24/10/2024
সাংসারেক মান্দিদের ওয়ানগালাঃ
*****************************
ওয়ানগালা মূলত সাংসারেক মান্দিদের সৃষ্টি কর্তা ও দেবতা মিসি-সালজং এর প্রতি ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা ও অনুগত থাকার অনুষ্ঠান। যে অনুষ্ঠান প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে, সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে প্রচলন করেছিলো সাংসারেক মান্দিরা।
রংচুগালার চন্দ্র মাস (জা•সিয়া) শেষ হলে দিনক্ষণ দেখে গ্রামবাসীরা সবাই মিলে সাধারনত ওয়ান্না - ওয়ানগালার আয়োজনের দিন তারিখ নির্ধারণ করতো, গ্রাম প্রধানের (সং নকমা) বাড়িতে মূল ওয়ান্না- ওয়ানগালার আয়োজন হতো, যা ৩-৫-৭ দিন ধরে উৎযাপনে মেতে উঠতো গ্রামবাসীরা সামর্থ্য অনুযায়ী। এছাড়াও গ্রামের যে যে বাড়িতে রাং-সিল (বিশেষ এক খাসার তৈরি পাত্র) ছিলো সে বাড়ি গুলোতেও ওয়ানকেল থাপ্পা করতো সাংসারেক মান্দিরা, নিয়ম ছিলো ওয়ান্না- ওয়ানগালা ছাড়া এসব রাং-সিল গুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতেও হাত দেওয়া যাবেনা।
সাংসারেক মান্দিরা ওয়ান্না- ওয়ানগালা কেনো করতো, কি উদ্দেশ্যে করতো, কবে থেকে করতো, এর ইতিহাস সাংসারেক মান্দিদের জীবন ও জীবিকার ইতিহাসের সাথে জড়িত। সাংসারেক মা•আম্বির (অলিখিত ধর্মীয় গ্রন্থ) ওরাল হিস্ট্রি মতে সুপ্রাচীন কাল থেকেই সাংসারেক মান্দিরা কৃষিকাজ করে জীবন যাপন করতো। প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোন এক সময় স্বয়ং দেবতা মিসি-সালজং রাই বিমা রান্দি মিচিক এর (বিধবা রাই বিমা) ঘরে উপস্থিত হোন এবং এক রাত আশ্রয় চান, রাই বিমা রান্দি মিচিক ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র তিনি নিজেই অতি খাদ্যকষ্টে দিনাতিপাত করতেন। রাই বিমা রান্দি মিচিক জানতেননা যে ইনি স্বয়ং দেবতা মিসি-সালজং, তাই তিনি তার বাড়িতে আশ্রয় চাওয়া লোককে বললেন আমিতো অত্যন্ত দরিদ্র তুমাকে আমার বাড়িতে থাকতে দেওয়ার মতো খেতে দেওয়ার মতো আমার কাছে কিছু নেই। তখন দেবতা মিসি-সালজং বললেন তুমার দক•মান্দার আচলে যেটা বেধে রেখেছ সেটা পুরিয়ে ধোয়া দিলেই হয়ে যাবে আমার, রাই বিমা রান্দি মিচিকও তাই করলেন। আথিতেয়তায় খুশি হয়ে দেবতা মিসি-সালজং রাই বিমা রান্দি মিচিক কে ধানের মা মি-মান্দি উপহার দেন, এবং প্রতি বছর তার স্মরণে ওয়ান্না-ওয়ানগালা আয়োজন করতে বলেন। সেই থেকেই সাংসারেক মান্দিরা যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যতা নিয়ে ওয়ান্না- ওয়ানগালা আয়োজন, উৎযাপন ও পালন করে আসছে। দেবতা মিসি-সালজং রাই বিমা রান্দি মিচিক এর ঘরে ধানের মা মি•মান্দিকে জন্ম দেবার আগে পৃথিবীতে কোন ধানজাত শষ্য ছিলোনা।
বিশেষ উল্লেখ্য যে, সাংসারেক মান্দিরা ওয়ান্না- ওয়ানগালার আগে কিছু নিয়ম ও বিধিনিষেধ মেনে জীবন ধারণ করতো, যা বিগত বছরের ওয়ান্না- ওয়ানগালার পর নতুন বছরের কৃষিকার্য থেকে শুরু হতো তাই সুনির্দিষ্ট বিধিনিষেধ আরোপিত কাজগুলো করা থেকে বিরত থাকত সাংসারেক মান্দিরা। ওয়ান্না- ওয়ানগালার আগে যেসব কার্যে বিধিনিষেধ ছিলো সেগুলোকে আসি-নামজা (Asi-Namja) বলতো, যেমন- মুখে শিষ দেয়া, তালি দেয়া, হাতের তালুতে গাছের পাতা রেখে বাড়ি দিয়ে পটকা ফুটানোর মতো আওয়াজ করা, আহা-হু-আ ( মুখে উচ্ছস্বরে আহ-হু-হু ধ্বনি করা।
এছাড়াও সাংসারেক মান্দিরা ওয়ান্না- ওয়ানগালার আগে উৎপাদিত নতুন শস্যাদির অনেক কিছুই খেতোনা। তারা বিশ্বাস করতো এবং মনে প্রানে ধারণ করতো যে, সৃষ্টি কর্তা - দেবতাকে উৎসর্গঃ না করে উৎপাদিত শস্যাদির কিছুই খেতে হয়না, এতে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও অমঙ্গল নেমে আসবে তাদের জীবনে। ওয়ান্না- ওয়ানগালার আগে জুমে ধান চাষের সাথে চাষকৃত ভুট্টাজাত শস্য (মিকপ/মিগারু) খেতে হা•বা চূড়া আমুয়া (কৃত্য) করতো। নতুন উৎপাদিত ধান, কচু, আদা, হলুদ, চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়াসহ আরও বেশ কিছু খাদ্যজাত শস্য ওয়ান্না- ওয়ানগালা সম্পন্ন না করা পর্যন্ত সাংসারেক মান্দিরা খেতোনা। উল্লেখ্য যে উৎপাদিত নতুন ধানের চিড়া ও চাল ভেজে খাওয়া যেতো, ওয়ান্না- ওয়ানগালার না করা পর্যন্ত ভাত রেধে খেতোনা সাংসারেক মান্দিরা নতুন ধানের চাল দিয়ে। ওয়ান্না- ওয়ানগালার কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও ক্রমধারা আছে যেগুলো মেনেই হাজার বছর ধরে সাংসারেক মান্দিরা ওয়ান্না- ওয়ানগালা পালন করে আসছে।
ওয়ান্না- ওয়ানগালা সাংসারেক মান্দিদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার অনুষ্ঠান থেকে ধীরে ধীরে হয়ে উঠলো প্রানের উৎসব। এ অনুষ্ঠান কে ঘিরে সাংসারেক মান্দিরা প্রেম-প্রনয়, জীবন-জীবিকা, প্রকৃতির সাথে তাদের জীবনাচরণ নিয়ে বিভিন্ন লোকগান, পালাগান, লোকসাহিত্য, দল-নৃত্য, ইতিহাস, ঐতিহ্যের মিশেলে পরিনত হলো প্রধান ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উৎসবে।
ওয়ান্না- ওয়ানগালার দিন যে সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও ক্রমধারা অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ ও ধারাবাহিক আমুয়া-ক্রিতা সমূহ সম্পন্ন করা হয়-
১ম দিনের কার্য-
১। অনুষ্ঠানের শুরুতে খ্রাম/বলথং দু•'থাদা, নাগ্রা না চু রুদিতা। ("খ্রাম-বলথং" ঢোল বিশেষ বাদ্যযন্ত্রের জন্য ছোট মুরগির বাচ্ছা উৎসর্গ করা, "নাগ্রা" তবলার ন্যায় আকৃতির বিশেষ ঢোল এর জন্য চু উৎসর্গ করা, আর নতুন হলে দু•থাতা)
২। সূর্যাস্তের পরপরই রাকগাসি আমুয়া সাসাত সোয়া। ( "রাকগাসি" এক অদৃশ্য অপদেবতা যিনি মানুষের রক্ত ও আবাদি ফসলাদি শোষণ করেন, এতে করে মানুষের স্বাস্থ্য ও জমির ফসলে ভালো ফলন হয়না। অপদেবতা থেকে রক্ষা পেতে বাড়ি ভিটার বাহিরে জমির আইলে বিশেষ এক কৃত্য করা হয়, ধূপ পুরানো হয়)
৩। রংদিক-না দু•থাতদা ( চাউল রাখার হাড়ির জন্য মুরগী উৎসর্গ করা ও বিশেষ কৃত্য সম্পন্ন করা )।
থা•মা, থা•তুরাক, থারিং, হি'চিং, অলদি, আকখারু-বাঙগি রংদক, মিগারু ছন্দক-না, আত্তি, গিৎচি, রোয়া-না রুদিতা/রুগালা। আপফা মিসি, আচ্চু সালজং কে ওয়ান্না- ওয়ানগালায় আহবান করা।
৪। ওয়ানছি গা•দুবংআ/ ওয়ানছি থকগা- আতপ চালের গুড়ো চু (রাইশ ওয়াইন) দিয়ে মিক্স করে হাতের আঙুলের ছাপ দেওয়া। অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র, আগত মানুষ ও বাড়ির বিভিন্ন জিনিসপত্র সহ ঘরের বিভিন্ন জাগায় ওয়ানছি থকগা করা হয়। বিঃদ্রঃ যে বাড়িতে অনুষ্ঠানটি আয়োজন হবে সে বাড়ির মানুষ ওয়ানচি তকগা করতে পারবেনা।)
৫। খামাল, মাদ্দক, চ্রা•দের গ্রিকগা। (পুরোহিত, পুরোহিতের সহকারী, উপস্থিত অনান্য বিজ্ঞজনদের যুদ্ধনৃত্য প্রদর্শন করা)
২য় দিন
৬। জলআন্না-দাম্বি ছিন্না। (আপফা মিসি — আচ্চু সালজংকে আমন্ত্রণ জানানো ও নতুন ফসল উৎসর্গ করা)
৭। দু•রাসং নিয়া। (মুরগির নাড়ি দেখা, সাংসারেক মান্দিদের বিশ্বাস দেবতার নামে উৎসর্গ কৃত মুরগির নাড়িতে যদি মল/রক্ত দেখা দেয় তাহলে অশুভ বা বছর ভালো যাবেনা)
৮। গ্রিকা, গুরি রু•আ, আজিয়া, সেরেজিং, ছাম্বেল মেসা•আ। ("GRIKGA" যুদ্ধনৃত্য, "GURI-RUA"দেবতার উদ্দেশ্যে বিশেষ নাচ প্রদর্শন, "AJIA" মান্দি জনগোষ্ঠীর বিশেষ লোকগীতি, "SEREJING" বিশেষ পালা গান, "CHAMBEL MESA•A" আনন্দ দেয়ার উদ্দেশ্যে বিশেষ বানর নাচ, এবং মান্দিদের নিজস্ব বিভিন্ন খেলাধূলা সমূহ প্রদর্শিত হয়)
৩য় থেকে ৭ম দিন / শেষ দিন
৯। বিসিরি ওয়াত্তা। (পৃথিবীর সকল প্রান- প্রকৃতির ও গ্রামবাসীর সবার মংগল কামনায় কৃত্য করা)
১০। কাত্থি মাংগল গাল্লা- সাল অল্লাখিয়া। (খ্রাম, দামা, রাং, আদুরি, আম্বেংগি বাজানোর জন্য সকল বাদ্যযন্ত্রের কাঠি গুলোকে আবার আগামী বছরের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় দেওয়া, এবং কামাল মাদ্দক এর বাড়ি ফিরার পূর্বে সূর্যের কাছে বিশেষ প্রার্থনা )
এভাবেই সাংসারেক মান্দিদের প্রধান ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উৎসব ওয়ান্না- ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
(সংগৃহিত)