30/08/2015
বেড়িয়ে আসুন মেঘের রাজ্যে
==================
মেঘালয়ের রাজধানী শিলং। শিলং যাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো সেপ্টেম্বর থেকে জুন। আমাদের দেশের এত কাছে এই মেঘালয়! ওখানে সারাবছরই কম-বেশি ঠা-া থাকে। তাই আমার বন্ধুরা যারাই শিলং বেড়াতে যেতে চান তারা অবশ্যই হালকা গরম কাপড় ও রেইনকোট সঙ্গে নিতে ভুলবেন না।
মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। আমার ধারণা ছিল এখানে মনে হয় সারাদিনই বৃষ্টি হয়। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। পরে বলি চেরাপুঞ্জির গল্প।
এখন শুরু করি প্রথম থেকে, কীভাবে যেতে হবে মেঘালয়। ঢাকা থেকে সিলেটের বাসে করে যেতে পারেন, সময় লাগবে প্রায় ৫ ঘণ্টা। সিলেট থেকে তামাবিল যেতে সময় লাগে ১ থেকে দেড় ঘণ্টার মতো। কোনো বাসই তামাবিল পর্যন্ত যায় না। তাই ট্যাক্সিতে বা মাইক্রোবাসে করে তামাবিল পর্যন্ত যেতে হবে। ট্যাক্সি ভাড়া নেবে ১,০০০-১,২০০ টাকা। তামাবিল হলো বাংলাদেশের বর্ডার। খুবই সুন্দর আমাদের সিলেট এবং তামাবিল যাওয়ার পথটা। মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তামাবিল যাওয়ার পথে অনেক ঝরনা দেখতে পাবেন। সব ঝরনাই অবশ্য প্রতিবেশী দেশের।
গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো ট্রাভেল ট্যাক্স পরিশোধ করতে হয় সিলেটের তামাবিল যাওয়ার পথে জৈন্তা থেকে বা সোনালী ব্যাংকের যে কোনো শাখা থেকে। তামাবিল বর্ডারে কোনো ট্রাভেল ট্যাক্স দেয়া যায় না। ট্রাভেল ট্যাক্স জনপ্রতি ৩০০ টাকা লাগে। ঢাকা থেকে ট্রাভেল ট্যাক্স করে যাওয়াই ভালো।
বাংলাদেশের তামাবিল সীমান্তে ইমিগ্রেশন করে যাবেন ইন্ডিয়ার ডাউকি সীমান্তে। আমাদের এই তামাবিল সীমান্ত দিয়েই ইন্ডিয়া থেকে বিভিন্ন রকমের পাথর ও কয়লা বাংলাদেশে আসে। বন্ধুরা আরো একটি প্রয়োজনীয় কথা হলো আপনারা যে গাড়িতে করে তামাবিল বর্ডার পর্যন্ত যাবেন, সেই গাড়ির ড্রাইভারকে অবশ্যই বলে দেবেন, কবে আপনারা ফিরে আসবেন। কারণ এখানে সহজে ট্যাক্সি বা কোনো যানবাহন পাওয়া যায় না। প্রয়োজনে তার মোবাইল নম্বরটা রাখবেন। ফেরার সময় তাকে জানিয়ে দেবেন।
যা-ই হোক, যেই মাত্র ডাউকিতে প্রবেশ করবেন তখন থেকেই আপনি ঝরনা ও পাহাড় দেখতে পাবেন। ডাউকি থেকে শিলং যেতে সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা, ট্যাক্সি ভাড়া নেবে ১,২০০ থেকে ১,৬০০ রুপি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শিলং শহরটি ১৪৯৬ মিটার উঁচুতে। বর্ডারের কাছেই অবস্থিত ব্রিজটি পার হওয়ার সময়ই মনে হলো কতবার দেখেছি এই ব্রিজটি তামাবিলের জাফলং থেকে। এখান থেকেই সুন্দর দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠার পালা শুরু। কিন্তু মনে মনে অনেক রাগ হবে, কী কায়দা করেই না সীমান্ত ভাগাভাগি হয়েছিল। কিন্তু রাগ পানি হতে থাকবে যখন গাড়িটি এঁকেবেঁকে ওপরের দিকে উঠতে থাকবে। কী অদ্ভুত নির্মল বাতাস, চোখ জুড়ানো, মন ভোলানো সব পাহাড়ি দৃশ্য। গাড়ি যত ওপরের দিকে উঠতে থাকবে ততই ঠা-ার আমেজ শরীরে লাগবে। হঠাৎ আকাশ কালো হয়ে যাচ্ছে, আবার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। কী সে অপরূপ দৃশ্য তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। কত রংয়ের যে পাহাড় চোখে পড়বে তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। সাদা, লাল, ছাই রংয়ের পাহাড়। শিলং যাওয়ার পথে একটা রাস্তা চেরাপুঞ্জির দিকে চলে যায়। শিলং শহরটা পাহাড়ের একটু নিচে অবস্থিত। শিলংয়ের ‘পুলিশ বাজারে’ সব হোটেল অবস্থিত। যেমন- হোটেল সেন্টার পয়েন্ট, হোটেল সিল্ক রুট, হোটেল রেইনবো ইত্যাদি। প্রথম দিনে গেলে শিলংয়ে পৌঁছতে বেলা ৩টা বেজে যায়। তাই সেদিনটি নিজেরাই হেঁটে হেঁটে ঘোরাফেরা করতে পারেন।
আপনি যে গাড়িতে করে বর্ডার থেকে শিলংয়ে যাবেন সেই গাড়িটি যদি জিপ গাড়ি হয় তাহলে ৪ দিনের জন্য ভাড়া করে নিতে পারেন। এতে খরচ পড়বে ৮ হাজার রুপির মতো। দামাদামি করে একটু কমানো যেতে পারে। অর্থাৎ প্রথম দিন ডাউকি থেকে শিলং, দ্বিতীয় দিন শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি যাবেন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, তৃতীয় দিন লোকাল ভিজিট করবেন, চতুর্থ দিন শিলং থেকে আবার ডাউকি সীমান্তে ফিরে আসবেন।
দ্বিতীয় দিন আমরা চেরাপুঞ্জির উদ্দেশে রওনা দিলাম। পথে প্রথমে Elephant Falls দেখলাম। খুবই সুন্দর ঝরনা। এখানে খাসিয়াদের পোশাক পরে ছবি তোলা যায়।
শিলং থেকে চেরাপুঞ্জির দূরত্ব ৫৬ কিলোমিটার। এই রোদ এই বৃষ্টি- এই মেঘ মানে অসাধারণ একটা পরিবেশ। চেরাপুঞ্জিতে অবস্থিত রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল, পাড়াগাঁয়ে সুন্দর পরিবেশে বিশাল স্কুলটির অবস্থান। চেরাপুঞ্জির রাস্তাজুড়ে শুধু মেঘের খেলা। মনে হয় হাত বাড়ালেই মেঘ ধরা যায় এবং বিশাল বিশাল পাহাড় যেন হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এত সুন্দর চেরাপুঞ্জির MawkDok Valley View Point টা।
চেরাপুঞ্জিতে অবস্থিত ‘নয় খালি ফলস’ এটাও অনেক সুন্দর। এখানে ৯টা ঝরনার পাশাপাশি অবস্থান। এখানে আমরা থাকতেই মেঘ আমাদের সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলল। আবার কিছুক্ষণ পরই মেঘ চলে গেল। কী যে সুন্দর! মেঘের সঙ্গে যেন লুকোচুরি খেলা।
এ ছাড়া চেরাপুঞ্জিতে আরো রয়েছে Wah-KBa Falls, Eco Park, Mawshai Cave, 7 Sister Falls. Eco Park এবং 7 Sister Falls এই দুই জায়গা থেকে বাংলাদেশ দেখা যায়। অন্য দেশ থেকে যখন নিজের দেশ দেখা যায় তখন যে কত ভালো লাগে তা আর বলার নয়। এটাকেই বোধহয় বলে দেশপ্রেম।
পরের দিন সকালে আমরা গেলাম ‘শিলং পিক’-এ। এখান থেকে পুরো শিলং শহরটাকে দেখা যায়। এটা ইন্ডিয়ান বিমানবাহিনীর নিজস্ব এলাকায় অবস্থিত। শিলং শহরজুড়ে বিরাট একটা অংশ ইন্ডিয়ান বিমানবাহিনীর ঘাঁটি।
শিলংয়ে রয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি’। এখানে বসেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তার বিখ্যাত একটি উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’। এই কুঠিবাড়ির পাশে রয়েছে শিলংয়ের পার্লামেন্ট হাউস। শিলংয়ে একটি বিশাল মসজিদ আছে। মসজিদটা খুব সুন্দর এবং এর চারদিকে রয়েছে সবুজ রংয়ের গ্লাস। রাতে দূর থেকে আলো পড়লে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে মসজিদটি।
শিলং শহরের ৯০ ভাগ লোকই খ্রিস্টান। তাই এখানে ছোট-বড় অনেক চার্চ আছে। সবচেয়ে বড় চার্চ হলো DON BOSCO CATHEDRAL। এখান থেকে ‘শিলং পিক’ দেখা যায়। এই চার্চটি খুব সুন্দর এবং এর পাশেই রয়েছে শিলংয়ের বিখ্যাত সব স্কুল।
তারপর গেলাম WARD LAKE-এ। এখানে পৌঁছতেই শুরু হলো বৃষ্টি। লেকটা দেখতে খুব সুন্দর। এখানে বোটিং করা যায়। এখানে আমরা থাকতে থাকতে বৃষ্টি থেমে গেল। আবার সূর্য দেখা গেল। এটাই হচ্ছে শিলংয়ের বিচিত্র আবহাওয়া।
তারপর গেলাম উমিয়াম লেক বা বড় পানি লেকে। এই লেকে যাওয়ার পথটা যেমন সুন্দর, তেমনি লেকটাও অনেক মনোরম। এতই নিরিবিলি যে, মন খারাপ থাকলে ভালো হয়ে যায়। এই লেকের পানির গভীরতা ৩০০ ফুট। এখানে স্পিডবোটে করে ঘুরে বেড়াতে পারেন জনপ্রতি ২৫০ রুপিতে। খুবই ভালো লাগবে। কী অদ্ভুত রকমের রোমান্টিক অনুভূতি। এর পাশেই রয়েছে অর্কিড লেক-রিসোর্ট। এখানে দুপুরের খাবার সেরে নিতে পারেন। এছাড়া শিলংয়ে আরো রয়েছে গলফ কোর্স, স্টেট মিউজিয়াম, লেডি হায়দরাবাদি পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন ইত্যাদি।
পরদিন দেশে ফেরার পালা। সকাল ৯টায় আমরা রওনা হলাম। শহর ছেড়ে কিছুদূর আসতেই শুরু হলো মেঘের খেলা। রাস্তায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার ছিল খুবই এক্সপার্ট এবং বন্ধুসুলভ। আমাদের কিছুটা ভয় হচ্ছিল কিন্তু ড্রাইভার বলল এটাই হচ্ছে শিলংয়ের আবহাওয়ার চরিত্র। তাই ভয়ের কিছু নেই। আমরা পথে মাঝে মাঝে দুই-এক জায়গায় থেমে চা খেলাম এবং অনেক ছবি তুললাম। এভাবেই ৩ ঘণ্টার মধ্যে চলে এলাম ডাউকি সীমান্তে। তারপর আবার এখানে ইমিগ্রেশন শেষ করে বাংলাদেশ সীমান্তে চলে এলাম। ডাউকি সীমান্তে আসার পর মন যেন বলে, কী যেন ফেলে চলে যাচ্ছি। সেটা কী? মেঘ, বৃষ্টি? যা-ই হোক অসাধারণ একটা ভ্রমণ ছিল এটি। যেন সত্যিই আমরা মেঘের রাজ্যে বসবাস করে এলাম এই কটি দিন।