27/09/2019
বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন
ভ্রমনপিপাসু বাঙালীদের মন সর্বদাই এক বিন্দু থেকে অপর বিন্দুতে ছুটে বেড়ায়, কিন্তু পৃথিবীর এমন কোন বিন্দু নেই যা বাঙালীর ভ্রমন ক্ষুধা সম্পূর্ণ ভাবে মেটাতে পারে। সমগ্র ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর বিখ্যাত পর্যটন বিন্দুতে খোঁজ করলে জাতির প্রতিনিধি হিসাবে অন্তত একজন বাঙালীকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
যাই হোক, এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। এবারের আমাদের গন্তব্য ছিল এই বিন্দু। না না আর কোন ভনিতা করছি না, সত্যি সত্যিই এ গ্রামের নাম বিন্দু। ভারতের শেষ গ্রাম বা শেষ বিন্দু হল এই বিন্দু। কি ভাবছেন অনেক দূর? আরে না না খুবই কাছে আমার আপনার সবার চেনা অপরূপা ডুয়ার্সের কালিম্পং জেলার অন্তর্গত এক সুন্দর গ্রাম বিন্দু। বিশেষ দুর্গম কিছু নয়, কলকাতা থেকে ট্রেন যোগে চলে আসুন নিউ মাল জংশন। প্রসঙ্গত বলে রাখি নিউ জলপাইগুড়ি জংশন থেকে নিউ মাল জংশন পর্যন্ত যাত্রাপথ বোধহয় সারাজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সংক্ষেপে এটুকু বলতে পারি, ইট কাঠ লোহা দেখতে অভ্যস্ত চোখ জোরা শিলিগুড়ি জং পেরোতেই হঠাৎ করে এক হীরকখনির সন্ধান পাবে, নীল পাহাড়, সবুজ ঘন জঙ্গল, সুড়ঙ্গ (টানেল) ইত্যাদি তো আছেই, এছাড়া মাঝে মাঝেই জঙ্গল থেকে পক্ষিরাজ পেখম মেলে আপনার মনপ্রান জুড়িয়ে দিতে পারে। এই কারনেই বোধ হয় ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ১০টি রেল পথের মধ্যে এটি তার স্থান করে নিয়েছে।যাইহোক, নিউ মাল জং থেকে বিন্দুর দূরত্ব ৫০ কিমি। গাড়ি ভাড়া করে চলে যেতে পারেন। তবে এ যাত্রাপথের সৌন্দর্য নিশ্চিত ভাবে আপনার রেল যাত্রার সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দেবে।
মাল থেকে চালসা পেরিয়ে কিছু দূর গেলেই পড়বে খুনিয়া মোড়, এই মোড় থেকে বাঁ দিকে ঢুকে চাপরামারি অভয়ারণ্যের বুক চিরে পিচ কালো রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই বুঝবেন আপনি পৌঁছে গেছেন সবুজের সাম্রাজ্যে। দুপাশে সারি দিয়ে রবার গাছ আপনাকে স্বাগত জানাবে। এরপর সমতল শেষ হয়ে ধীরে ধীরে শুরু হবে পাহাড়ি পথ। কুমানি, গৈরিবাস, নক্সাল মোড় হয়ে পাহাড়ি পাকদণ্ডী বেয়ে ঝালং, সেখান থেকে বিন্দু ১০ কিমি দূর। যাইহোক, এতক্ষনে হয় তো ভাবছেন বিন্দু তো হল কিন্তু সিন্ধু দর্শন্, তা কীভাবে সম্ভব? উত্তরবঙ্গে সিন্ধু মানে জলঢাকা নদী, যা যাত্রা পথের সিংহভাগই আপনার সঙ্গী হয়ে থাকবে। এক এক পাহাড়ি বাঁকে দর্শন পাবেন সিন্ধু রূপী জলঢাকার এক এক অপূর্ব নিদর্শন। এছাড়াও বর্ষার দিনে এই যাত্রাপথে প্রায়ই দেখবেন পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণা স্রোত রাস্তা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কয়েকশো ফুট নিচে গিয়ে জলঢাকায় মিশে তাকে সিন্ধুর রূপ দিচ্ছে। এই ভাবেই প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে করতে পৌঁছে যাবেন শেষ গন্তব্য বিন্দু। এখানে বর্ষার চঞ্চল জলঢাকার অবিরাম উচ্ছাস আপনাকে সিন্ধু দর্শন অবশ্যই করাবে। সমগ্র পথে আপনি যখন থেকে জলঢাকার সাক্ষাৎ পেয়েছেন প্রায় তখন থেকেই আপনি আমাদের প্রতিবেশী এক বন্ধু রাষ্ট্রেরও দর্শন পেয়ে চলেছেন। জলঢাকার এপারে ভারতের শেষ গ্রাম বিন্দু আর নদীর ওপারে ভুটান রাষ্ট্র। পায়ে পায়ে দেখে নিন বিন্দু ড্যাম, নদীর ওপর ব্রিজটি দুই দেশের সংযোগ রক্ষা করেছে। এখানে থাকার জন্য কিছু বেসরকারি হোমষ্টে চোখে পরে। সব মিলিয়ে বর্ষার জলঢাকা আর রৌদ্র মেঘের পাহাড়ি মোহময়ী বিন্দু আপনাকে মুগ্ধ করবেই। আর একটা কথা প্রতি বৃহস্পতিবার বিন্দুর সাপ্তাহিক হাট বসে, ওই দিন যেতে পারলে পছন্দসই কেনাকাটাও করে নিতে পারেন।
সবশেষে আমাদের কিছুটা অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে ভাগ করে নিই, আমরা শিলিগুড়ি থেকে ট্রেন যোগে চালসা গিয়ে সেখান থেকে শেয়ার গাড়িতে (ভাড়া ৮০ টাকা) বিন্দু পৌছাই। প্রাকৃতিক শোভারস আস্বাদনের পর বৃহস্পতিবার বিন্দুর হাট। ঘোরাঘুরি করে নিচে নামার গাড়ি (যেহেতু আমরা কোন গাড়ি রিজার্ভ করিনি) আর পেয়ে উঠিনি। কি আর করা অজতা ১১ নম্বর গাড়ির ভরসায় বেশ কিছুটা পথ নেমে আসা হল। পথে বেশ কিছু সহৃদয় ব্যক্তির সাহায্যে কিছু পথ গাড়িতে আবার কিছু পথ হেঁটে এইভাবেই ছোট ছোট পায়ে একসময় চাঁদের পাহাড় থুরি খুনিয়া মোড় পৌঁছে গেলাম। এইভাবে আসার অভিজ্ঞতাও কিছু কম হয় নি, বিন্দুতে দেখেছি দুই দেশের মধ্যে মানব নির্মিত সংযোগ রক্ষাকারী সেতু কিন্তু এবার দেখলাম প্রকৃতি সৃষ্ট এক উল্টানো কড়াই আকৃতির সাত রঙা সেতু দুই দেশকে যুক্ত করেছে, ওই যাকে আমরা রামধনু বলে চিনি আর কি! সে এক অনবদ্য দৃশ্য। ভাল বৃষ্টি হওয়ায় হঠাৎ করে পাহাড়ি ঝর্ণার জলও প্রচণ্ড বেড়ে গেল, চোখের সামনে হড়কা বানের ক্ষুদ্র সংস্করণ দেখতে পেলাম। যাইহোক বিকল্প সেতু থাকায় কোন বিপদে পড়তে হয়নি। এছাড়া বহুদিন বাদে সুন্দর করে বৃষ্টিতে ভেজাও হয়েছে। চাপড়ামারির জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বৃষ্টিতে বাকি পথটুকু আমরা দুচাকার গাড়িতে সওয়ারী হয়েই শেষ করি এবং খুনিয়া মোড় পৌঁছে যাই। এরপর ওখান থেকে শিলিগুড়ি (প্রায় ৭৫ কিমি) যেতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। সবমিলিয়ে বর্ষার এক রোমাঞ্চকর ভ্রমণের সাক্ষী হতে ঘুরে আসতেই পারেন ভারতের শেষ গ্রাম বিন্দু।