22/10/2022
রাজস্থান ভ্রমণ 🐫🏜️☀️🌄
অষ্টম পর্ব: যোধপুর ভ্রমণ
বেরিয়ে অটো খুঁজছি আমার পরের গন্তব্য মেহেরেনগড় ফোর্ট যাবো বলে। যদিও তখনও পেটে কিচ্ছুটি পড়েনি। খাবারের কোনও দোকান চোখেও পড়ছে না। কারণ উমেদ ভবনের আশেপাশে খাবার দোকান রাখতে দেয়নি, তার জৌলুস কমে যাবে বলে হয়তো। মাত্র ৬ কিমি যাওয়ার জন্য অটো ৩০০ টাকা হাঁকাচ্ছে। এদিক সেদিক খুঁজছি, দেখি দুটো বাচ্চা ছেলে ২০-২১ এর শেয়ার অটো খুঁজছে। ভাবলাম ওদের সাথে কথা বলে দেখি, গন্তব্য এক হলে শেয়ারে চলে যাবো। কথা বলে জানলাম, ওরাও মেহেরানগড় ফোর্ট যাচ্ছে। অটোওয়ালা গুলো এমন জালি যে তিনজন দেখে এখন ৪০০ এর নিচে যাবে না বলছে। ওরা ততক্ষণে ওলা দেখছে। ভাগ্যক্রমে পাওয়া গেল, মাত্র ২২০ টাকা ভাড়ায় এসি গাড়িতে খুব ভালোভাবে মেহেরানগড় ফোর্ট পৌঁছে গেলাম।
কিন্তু এখানেই আমার মতিভ্রম হলো, আর প্ল্যানে গন্ডগোল করে ফেললাম। প্রথমত খিদে পেয়েছে, আর ফোর্টের আশেপাশে কোনও খাবারের দোকান নেই, তখন প্রায় ১২ টা বাজে, সকাল থেকে ঘুরছি, ফলে খিদেও যথেষ্ট পেয়েছে। ভাবলাম ফোর্টের কিছুটা আগেই (ওই হেঁটে ১০ মিনিট মত) রাও যোধা রক পার্ক রয়েছে, ওদিকটায় আগে ঘুরে আসি, কিছু না কিছু খাবার দোকান পেয়েই যাবো। কপাল খারাপ হলে যা হয়, একটা বিস্কুট অবধি পাওয়া গেল না কোথাও, এদিকে সামনে পৌঁছে গেছি। ভাবলাম এখানে আগে ঘুরে নি, তারপর বেরিয়ে কিছু খেয়ে তারপর ফোর্ট যাবো। ১০০ টাকা টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। টিকিটের সাথে এই রক পার্কে ঘোরার একটা রুট ম্যাপ দিল, সাথে বুঝিয়েও দিল। ভিতরে ঢুকে দেখি, আমরা ছোটবেলায় ভিডিও গেমে যেমন গলির ভিতরে গুহা, পাহাড়, জঙ্গল, জলপথ দেওয়া খেলা খেলতাম, জায়গাটা একদম তারই প্রতিচ্ছবি, অনেকটা ঝুলনের ছবির বাস্তবরূপ। ভিতরে গিয়ে দেখি, লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে, কিছু দূরে ৩ জনের একটা পরিবারের গলার অল্পস্বল্প আওয়াজ পাচ্ছি। রাস্তা যেখানে যেখানে বাঁক নিচ্ছে, পাথরের গায়ে সেখানে তীর চিহ্ন করা আছে, সেখানে আবার সবুজ, হলুদ, নীল, বেগুনি সার্কিট আলাদা। কিছুটা এগিয়ে বুঝলাম, ফেঁসে গেছি। খিদে পেটে পাথরের গা বেয়ে উঠতে মোটেই ভালো লাগছিল না, তার উপর তীর চিহ্ন ঠিকঠাক খুঁজে পাচ্ছিনা, আকাশ বেশ মেঘলা করে আসছে, ভিতরে একটা লোক নেই যে ঠিক পথে যাচ্ছি কিনা খোঁজ নেব, ফলে সময়, পরিশ্রম দুটোরই অপচয় হল। ছোট ছোট টিলা, জলপথ, কাঠের সাঁকো, জঙ্গল ঘুরে শেষ অবধি ভিউ পয়েন্টে পৌঁছতে পারলাম, এতটা পৌঁছতে প্রায় ৩৫ মিনিট চলে গেলেও এখান থেকে মেহেরনগড় ফোর্টের যে ভিউ পেলাম, তা এককথায় অসাধারণ। প্রায় দুপুর পৌনে একটা বেজে গেছে, কাল সন্ধেবেলা নান, বাটার চিকেন খাওয়ার পর এতটা জার্নি, রাত জাগার পর দুপুর গড়াতে চললো, আমার পেটে একটা দানা অবধি পড়েনি, তাই মাথাটা বেশ চক্কর দিচ্ছিল, কিন্তু এখান থেকে বেরোনো অত সহজ না, ফেরার সময় বেশ কয়েকবার পথ ভুল করে বেশ অনেকটা রাস্তা এক্সট্রা হাঁটলাম। দুটো ছেলে মেয়ের সাথে দেখা হল, ওরা আমার অনেক আগে বেরিয়ে এতটা ট্রেক করে আর রাস্তা ভুল করতে করতে হাঁপিয়ে গেছে, বসে রেস্ট নিচ্ছে। রাস্তার ব্যাপারে আমার সেন্স বেশ ভালো, দিকনির্ণয় ছোট থেকে খুব ভালো করতে পারি। ওই বুদ্ধি খাঁটিয়েই বেরোতে পারলাম, ওরাও আমার পিছন পিছন এলো।
ততক্ষণে দুপুর প্রায় দেড়টা বাজে, গত দেড় ঘণ্টার ওই পরিশ্রমের পর আমার ভীষণ দুর্বল লাগছে। ওখান থেকে বেরোতেই জোর বৃষ্টি নেমে গেল। লোকজনকে খাবারের খোঁজ জিজ্ঞেস করায় জানলাম, প্রায় দু কিলোমিটার নিচে (যেহেতু জায়গাটি একটু পাহাড়ের উপর) কিছু খাবার দোকান আছে। দু কিমি হাঁটার তখন আমার আর জোর নেই, অটো করতে হবে, কিন্তু একটা অটোর দেখা নেই, এদিকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়ে চলেছে। যেহেতু আমার পরের গন্তব্য মেহেরণগড় ফোর্ট, তাই সেখানকার ভিতরে কিছু খাবার পাওয়া যায় কিনা জিজ্ঞেস করলাম,কারণ বাইরে যে কিছু নেই, সেটা কিছুক্ষণ আগেই স্বচক্ষে দেখে এসেছি। জানলাম, বাইরে দোকান না থাকলেও ভিতরে কিছু খাবার পাওয়া যায়, তবে তার অতিরিক্ত দাম। যা হোক, খাবার পাওয়া যায় শুনেই খুশি হলাম। ছাতা মাথায় দিয়েই ফোর্টের সামনে এলাম, তখন বৃষ্টি একটু কমের দিকে।
বেশ ভালো চেকিং করে ঢুকতে হলো, ২০০ টাকার টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকে একটা ছোট্ট ক্যাফে পেলাম, ১০০ টাকা দিয়ে একটা ভেজ বার্গার খেলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি আর নেই, আকাশ পরিষ্কার, পেট না ভরলেও ক্ষিদের জ্বালা নেই, অতএব জায়গাটা মন ভরে দেখতে শুরু করলাম। এত বড় ফোর্ট আমি আগে কখনো দেখিনি, অসাধারণ সুন্দর কারুকাজ, বেশ ৪-৫ তলা এই ফোর্টের খিড়কি থেকে নীল শহর দেখা যায়, যোধপুরকে ব্লু সিটি বলা হয় কারণ এই শহরের প্রায় সব বাড়ি নীলচে রঙের। ফোর্টের মধ্যে মন্দির, মিউজিয়াম, কেনাকাটার মার্কেট, ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট সবই আছে। ফোর্টের ভিতরে অস্ত্রশস্ত্র, পেইন্টিং, রাজাদের ব্যবহার্য সামগ্রী, পাল্কি, সিংহাসন, হওদা (হাতির উপরে বসার আসন), শিশমহল (সম্পূর্ণ কাচের কারুকাজ), ফুলমহল, মোতিমহলে চোখ ধাঁধানো কারুকার্য রয়েছে। ফোর্টের ছাদের উপরে প্রায় ১৪-১৫ টা কামান রয়েছে। চারিদিকে বিশাল উচুঁ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সম্পূর্ণ ফোর্টটি, তার বাইরে জলাশয় দ্বারা চারদিকে ঘেরা, তাই ভীষণই সুরক্ষিত। সম্পূর্ণ ফোর্টটি ঘুরতে প্রায় ৩ ঘণ্টা লেগে যায়। ওখান থেকে বেরিয়ে কাছেই যশবন্ত থাডায় গেলাম, পায়ে হাঁটা দূরত্বে।