন। এটি আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। বাংলাদেশের তাঁত শিল্পের ইতিহাস অতি প্রাচীন। প্রাচীন কাল থেকে টাঙ্গাইলের দক্ষ কারিগররা তাদের বংশ পরম্পরায় তৈরি করছেন নানা জাতের কাপড়। আর কাপড় তৈরিতে লাগে সূতো। সূতো তৈরি হয় তুলো থেকে। টাঙ্গাইল জেলার প্রাচীন অঞ্চল মির্জাপুর উপজেলা বিখ্যাত গবেষক জেম্স টেলর মির্জাপুরের তুলোর কথা লিখেছেন। এখানে বাপ্তা হাম্মাম ও অন্যান্য পাঁচমিশালী বস্ত্রের সূতো কাটা হতো তুলো থেকে। টাঙ্গাইলের তাঁতিরা একদা মসলিন শাড়ি বুনতেন বলে শোনা যায়। এক সময় দিল্লির মোগল দরবার থেকে বৃটেনের রাজ প্রাসাদ পর্যন্ত এই মসলিনের অবাধ গতি ছিল। বিদেশী বণিক চক্রের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মসলিন কাপড় কালের প্রবাহে হারিয়ে গেছে।
তাঁত শিল্পের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে টাঙ্গাইলের জামদানী, বেনারসী, তাঁতের শাড়ি, সফট সিল্ক ও কটন শাড়ি। এ ছাড়াও টাঙ্গাইলের তাঁতিরা তাঁতের শাড়ির, লুঙ্গি, গামছা ও চাদর তৈরি করে থাকে।
তামা-কাঁসা শিল্প :-
হাজার বছরের পুরনো এ শিল্প ইতিহাসে প্রমাণ আছে। গ্রাম সমবায়ে কাংস্যকার, কাংস্যবণিক ইত্যাদি বৃত্তিধারী শ্রেণী ছিল। পাঠান, মোগল ও বৃটিশ শাসনামলে কাংস্যকার যখন যে রূপ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল, সেরূপ বিকাশ লাভ করতে পেরেছিলো। কাঁসা ও পিতলের অপূর্ব শিল্প কর্মের জন্য ব্রিটিশ সরকার কাঁসা শিল্পীদের মধ্যে নাম করা অনেককেই প্রশংসা ও পদকে ভূষিত করেছেন। এদের মধ্যে প্রয়াত মধুসূদন কর্মকার, গণেশ কর্মকার, বসন্ত কর্মকার, যোগেশ কর্মকার, হারান কর্মকার উল্লেখযোগ্য। কাগমারীতে যারা তামা, পিতল, কাঁসা শিল্পের সাথে জড়িত তাদের বংশগত উপাধি কর্মকার। লৌহ, তামা, পিতল, কাঁসা, স্বর্ণ ও রৌপ্য ইত্যাদি ধাতু নিয়ে যাদের জীবিকা তাদের কর্মকার বলা হয়ে থাকে। এক সময় এ-ব্যবসা ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী। দেশ ভাগ হওয়ার পর এই শিল্পের শত শত দক্ষ পরিবার ভারতে পাড়ি দিয়েছে।
কাঁসার বাসন ছাড়াও তামা-পিতলের থালা, বাটি, কলসী, গ্লাস, জগ, ঝারি, পঞ্চ প্রদীপদান, মোমবাতিদান আগর বাতিদান, কুপি, চামচ, কাজলদানী, ডেকচি, ডেগ, বোল, খুন্তি, সড়তা, বাটি তৈরি হয়। এছাড়া তৈরি করা হত পিতলের কলসি, জগ, ঘটি, বদনা, লোটা, থালা, গ্রাস, বোল, ডেকচি, চামচ, খুন্তি,কাঁসার ঘন্টা, বাটি, পুষ্পাধার প্রভৃতি। বাদ্যযন্ত্র যেমন করতাল, ঝুনঝুনি ইত্যাদিও এখানে তৈরি হয়। সুদৃশ্য কারুকার্য ও অনুপম গুণগত মানের জন্যই টাঙ্গাইলের কাঁসা ও পিতলের তৈরি তৈজসপত্র এতটা প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিলো।
টাঙ্গাইলের কাগমারীসহ জেলার নানা গ্রামাঞ্চলে এই কাঁসা ও পিতল শিল্পীরা তৈরি করছে নানা দ্রব্যাদি।
মৃৎ শিল্প :-
টাঙ্গাইলের এঁটেল মাটির তৈজসপত্র অতন্ত্য টেকসই। মাটির তৈজসপত্র, সানকি, হাড়ি, সরা, বাটি, পিঠা তৈরির ছিদ্রযুক্ত পাতিল, গবাদি পশুর সম্মুখে যে পাত্রে খাওয়া দেওয়া হয় (চাড়ি), দইয়ের ঠিলা, কোলা, গুড়ের মটকি প্রভৃতি টাঙ্গাইলের কুমারদের অনবদ্য সৃষ্টি। নানা ধরনের খেলনা ঘোড়া, গরু, বাঘ, হাতি, কুকুর, মাছ, আম, কাঁঠাল ইত্যাদি মাটির তৈরি খেলনা তৈরি করা হয়। টাঙ্গাইলের কুমারদের মধ্যে অনেকে প্রতিমা নির্মাণে সিদ্ধহস্ত।
বাঁশ ও বেত শিল্প :-
বাঁশ দিয়ে বাঁশি. ডালি, চাটাই, ধাড়ি, কাইত্যা, বেড়, ডুলি, ঘরের বেড়া, টুকরি, ঝাকা, কূলা চালনি, খালই, তালাই, মাথাইল ইত্যাদি। বেতের তৈরি ডালিয়া, ধান চাউলের বেড় ও তিল তিসি, সরিষা রাখার ছোট বড় ডুলি। বাটখারা প্রচলনের পূর্বে পাঁচসেরি মুনকা বা ধামার ব্যবহার ছিল। পাট বেতের সাহায্যে চমৎকার শীতল পাটি তৈরি হয়।
কাঠ শিল্প :-
সূত্রধর বা ছুতার কৃষি সরঞ্জাম যেমন, লাঙ্গল, ঈষ, মই, আচড়া, ইচামুগর, গরুর গাড়ি, ঢেঁকি, গৃহনির্মাণ ও নৌ-নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। খাট, পালঙ্ক, বারকোশ, পিঁড়ি, টুল, জলচৌকি থেকে শুরু করে আধুনিক টেবিল চেয়ার শোকেস, আলমিরা প্রভৃতি তৈরিতেও টাঙ্গাইলের সূত্রধররা দক্ষতার সাথে কাজ করছে। টাঙ্গাইলের মধুপুর, ধনবাড়ী, কালিহাতী, ঘাটাইল, মির্জাপুর, করটিয়া উল্লেখযোগ্য কাঠশিল্পের স্থান।
নদী ও খালের তীরবর্তী হওয়ায় সাধারণ নৌকাসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরার নৌকাও তৈরি হয়।
মিষ্টান্ন শিল্প :-
২শ বছরের প্রাচীন মিষ্টিশিল্প টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের মিষ্টিশিল্প। ব্রিটিশ আমল থেকে অবিভক্ত ভারতবর্ষসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পোড়াবাড়ির চমচম টাঙ্গাইলকে ব্যাপক পরিচিত করেছে। বাংলা, বিহার, ছাড়িয়ে ভারতবর্ষ তথা গোটা পৃথিবী জুড়ে এর সুনাম রয়েছে। গবেষকদের মতে দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি বৃটিশ আমলে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী পোড়াবাড়িতে আসেন। আসাম থেকে আগত এই দশরথ গৌড় যমুনার সুস্বাদু মৃদুপানি ও এখানকার খাঁটি গরুর দুধ দিয়ে প্রথম চমচম তেরি করেন। অতঃপর এখানে ব্যবসা শুরু করেন।
মিষ্টি দধি ও অন্যান্য দুগ্ধজাত দ্রব্যের মিষ্টান্নশিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। টাঙ্গাইল জেলায় অনেক মিষ্টি তৈরি হয়। যেমন- চমচম, দানাদার, রসগোল্লা, আমৃত্তি, জিলাপী, সন্দেশ, বিভিন্ন প্রকার দই, খির, নই, টানা, খাজা, কদমা বাতাসা, আমির্তি, রসমালাই, রসগোল্লা, সন্দেশ, কালোজাম জিলাপী খাজা বাতাসা, কদমা, নই, টানাবাদাম ইত্যাদি। এছাড়া আরও তৈরি হয় জিলাপি, কদমা, বাতাসা, গজা, খাজা, নই, টানা এবং চিনি সহযোগে খোরমা, মিস্ত্রী, চিনি বা গুড়ে সাজ, মুড়ির মোয়া, ঢেপের মোয়া, ঝুরি, জোয়ারের খইসহ বিভিন্ন উপদানের তৈরি নাড়ু ইত্যাদি। এ ছাড়া টাঙ্গাইল দানাদার, দই ও ঘি সহ দুগ্ধজাত দই, ক্ষীর, ঘি, মাখন ইত্যাদি তৈরি হয়।
অন্যান্য শিল্প :-
বর্তমানে টাঙ্গাইলে বিড়ি শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। অনেক বিড়ি তৈরির ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। তেলি বা কলু সম্প্রদায় তিল, তিসি, সরিষা প্রভৃতি তৈলবীজ ভেঙ্গে প্রস্ত্তত করে তৈল। কলের ঘানির উদ্ভবের সাথে সাথে টাঙ্গাইলের এই শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। তাছাড়া টাঙ্গাইলের মুচি ও ঋষিরা মৃত গরুর চামড়া সংগ্রহ করে বিক্রি করে। এদের মধ্যে অনেকে জুতাও তৈরি করে আসছে। এদের অনেকেই ঢাক, ঢোল, তবল, ডুগি প্রভৃতি তৈরি করে থাকে।টাঙ্গাইলের মধুপুর বাংলাদেশের একমাত্র জায়গা যেখানে অতি মূল্যবান লাল চন্দন পাওয়া গেছে।
কৃষি :-
ধান, পাট, গম, সরিষা, কলা, আনারস, আদা, ইক্ষু, আলু, তিল, তিশি, হলুদ, লেবু, পেঁপে, আদা ও কচু ইত্যাদি। টাঙ্গাইলে প্রচুর পাট জন্মে। গোপালপুরের বিভিন্ন এলাকায় সর্বোৎকৃষ্ট পাট উৎপাদিত হয়। এছাড়া জেলার বিভিন্ন থানাগুলোতেও ভালো পাট জন্মে। মধুপুর, সখিপুর, মির্জাপুর, ঘাটাইলের পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর কাঁঠাল উৎপন্ন হয়। মধুপুরসহ বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলে প্রচুর আনারস উৎপন্ন হয়। শীত মৌসুমে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর শাকসব্জী, বাঁধাকপি, ফুলকপি, আলুসহ বিভিন্ন সবজি প্রচুর উৎপন্ন হয়। মে ২০২২ এ প্রকাশিত কৃষি পরিসংখ্যান তথ্যমতে কলা ও আনারস উৎপাদনে শীর্ষ জেলা টাঙ্গাইল।