27/08/2021
চন্দ্রনাথ পাহাড় ও মন্দির
স্থান আইডিঃ ১৭
সীতাকুণ্ড পাহাড় হিমালয় হতে বিচ্ছিন্ন হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলীয় অংশ। এই পাহাড়টি হিমালয়ের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক ঘুরে ভারতের আসাম এবং ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্য দিয়ে ফেনী নদী পার হয়ে চট্টগ্রামের সঙ্গে মিশেছে। চট্টগ্রাম অংশে ফেনী নদী থেকে চট্টগ্রাম শহর পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৭০ কিলোমিটার। এই পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত হয়েছে সীতাকুণ্ড ইকো পার্ক।
সীতাকুণ্ড শহরের পূর্বে অবস্থিত চন্দ্রনাথ শৃঙ্গ প্রায় ১১৫২ফুট (প্রায়) উঁচু এবং চট্টগ্রাম জেলার সর্বোচ্চ স্থান। রাজবাড়ি টিলার উচ্চতা ৯০০ ফুট এবং সাজিঢালার উচ্চতা ৮০১ ফুট। চট্টগ্রাম শহরের কাছাকাছি এসে এই পাহাড়ের উচ্চতা অনেক কমে এসেছে। চট্টগ্রাম শহরের উপকন্ঠে বাটালি হিলের উচ্চতা ২৮০ ফুট এবং শহর থেকে সামান্য উত্তরে নঙ্গরখানা ২৯৮ ফুট উঁচু।
এখানে রয়েছে সহস্রধারা আর সুপ্তধারা নামের দুটি জলপ্রপাত। মীরসরাই অংশে রয়েছে খৈয়াছড়া, হরিণমারা, হাটুভাঙ্গা, নাপিত্তাছড়া, বাঘবিয়ানী, বোয়ালিয়া, অমরমানিক্যসহ আরো অনেক অনেক ঝর্ণা ও জলপ্রপাত। পূর্বদিকে এই পাহাড় থেকে উৎসারিত হয়ে কয়েকটি ঝর্ণা তথা খাল হালদা নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। এর মাঝে গজারিয়া, বারমাসিয়া, ফটিকছড়ি, হারুয়ালছড়ি এবং বোয়ালিয়া অন্যতম। পশ্চিম দিকে মহামায়া, মিঠাছড়া সহ আরো কয়েকটি ছড়া ও ঝর্ণা বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। বর্তমানে মহামায়া ছড়ার উপর একটি রাবার ড্যাম নির্মিত হয়েছে। এই লেক দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম লেক, তাছাড়া নীলাম্বর হ্রদ নামে একটি মনোরম লেক এই পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত।
সীতাকুন্ডের নিকটে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপরে অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির অন্যতম বিখ্যাত শক্তিপীঠ। সীতাকুণ্ড অপরূপ প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয্যের লীলাভূমি । এ এলাকাকে হিন্দুদের বড় তীর্থস্থান বলাই ভালো । এখানের সর্বোচ্চ পাহাড় চুড়ায় অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির । আর অন্যান্য আরো রয়েছে বড়বাজার পূজা মন্ডপ, ক্রমধেশ্বরী কালী মন্দির, ভোলানন্দ গিরি সেবাশ্রম, কাছারী বাড়ী, শনি ঠাকুর বাড়ী, প্রেমতলা, শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী সেবাশ্রম, শ্রী রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম, গিরিশ ধর্মশালা, দোল চত্বর, ননী গোপাল সাহা তীর্থযাত্রী নিবাস, তীর্থ গুরু মোহন্ত আস্তানা, বিবেকানন্দ স্মৃতি পঞ্চবটি, জগন্নাথ আশ্রম, শ্রীকৃষ্ণ মন্দির, মহাশ্মশানভবানী মন্দির, স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির,গয়াক্ষেত্র, জগন্নাথ মন্দির, বিরুপাক্ষ মন্দির, পাতালপুরী, অন্নপূর্ণা মন্দির ইত্যাদি এখানে হিন্দু পবিত্র গ্রন্থসমূহ অনুসারে সতী দেবীর দক্ষিণ হস্তার্ধ পতিত হয়েছিল। সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ মন্দির তীর্থযাত্রীদের জন্য এক পবিত্র স্থান। এর পুরনো নাম ছিলো "সীতার কুন্ড মন্দির"।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাসে সীতাকুন্ড
ঢাকার সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, মহাখালি যে কোন বাস স্ট্যান্ড থেকে চট্রগ্রাম গামী যে কোন বাসে করেই যেতে পারবেন সীতাকুন্ড। এস আলম, শ্যামলি, সৌদিয়া, ইউনিক, হানিফ, ঈগল, এনা প্রভৃতি পরিবহনের নন এসি বাস ভাড়া ৪২০- ৪৮০ টাকা। এসি বাসের মধ্যে গ্রিনলাইন, সৌদিয়া, সোহাগ, টি আর এইসব বাস ভাড়া ৮০০-১১০০ টাকা। অবশ্যই নাইট কোচে রওনা দিয়ে সকালে গিয়ে সীতাকুণ্ড বাজারে নামবেন।
ঢাকা থেকে ট্রেনে সীতাকুন্ড
ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম গামী যে কোন আন্তঃনগর ট্রেনে এসে ফেনী স্টেশনে নামতে হবে। শ্রেনীভেদে ট্রেন ভাড়া জন প্রতি ২৬৫-৮০০ টাকা। ফেনী স্টেশন থেকে ১০-১৫ টাকা রিক্সা/অটো দিয়ে ফেনী মহিপাল বাস স্ট্যান্ড যেতে হবে। সেখান থেকে লোকাল বাসে ৫০-৮০ টাকা ভাড়ায় সীতাকুন্ড যেতে পারবেন। তবে রাতে রওনা দিয়ে সকালে গিয়ে নামলে ভালো হবে।
চট্রগ্রাম থেকে সীতাকুণ্ড
চট্টগ্রাম শহর থেকে যেতে চাইলে প্রথমে এ কে খান মোড়ে আসতে হবে। সেখান থেকে ঢাকাগামী অথবা সীতাকুণ্ডগামী বাসে করে সীতাকুণ্ড বাজারে নামতে হবে। যাবার পথে পাবেন এরকম ছোট ছোট অনেক মন্দির।হাইওয়ের পাশের সিঁড়িপথ দিয়ে নিচে নেমে সিএনজি নিয়ে চলে যেতে হবে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের গোড়ায়। সেখানে নেমে একটু হাঁটলে চোখে পড়বে “শ্রী শ্রী চন্দ্রনাথ” লেখা বেশ পুরনো একটি গেট। সেখান থেকে মিনিট দশেক হেঁটে পৌঁছে যাবেন চন্দ্রনাথ মন্দিরে যাবার মূল সিঁড়িপথে।এখানে বলে রাখি, সিএনজি থেকে নেমে সিঁড়িপথ পর্যন্ত যাবার পথে পাবেন অনেক পুরনো মন্দির। যেগুলোয় একবার করে হলেও ঢুঁ মেরে যাবেন। রাস্তা থেকে বাঁশের লাঠি নিতে ভুলবেন না যেন। যাওয়ার সময় আবার ফেরত দিয়ে যেতে হবে।
কি খাবেন
সীতাকুণ্ডে সাধারণ মানের হোটেলের মধ্যে সৌদিয়া রেস্টুরেন্ট, আপন রেস্টুরেন্ট এবং আল আমিন উল্লেখ্যযোগ্য। তবে ভাল খাবার পরিবেশনায় এখানে আল আমিনের বেশ সুনাম রয়েছে। ব্যাগে যথেষ্ট পরিমাণে পানি ও স্যালাইন রাখুন।কারণ মন্দিরে পানি পাওয়া কঠিন। আর পাওয়া গেলেও দাম প্রায় দ্বিগুণ। পথে খাওয়ার জন্য কলা রুটি সাথে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখবেন কোনোমতেই কলার খোসা যেন সিঁড়িপথে না ফেলা হয়। কারণ আপনার একটি ভুলে অন্য কারো জীবনও হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারে।
কোথায় থাকবেন
সীতাকুণ্ডে থাকার জন্য হোটেল সৌদিয়া, সাইমুন আবাসিক সহ সীতাকুণ্ড বাজারে কয়েকটি মাঝারি মানের আবাসিক হোটেল আছে। হোটেল সৌদিয়ায় বুকিং দিতে ফোন করতে পারেন। এছাড়া এখানে টেলি-কমিউনিকেশনের অধীনস্থ একটি ডাকবাংলো আছে। অনুমতি নিয়ে সেখানে থাকার চেষ্টা করতে পারেন। ভালো কোথাও থাকতে চাইলে চট্টগ্রাম অলংকার মোড়ে মোটামুটি মানের ৬০০-১৫০০ টাকায় হোটেলে রাত্রি যাপন করতে পারবেন। এছাড়া স্টেশন রোড, নিউমার্কেট, জিইসি মোড়ের আশেপাশে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেলে রাত্রি যাপন করতে পারবেন। সীতাকুণ্ড বাজারে কিচু ভালোমানের আবাসিক হোটেল রয়েছে।
চন্দ্রনাথ পাহাড় ভ্রমণে যা দেখবেন
চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় উঠলেই আপনি মন্দিরের দেখা পাবেন। তবে এর জন্য আপনাকে পাড়ি দিতে হবে প্রায় ২২০০ এরও বেশি সিঁড়ি। কোনো কোনো স্থানের সিঁড়িগুলো এতোটাই পিচ্ছিল ও সংকীর্ণ যে ওঠা বিপজ্জনক হতে পারে।
১৫ মিনিট ওঠার পর একটি ছোট ঝর্ণা দেখতে পাবেন। যার দুই পাশে দুটি পথ যা উঠে গেছে একদম পাহাড়ের চূড়োয়। বাম পাশের পথ দিয়ে ওঠা সহজ। ডান পাশের পথ দিয়ে নামা সহজ। তাই বাম পাশের পথ ধরে উপরে উঠাই উওম।
এই রাস্তাটা সম্পূর্ণ পাহাড়ি পথ এবং এতে কিছু ভাঙা সিঁড়ি আছে। আর ডান পাশের পথটার প্রায় পুরোটাই সিঁড়িপথ যেটা দিয়ে ওঠা বেশ কঠিন। অনেকে এই পথ দিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে অর্ধেক পথে ফিরে আসে।
তবে এত কঠিন পথ পাড়ি দিতে হলেও আশেপাশের সবুজে ঘেরা অকৃত্রিম মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। পাহাড়ে ওঠার ফাঁকে ফাঁকে ছবি তুলে প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে ফ্রেমবন্দী করে রাখতে পারেন।
মাঝে মাঝে থেমে বিশ্রাম নিতে পারবেন চায়ের দোকানগুলোতে।গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। সেইসঙ্গে কোলাহলহীন পাহাড়ের কোলে বসে পাখির ডাক, বাতাসে গাছের পাতার শব্দ সব শুনতে পাবেন।
প্রায় দেড় ঘণ্টা আরোহণের পর চন্দ্রনাথ মন্দির পৌঁছানোর আগে বিরুপাক্ষ নামের আরেকটি মন্দির পড়বে। চাইলে সেখানে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারেন৷ এখান থেকে সীতাকুণ্ড শহরের ও সমুদ্রের এক অদ্ভুত দৃশ্য আপনি দেখতে পাবেন।
তবে সব কষ্ট মুহূর্তেই ভুলে যাবেন চন্দ্রনাথ মন্দিরের উপরে উঠে আশেপাশের দৃশ্য দেখার পর। চারপাশ শুধু সবুজ আর সবুজ। যেন কোনো শিল্পী তার নিপুণ হাতে রংতুলিতে আঁকা। সীতাকুণ্ডের প্রায় পুরোটাই দেখতে পাবেন এখান থেকে। দূরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে এক ঐশ্বরিক অনুভূতিতে আপনার মন প্রাণ জুড়িয়ে যাবে মুহূর্তেই। মন্দিরটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান। মন্দিরের ভেতরে শিব লিঙ্গ রাখা আছে। এর আশেপাশে অনেক সাধু-সন্নাসীরা বসে ধ্যান করেন। কেউ কেউ পূজো করে থাকেন। তাই এখানে হইহুল্লোড় না করে নিরবতা বজায় রেখে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। কারণ পরের পথটা আরও বেশি ভয়ানক, আরও বেশি রোমাঞ্চকর।
সীতাকুন্ডের নিকটতম কিছু ঐতিহ্যবাহী, দর্শনীয়
এবং ধর্মীয় স্থান
>বারৈয়াঢালা আশ্রম
>বাড়বকুণ্ড
>ব্যাসকুণ্ড
>অক্ষয়বট
>জগন্নাথ মন্দির
>কুমারীকুণ্ড
>লবণাক্ষ তীর্থ
>সহস্রধারা
>শংকর মঠ
>বারৈয়াঢালা আশ্রম
>রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম
>ভোলানন্দ গিরি আশ্রম
>কেন্দ্রীয় মহাশ্মশান
>কর্কর নদী
>দর্শনীয় স্থানসম্পাদনা
>উপকূলীয় বনাঞ্চল
>গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত
>বার আউলিয়া দরগাহ শরীফ (সোনাইছড়ি)
>বিস্তীর্ণ সমুদ্র সৈকত
>বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকো-পার্ক, সীতাকুণ্ড
>সুপ্তধারা ঝর্ণা
>হাম্মাদিয়ার মসজিদ
>খৈয়াছরা ঝর্ণা
>নাপিওাছরা ঝর্ণা
প্রয়োজনীয় তথ্য
>চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উচ্চতা খুব বেশি না হলেও এর চূড়ায় ওঠার পথটি বেশ সরু এবং দুর্গম। কেউ তাড়াহুড়া করে পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করবেন না। তাতে যেকোনো বড় দুর্ঘটনা হতে পারে।
>পাহাড়ে উঠতে, নামতে নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করুন। উল্টো পথে কখনো উঠতে কিংবা নামতে চেষ্টা করবেন না।
>কোনো ধরনের পচলশীল ও অপচনশীল ময়লা আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলবেন না। ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থান না পেলে ব্যাগে সংরক্ষণ করুন।
>পাহাড়ের উপর মন্দিরের পবিত্রতা রক্ষা করবেন >যতটা সম্ভব হালকা জামাকাপড় পরিধান করুন
ব্যস্ততম জীবনের ক্লান্তি দূর করতে প্রায় সারাবছরই ভ্রমণ পিপাসুরা ঘুরতে যায় চন্দ্রনাথ পাহাড় ও মন্দির। আপনিও চাইলে সামনের কোনো ছুটিতে ঘুরে আসতে পারেন চন্দ্রনাথ পাহাড় ও মন্দির থেকে, কাটিয়ে আসতে পারেন জীবনের সেরা কিছু সময়। আবার চাইলে বিডিট্যুর এর সাথেও ঘুরে আসতে পারেন ।