21/06/2022
“বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু। “– কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমরা বাঙালি, ভ্রমণ আমাদের ধর্ম। যখন অন্তরের ডাক আসে আমরা যেদিকে দুচোখ যায় সেই দিকে ছুট লাগাই। কখনো কোনো কিছু পরিকল্পনা না করে, আবার কখনো সব দিক গুছিয়ে সাজিয়ে পরিকল্পনা করে। আমরা যারা ঘুরতে ভালোবাসি তারা সবসময় চাই এই রাজ্য ছাড়িয়ে দূর কোনো জায়গায় যেতে। কিন্তু আমাদের প্রিয় বাংলা তেই কত যে ঘোরার স্থান তা নিজে গিয়ে চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না। তেমনই অভিজ্ঞতা আজ ভাগ করে নেব সকলের সাথে
গত বুধবার(৮ই জুন, ২০২২) এরকমই হঠাত করে আমার কন্যা বায়না ধরলো “আপা (পাপা ডাক টা অপভ্রংশে একদম ছোটো থেকেই আপা হয়ে গেছে) কোথাও নিয়ে চলো এই গরমের ছুটি তে, সব বন্ধুরা ঘুরতে যাচ্ছে।“ বছরে আমাদের 2 টো ট্যুর বাঁধা থাকে- গরমের ছুটি ও শীতের ছুটি তে। কিন্তু এবারে কিছু প্রফেশনাল কমিটমেন্ট এর জন্য এই ছুটি তে দূরে কোথাও প্ল্যান করতে পারিনি। তাও বাঙালি হয়ে গরমের ছুটি তে কোথাও যাবো না এ কখনো হয় – তাহলে জাত যাবে যে। অগত্যা কন্যার হুকুমে আমরা আলোচনা করে ঠিক করলাম বিষ্ণুপুর ও মুকুটমণিপুর ঘুরতে যাবো। তবে কন্যার মাতাশ্রী একটু কিন্তু কিন্তু করছিলেন এই গরমে ওখানে যাওয়া ঠিক হবে কিনা। আমি বললাম বেরিয়ে তো পড়ি তারপর দেখা যাবে।
শীতের ছুটি তে আমরা শীতের জায়গায় যাই, এবারে গরমের ছুটি তে গরমের জায়গায় যাই না, কেমন লাগে দেখি।
গত ডিসেম্বরে আমরা দার্জিলিং কার্শিয়াং গিয়েছিলাম। কিন্তু ফেসবুক গ্রুপ গুলো তে এত পোস্ট তাই আমি আর সাহস করিনি আমরা টা শেয়ার করার।
যাই হোক সেই সন্ধ্যায় মুকুটমণিপুর আর বিষ্ণুপুর হোটেল খোঁজা শুরু। ১0 তারিখ মুকুটমণিপুর, ১১ তারিখ বিষ্ণুপুর আর ১২ তারিখ কোলকাতা ফেরা। মুকুটমণিপুরে Peerless রিসোর্ট আছে কিন্তু দেখলাম অত্যাধিক বাজেট। সোনাঝুড়ি ফুল বুক। তাই দেখে শুনে আরণ্যক রিসোর্ট ঠিক করলাম মুকুটমণিপুরে আর WBTDCL – Bishnupur Tourist Lodge বুক করলাম online এ।
১০ই জুন ভোর ৪ টে ঠিক করলাম বাড়ি থেকে বের হবো, তাই আগের দিন ই আমার চার পায় সঙ্গী করে ready করে রাখলাম। টার্গেট সকাল৯ টার মধ্যে মুকুটমণিপুর পৌঁছানো যাতে সারা দিন টা পেয়ে যাই। কিন্তু বাড়ি থেকে বের হতে সাড়ে চারটে বেজে গেল। গুগল ম্যাপ বাবাজি দেখাচ্ছে দশটা বাজবে মুকুটমণিপুর পৌঁছুতে। মুকুটমণিপুর যাবার তিনটি রাস্তা আছে – খড়গপুর হয়ে, দুর্গাপুর হয়ে, আর জয়পুর ফরেস্ট হয়ে। আমি তৃতীয় রাস্তা টা বেছে নিলাম কারণ প্রথমত এটি ফরেস্ট এর মধ্যে দিয়ে যাবে এবং দুরত্ব অনেক কম কলকাতা থেকে।
ঈশ্বরের নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম Long Drive এ। Smooth ড্রাইভে আমরা এগিয়ে চলছিলাম, আরামবাগ আস্তে আর জাস্ট 15 km সময় 5:45 am। হঠাৎ দেখি ট্রাক গুলি লম্বা লম্বা লাইন এ দাঁড়িয়ে আছে আর তার মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ছোট গাড়িগুলো। ওভারটেক করে কিছু দূর এগিয়ে দেখি আর যাবার উপায় নেই, লম্ব জ্যাম। রামমোহন সেতুতে মুখোমুখি দুটো লরির সংঘর্ষে 2 জন spot dead, ঠিক আমাদের থেকে 15-16 টা গাড়ি আগে।এটা ভেবে আমরা শিউরে উঠলাম আমরা যদি সকাল 4 টে তে বের হতাম হয়তো আমাদের সাথেও এই দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। টানা 1:30 ঘন্টা অপেক্ষা করার পর জ্যাম ছাড়লো, বডি কেটে বার করতে হয়েছে। দুটি লরির পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম অবস্থা দেখে শিউরে উঠলাম আমরা। প্রথম দশ কিলোমিটার এই ট্রমা কাটাতে আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিলাম।
আরামবাগ পেড়িয়ে আমরা জয়পুর ফরেস্ট পৌছালাম 9:30 টা নাগাদ। ওখানে বনলতা রিসোর্ট এ একটু হালকা ব্রেএকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের আজকের গন্তব্য মুকুটমণিপুর এর উদ্দেশ্যে। 14km জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এই রাস্তায় গাড়ি চালানো খুবই থ্রিলিং।
মুকুট মনিপুর পৌছালাম সকাল 11:20 প্রায় দুঘন্টা লেটে।
আমি জেনেছিলাম dam road এর উপর গাড়ি নিয়ে যাবার জন্য অনুমতি নিতে হয় যা সোম থেকে শুক্রবার সকাল 10:30 টা থেকে বিকেল 5 টা অবধি দেয়। শনি রবি বন্ধ। তাই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ওই দুপুরে বেরিয়ে পড়লাম কংসাবতী Dam এর উদ্দেশ্যে। মুকুটমণিপুর বা কংসাবতী ড্যাম হলো ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাটির বাঁধ বা ড্যাম।
পারমিশন যোগাড় করে Dam রোডের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলেগেলাম প্রায় 7 km দূরে পারেশনাথ মন্দিরের তারপর আবার ফিরে সারা দিন টা বিশ্রাম করে বিকেলে গেলাম লেকের কাছে বোটিং এর উদ্দেশ্যে। কিন্তু হুড়মুড়িয়ে আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসার ফলে আমরা বোটিং থেকে বিরত থাকলাম।
পরের দিন ভোর বেলায় উঠে আমি আমার গিন্নি একটু আশপাশ টা দেখতে বের হলাম, কারণ এত কাছ থেকে গ্রাম দেখার সুযোগ খুবই কম আসে
ফিরে এসে ব্রেএকফাস্ট করে ঠিক সকাল 9 টায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম বিষ্ণুপুরের দিকে। 67 km, ঠিক 1:30 ঘন্টার রাস্তা। সকাল 10:30 টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু হোটেল চেক ইন 12 টায় তাই ঠিক করলাম একদম লোকাল সাইটসিং করে হোটেলে যাবো, সময় নষ্ট হবে না।
বিখ্যাত রাসমঞ্চ পৌঁছে গাড়ি পার্ক করার সময় আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন এক গাইড ভদ্রলোক, মধুসূদন বাবু, পুরো নাম মধুসূদন মুখার্জী। রাসমঞ্চ যেমন বিখ্যাত তেমনই মধুসূদন বাবুও খুব বিখ্যাত গাইড হিসেবে। বিষ্ণুপুর নিয়ে ওনার একটা ভিডিও আছে youtube এ তাই দেখেই চিনতে পারলাম। এবার ওনাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বিষ্ণুপুর দর্শন শুরু।অনেক না জানা ইতিহাস ওনার থেকে আমরা জানলাম। উনি অত্যন্ত ভদ্র ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। প্রত্যেক টা জায়গায় নিয়ে গিয়ে আমাদের তার ইতিহাস খুব সুন্দর ভাবে জানালেন কোনো তাড়াহুড়ো না করে। সেই সব আমি এখানে লিখলাম না কারণ তাতে লেখা আরো দীর্ঘায়িত হবে। আমরা পুরোটাই নিজেদের গাড়িতেই ঘুরেছি, আলাদা করে কোনো toto না নিয়ে।
বিষ্ণুপুর কে বলা হয় – The City Of Temples. মালভূমির রাজধানী হলো এই বিষ্ণুপুর। একে আমরা রাসমঞ্চ, শ্যামরাই, জোড়বাংলা, মদনগোপাল, গুমঘর, কালাচাঁদ, জোরমন্দির শ্রেণি, ছিন্নমস্তা মায়ের মন্দির,মহাপ্রভু মন্দির, দলমর্দন বা দলমাদল কামান, মৃন্ময়ী মায়ের মন্দির,লালবাঁধ, বড় পাথরের দরজা ও ছোট পাথরের দরজা ইত্যাদি আরো অনেক দ্রষ্টব্য স্থান দেখে আমরা হোটেলে চেক ইন করলাম বেলা 2 টো তে।
বিষ্ণুপুর বলতে আমাদের চোখে যেটা প্ৰথম ভাসে তাহলো হম্বির মল্ল দেব ওরফে বীর হম্বির দ্বারা ১৬00 খ্রিস্টাব্দে নির্মিত রাসমঞ্চ এবং ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে মল্ল রাজ রঘুনাথ সিংহ দ্বারা নির্মিত জোড় বাংলা বা কেষ্ট রাই মন্দির। তারমধ্যে জোর বাংলা মন্দির অনুকরণে আমাদের নিউ টাউন ইকো পার্কে তার একটি প্রতিকৃত আমরা দেখতে পাই। যেমন আগ্রা কে চিনি আমরা তাজ মহল এবং আগ্রা ফোর্ট দিয়ে, পুরী কে চিনি আমরা জগন্নাথ মন্দির এবং বঙ্গোপসাগর দিয়ে তেমনই বিষ্ণুপুরকে চিনি রাসমঞ্চ ও জোর বাংলা মন্দির দিয়ে। মন্দিরগুলির গায়েতে অপুর্ব সব টেরাকোটার কাজ। যা আমরা সাধারণত কোনো ইতিহাস বই বা গল্পের বই তে দেখি তা আজ চোখের সামনে। এই গুলো দেখে মন চলে যায় সেই কোন সুদূর অতীতে। অনেক মন্দিরে এখন ASI দ্বারা নতুন করে সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে, কিন্তু কিছু মন্দির আছে যা সংরক্ষণের উর্দ্ধে, যা আর পুরোনো অবস্থায় নিয়ে আসা সম্ভব নয়। তেমনই একটি মদির হলো মহাপ্রভু মন্দির, বাজ পড়ে নষ্ট হয়ে যায়।
দুপুরে লাঞ্চ করে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা বের হলাম পোড়ামাটির হাটের উদ্দেশে। প্রত্যেক শনিবার এই হাট বসে। ওখানে আদিবাসী নাচ ও হয়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে শেষ দুই শনিবার এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়নি বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকায়। যায় হোক হাটে ঘুরে কিছু পোড়ামাটির Memento কিনে আমরা বেরিয়ে গেলাম তাঁতির বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওখানে গিয়ে দেখলাম কি করে বালুচরী আর স্বর্ণচরী তৈরি হয়। জানলাম একটা শাড়ি করতে 5-7 দিন লাগে সারাদিন 16 ঘন্টা বুনে, ভাবা যায় কি পরিশ্রম আর ধৈর্য লাগে। দাম শুরু মোটামুটি 7500/- থেকে।
রাতের খাওয়া শেষে আবার ব্যাগ গুছনোর পালা। পরেরদিন অর্থাৎ ১২ তারিখ, রবিবার সকাল 11 টায় চেক আউট। রবিবার সকাল সকাল কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট এ গরম গরম ফুলকো লুচি খেয়ে একটু হোটেল compound টা ঘুরে রুমে চলে এলাম। তারপর ফ্রেশ হয়ে ঠিক এগারো টায় হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে অনেক অনেক মধুর স্মৃতি নিয়ে…..
সব শেষে, এই লেখাতে কোনো ভূল ত্রুটি পেলে তা মার্জনা করবেন।🙏🙏🙏
Mukutmanipur Hotel – Aranyak Resort
Phone - +919163395263
Bishnupur Hotel – WBTDCL – Bishnupur Tourist Lodge
Booking Through Online
Bishnupur Guide – Shri Madhusudan Mukherjee (Advance Booking Available)
Ph – 9434998944 / 9593521812
Nearest Railway Station –
For Mukutmanipur – Bankura
From There One Can get bus or private taxis to reach Mukutmanipur (Distance 55 kms)
For Bishnupur – Bishnupur Railway Station
Train – Rupashi Bangla Exp, Aranyak Exp, Purulia Exp
By Road – 229 km (Kolkata to Mukutmanipur) via Joypur Forest
67 km ( Mukutmanipur to Bishnupur)
152 km (Bishnupur to Kolkata)