26/12/2016
বাংলাদেশের মধ্যে সুন্দরবনে ঘুরতেই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি খরচ হয়। আজ আপনাদের চুপি চুপি একেবারে কম খরচে সুন্দরবনে ঘুরে আসার পথ বলে দেব। এই পথ এমনই সোজা যে অন্যদের যেখানে তিন থেকে পাঁচ দিন লাগে সুন্দরবনে ঘুরে আসতে, সেখানে আপনারা মাত্র এক দিনেই সুন্দরবন দেখে আসতে পারবেন। এই ঘোরা কিন্তু যেনতেন ঘোরা নয়, এক ঘোরাতেই বানর, হরিণ, ডলফিন আর কুমির দেখে আসতে পারবেন। কপাল ভালো থাকলে শূকর আর বনমোরগও চোখে পড়বে। আর কপাল খুব বেশি খারাপ হলে বাঘ মামার সামনে পড়ে যেতে পারেন! মোদ্দা কথা, এক দিনে দেখে আসতে পারবেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন, সুন্দরবনকে।
চলুন দেখি, কীভাবে এক দিনেই সুন্দরবন দেখে আসা যায়। কাছের দু-চারজন বন্ধু নিয়ে ভোর ছয়টা-সাতটার দিকে ঢাকার সায়েদাবাদ বাস কাউন্টারে এসে সুন্দরবন বা পর্যটক বাসে উঠে মংলায় চলে আসুন। পদ্মা নদী আর ইলিশের গন্ধে মন উথালপাতাল করা মাওয়া ঘাট পেরিয়ে এই বাস আপনাদের সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায় মংলায় পশুর নদের পাড়ে নামিয়ে দেবে। স্পিডবোটে পদ্মা নদী পার হলে সময় আরও এক ঘণ্টা কমে যাবে। মংলায় নেমেই একটা নৌকা ভাড়া করে ফেলুন। ৭০০-৮০০ টাকায় ভাড়া করা এই নৌকা আপনাদের করমজলে ঘুরিয়ে বিকেলে আবার মংলা ঘাটে নামিয়ে দেবে।
পশুর নদী থেকেই মূলত শুরু হবে সুন্দরবন যাত্রা, নৌকায় ওঠার পরপরই চোখের সামনে ফুটে উঠবে সুন্দরবনের গাছের সারি। তরতর করে নৌকা এগোবে পশ্চিম দিকে, নৌকার ছাদে বসার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে। সেখান থেকেই খুব ভালোমতো নদীতে খেয়াল রাখলে দেখা যাবে, কিছু ডলফিন একটু পর পর ভেসে উঠছে আবার ডুব দিচ্ছে। এগুলোকে বলা হয় বটলনোজ ডলফিন বা ইরাবতী ডলফিন। নৌকা ৪০ মিনিট চলার পর সোজা এসে থামবে করমজলের ঘাটে। করমজলে যাওয়ার সময় জোয়ার-ভাটার বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। ভাটার সময় করমজলে গেলে তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে।
করমজল মূলত হরিণ ও কুমির প্রজনন কেন্দ্র। করমজলে নেমেই বনে ঢোকার টিকিট কাটতে হবে, জনপ্রতি ২৩ টাকা করে টিকিট কেটে বনে পা ফেললেই গা ছমছম করে উঠবে শিহরণে। নিমেষেই চোখ চলে যাবে গাছের আড়ালে, গোলপাতার ফাঁকে, হেতাল বনের ঝোপে। কিছু একটা নড়তে দেখলেই মনে হবে, এই বুঝি বিরাট গর্জন করে ছুটে আসছে বনের রাজা, বেঙ্গল টাইগার। করমজলে ঢুকতেই চোখে পড়বে সুন্দরবনের বিশাল একটা থ্রিডি ম্যাপ। এখানে খুব সহজেই নিজেদের অবস্থান দেখা যাবে। এরপর সোজা হয়ে দাঁড়ালেই দুটো রাস্তা আসবে সামনে-একটা এঁকেবেঁকে বাঁ দিকে হারিয়ে গেছে, আরেকটা ডানে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। ডানের রাস্তা ধরে কিছুদূর গেলেই একটা বিশাল খাঁচা দেখা যাবে, এখানে হরিণের বসবাস। মূলত এটা হরিণ প্রজনন কেন্দ্র, ছোট, বড়, মাঝারি-সব আকৃতির হরিণ ছুটে আসবে আপনাদের দেখে। মানুষে তাদের কোনো ভয় নেই, ঘাস আর কচি পাতা ছিঁড়ে দিলে খুব আয়েশ করে হাত থেকে নিয়ে খেতে শুরু করবে। এরপর রয়েছে কুমিরের আস্তানা। এখানে এক মাস বয়সী কুমির থেকে শুরু করে এক বছর বয়সী কুমির রয়েছে। দেখলে অবাক হয়ে যেতে হবে যে এই বিশালদেহী কুমিরের সাইজ একসময় থাকে টিকটিকির মতো!
কুমির দেখা শেষ করে ঢুকতে হবে বাঁ পাশের ট্রেইলে। একে বলা হয় ‘মাংকি ট্রেইল’। সুন্দরবনের মাঝখান দিয়ে বানানো কাঠের এক রাস্তা ধরে কিছুদূর হাঁটলেই চোখে পড়বে ৩০ থেকে ৪০টি বানরের এক বিশাল দল। বছরের যেকোনো সময়ে গেলেই এদের একই জায়গায় পাওয়া যাবে। এই দলে বাচ্চা থেকে শুরু করে বিশালদেহী সব বয়সের বানর রয়েছে। মানুষ দেখলেই কোথায় ভয় পেয়ে চলে যাবে তা না, বুক চিতিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে। তাদের মধ্যে বয়সে বড় নেতাটি, বন বিভাগ তার নাম দিয়েছে ‘ভোলা’-এবার সে পথ আগলে দাঁড়িয়েছে, কোনোভাবেই যেতে দেবে না। আশপাশের সব বানর একসঙ্গে চেঁচামেচি করছে, সে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি! এই সময় যদি কেউ ভয় পেয়ে দৌড় দেয়, তাহলেই শেষ। বানরের দল খামচে একাকার করে দেবে! হাতে কোমল পানীয়র একটা আধখাওয়া বোতল থাকলে সেদিকেই থাকবে নেতার নজর। কালবিলম্ব না করে বোতল বাড়িয়ে দিলেই সে খপ করে ধরে ফেলবে, এরপর চোখের নিমেষে ঢকঢক করে পুরো বোতল সাবাড় করে দেবে! তাজ্জব হয়ে দেখবেন, এবার সে পথ ছেড়ে দিয়েছে। ভাবখানা এমন যে তোমাদের এই বনে ট্যাক্স দেওয়া হয়ে গেছে, এবার তোমরা ঘুরে আসতে পারো। গোটা তিরিশেক বানরের মাঝখান দিয়ে আর কোনো ঝামেলা ছাড়াই বাকি রাস্তা পার হয়ে যাওয়া যাবে।
রাস্তার শেষ মাথায় রয়েছে একটা ওয়াচ টাওয়ার, আর কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা উঠে গেলেন একেবারে মাথায়। সেখান থেকে পুরো করমজল একবারে দেখা যায়। এবার একটা পরামর্শ, এই বানরের দলের সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই খারাপ ব্যবহার করবেন না। আপনি একটু রাগ দেখালেই এরা পুরো দল নিয়ে আপনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, তখন আসলেই বাঁচার আর কোনো পথ থাকবে না।