02/06/2022
পাহাড় = মাদকতা
অনেক বছর আগের কথা, আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। কোন এক পুকুর পাড় ধরে আমি আর আমার এক বন্ধু হেটে যাচ্ছিলাম। আমি তখন সাঁতার কাটতে জানতাম না। এই আফসোসটা আমার ছোটবেলা থেকেই। তো আমি আমার বন্ধুকে বললাম, "যদি এই পুকুরটা পাড়ি দিতে পারতাম তাহলে মনে হতো যেন এভারেস্টটা জয় করে ফেলেছি!" পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একজন মেয়ে তখন বলেছিল, "পারবে একদিন!" তারপর আর কি! ঐ মেয়ের কথার জ্বালানি হ্রদয়ে ঢেলে এখন পর্যন্ত বহুবার সাঁতার শেখার জন্য পুকুরে, খালে ও নদীতে নেমেছি কিন্ত সাঁতারও শেখা হয় নি আর এভারেস্টতো আরও দূর!
এখন পর্যন্ত সাঁতার শেখা বা এভারেস্ট জয় কোনটাই করতে না পারলেও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অবস্থিত কিছু পাহাড় জয় করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। পাহাড় জয়ে এক ধরনের মাদকতা আছে। যার মধ্যে এই মাদকতার অভাব আছে সে পাহাড় জয়ের আনন্দ থেকে বঞ্চিত।
গত বছর Vanguards of travelling এর সম্মানিত এডমিনদের সাথে গিয়েছিলাম চন্দ্রনাথ পাহাড় জয় করতে। হিউম্যান সাইকোলজিতে একটা কথা আছে, আর তা হলো নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। আমার চন্দ্রনাথ বিজয়ের পূর্বে অন্য যারা চন্দ্রনাথ জয় করেছিলেন তাদের অধিকাংশ লোকই একটা কমন কথা বলেছিল, "চন্দ্রনাথে দেখার কিছু নাই, শুধু কষ্ট আর কষ্ট!" আগেই বলেছি পাহাড় জয়ে মাদকতা আছে। আর আমি তাতে আসক্ত। মানুষের মুখে যতই চন্দ্রনাথ সম্পর্কে নেগেটিভ রিভিউ পাচ্ছিলাম ততই চন্দ্রনাথ জয়ের নেশা আমার মধ্যে প্রবল হচ্ছিল।
চন্দ্রনাথ পাহাড় হিমালয় হতে বিচ্ছিন্ন হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলীয় অংশ। এই পাহাড়টি হিমালয়ের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক ঘুরে ভারতের আসাম এবং ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্য দিয়ে ফেনী নদী পার হয়ে চট্টগ্রামের সঙ্গে মিশেছে। চট্টগ্রাম অংশে ফেনী নদী থেকে চট্টগ্রাম শহর পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৭০ কিলোমিটার। সীতাকুণ্ড শহরের পূর্বে অবস্থিত চন্দ্রনাথ শৃঙ্গ প্রায় ১০২০ফুট (প্রায়) অথবা (৩১০ মিটার) উঁচু এবং চট্টগ্রাম জেলার সর্বোচ্চ স্থান।
আমরা পাঁচজনের একটা টিম ভোর বেলায় রওনা হই চন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে। সকাল ১০ টার দিকে প্রথমে যাই মহামায়া লেকে। ঐখানে কিছু সময় অবস্থানের পর রওনা হই চন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে। চন্দ্রনাথ যখন পৌঁছাই তখন সূর্য মাথার উপরে। শীতের শুরু ছিল বলে খুব একটা কষ্ট অনুভূত হয় নি। চন্দ্রনাথের মূল ফটকের সামনে পৌঁছনোর পরপরই দেখা হয় একজন সাধু টাইপ বয়স্ক লোকের সঙ্গে। আমরা সবাই তার সাথে কিছুক্ষণ আলাপচারিতা ও তার পরিবেশন করা গান শুনে পাহাড় জয়ে রওনা হই। যতই উপরের দিকে যাচ্ছিলাম ততই চন্দ্রনাথ জয়ের আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হচ্ছিল। আপনারা যারা যেতে চান তারা উপরে উঠার সময় কিছুক্ষণ পরপর বিরতি অবশ্যই দিবেন। এতে শক্তি সঞ্চার হবে। তাছাড়া পাহাড়ের উপরে অবস্থিত দোকানদারদের সাথেও আলাপ চারিতায় মেতে উঠবেন। আমরা যখন উপরের দিকে উঠছিলাম এর কিছুক্ষণ পর একটি সনাতন ধর্মানুলম্বী পরিবারের সাথে আমাদের দেখা হয়েছিল। উনারা উনাদের পরিবারের সাথে চন্দ্রনাথ মন্দিরে প্রার্থনার উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। একজন মা কতটা কষ্ট করে তার সন্তানের জন্য তা ঐদিন ঐ পরিবারের ছেলের বৌকে দেখে আবারও বুঝেছিলাম। ছেলের বৌটি তার নিজের ২ বছরের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এতগুলো খাড়া খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলেন। যারা আগে চন্দ্রনাথে গিয়েছেন আপনারা অবশ্যই জানেন যে এই পাহাড়ে ১ বোতল পানি নিয়ে উপরে উঠাই কত কষ্টের! অনেক কষ্টে বৌ, শাশুড়ি ও তার নাতি-নাতনিরা চন্দ্রনাথ মন্দিরের আগের মন্দির পর্যন্ত পৌঁছে। পরে বেলা শেষ হয়ে গেলে তাদের সমস্যা হতে পারে ভেবে তারা ঐখান থেকেই পুনরায় নিচে চলে যান। আমরা যখন উপরে পৌঁছাই তখন সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। তার উপর আবার আকাশ মেঘলা। বলে বুঝাতে পারব না চন্দ্রনাথের উপরে উঠার পর কি একটা অদৃশ্য শান্তি অনুভূত হচ্ছিল। আকাশ আর মেঘের চমৎকার মিলনমেলা। চন্দ্রনাথ জয় করতে যাচ্ছি আর সাথে মাতৃভূমির পতাকা থাকবে না তাই কি হয়! সাথে থাকা এন্ড্রয়েড ফোনে লো লাইটে ভালো ছবি আসছিল না। পরে নাটোর থেকে আসা একঝাঁক তরুণের সাথে উপরে পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে থাকা ফাহিম ফয়সাল প্রীতম ভাইয়ের আইফোনে এই ছবিটি তুলি। ভাই খুব ভালো মনের মানুষ। ছবিটার জন্য অনেক প্যারা দিছি কিন্ত ভাই মাইন্ড করেন নাই। ছবি তোলা শেষে কিছুক্ষণ উপরের মুগ্ধতা উপভোগের পর সূর্যের সাথে সাথে আমরাও পাহাড়ের অন্য পথ দিয়ে নিচে নেমে আসি। ধন্যবাদ আমার সফরসঙ্গীদের, মেহেদী ভাই, মহিউদ্দিন ভাই, আল-আমিন মামা এবং সাখাওয়াত হোসেন ভাইকে। বলে রাখা ভালো যারা বলেছিলেন যে চন্দ্রনাথে দেখার কিছু নাই আমি আপনাদের সাথে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করছি। পাহাড়ে উঠতে উঠতে সাধু টাইপ লোকের সাথে পরিচয়, পাহাড়ি দোকানে বসে শসা ও পানি পান, কিংবা ছোট ছোট ঐ বাচ্চাদের জন্য মায়ের মমতা, পাখির উড়ে চলা, নির্মল বাতাস, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনা স্থান, আকাশের বুকে মেঘের মেলা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের দান এত বড় পাহাড় যখন আপনাকে টানবে না তখন নিজেকে নিয়ে একটু ভাবতে পারেন। একটা বিশেষ নিয়তে অনেকদিন পাহাড়ে যাই না! ইনশাআল্লাহ্, নিয়তটা পূরণ হলেই আবার যাব পাহাড়ে। কারণ "জোয়ান কালে উঁচা, বুড়া কালে নিচা" আমি এই নীতিতে বিশ্বাস করি।
ধন্যবাদ এতক্ষণ এই প্যাচাল পড়ার জন্য। শুভকামনা রইল।
(তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া)
শুভেচ্ছান্তে,
ঋ