21/09/2022
তেলকুপি: দামোদরের জলে ডুবে থাকা হাজার বছরের পুরনো মন্দিরনগরী
====================
দামোদরের গভীর জলে পাশাপাশি দু’টি জীর্ণ দেউল। কিছু দূরে মন্দিরের পাশে অযত্নে পড়ে রয়েছে দেউলের মূর্তি। এটাই বর্তমানের তেলকুপি। পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর ২ ব্লকে অবস্থিত এই তেলকুপি এখন লোক গবেষকদের চর্চার বিষয়। তাঁদের মতে, তৈলকম্প লোকমুখে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে তেলকুপি হয়েছে।
দামোদরের দক্ষিণ পাড়ের একদা সমৃদ্ধ এই বন্দর থেকে তাম্রলিপ্ত অধুনা তমলুকের সাথে জলপথে চলত বাণিজ্য। সেই সূত্রে এই বন্দরেই জৈন ব্যবসায়ীরা গড়ে তুলেছিলেন মন্দির নগরী।
১৮৭৮ সালে জিডি বেগলারের ‘Report of a tour through Bengal Provinces’-এর রচনাতে এই তেলকুপির মন্দির সম্পর্কে কিছু তথ্য মেলে। যেখানে বেগলার তেলকুপিতে মোট ২২টি মন্দিরের কথা উল্লেখ করেছিলেন। আবার দেবলা মিত্রের ‘Telkupi- a submerged temple site in West Bengal’ বইতে তেলকুপির মন্দির নিয়ে বিশদে আলোচনা রয়েছে। তা থেকে জানা যায়, একদা তেলকুপিতে ২৫-২৬টি মন্দির বা দেউল ছিল। ফলে তেলকুপির অতীতের স্বণর্র্যুগ নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই।
কিন্তু তেলকুপির বর্তমান বড়োই বেদনাদায়ক। কারণ দামোদরের উপরে পাঞ্চেত জলাধার তৈরির পরে এই মন্দিরগুলির বেশিরভাগই চলে যায় নদের গর্ভে। কোনো ভাবে মাথা উঁচিয়ে থেকে যায় তিনটি দেউল। তার মধ্যে দু’টিকে বছরের প্রায় সব সময়েই দেখা গেলেও একটি শুধুমাত্র গরমকালে দামোদরের জল কমলে দেখা যায়।
বাসিন্দাদের আক্ষেপ, মন্দিরগুলিকে বাঁচিয়ে জলাধার তৈরি হলে হয়তো তেলকুপির ঐতিহ্য হারিয়ে যেত না। লোক গবেষকদের একাংশের মতে, তেলকুপি নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিতর্ক থাকলেও মোটামুটি ধরে নেওয়া হয় তৈলকম্প থেকেই তেলকুপি নামটি এসেছে। তাঁরা জানাচ্ছেন, সংস্কৃতে তৈল মানে তেল। আবার কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে তৈল মানে এক ধরনের কর এবং কম্প কথাটি এসেছে মূলত কম্পন অর্থাৎ পরগনা।
এ থেকে তাঁদের অনুমান, তৈলকম্প বা অধুনা তেলকুপি ছিল কর প্রদানকারী বা করদ রাজ্য। তবে ঠিক কোন সময়ে তৈলকম্প বা তেলকুপিতে মন্দিরগুলি গড়ে উঠেছিল, কারাই বা মন্দিরগুলি তৈরি করেছিলেন সেই বিষয়ে প্রামান্য নথি পাওয়া যায়নি।
কিন্তু জেলার লোক গবেষকদের একাংশের মতে, মন্দিরগুলির নির্মাণ মোটামুটি দশম-একাদশ শতাব্দীতে। এবং তা মূলত গড়ে ছিলেন জৈন ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ীরা। তৎকালীন সময়ে বাংলায় পালযুগে জৈন ধর্ম প্রসার লাভ করেছিল.এবং ধর্মের প্রসারে ভূমিকা নিয়েছিল জৈন ব্যবসায়ীরাই। যাঁরা এই অঞ্চলের দু’টি তামার খনি তামাজুড়ি ও তামাখুন থেকে তামা এনে তৈলকম্প বন্দর থেকে তাম্রলিপ্তে নিয়ে যেতেন।
অনেকে অবশ্য মনে করেন যে জৈন ও হিন্দু ধর্মের মিশ্র সংস্কৃতিতে গড়ে উঠেছিল তেলকুপি। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় উল্লেখ করেছেন, তেলকুপির মন্দিরে লিপিস্বাক্ষ্য নেই। তাই সময় নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু স্থাপত্যরীতি থেকে মনে হয় এই অঞ্চলে এই রেখবর্গীয় মন্দির নির্মাণ শুরু হয়েছিল নবম-দশম শতকে। চলেছিল অন্তত ত্রয়োদশ শতকের শেষ পর্যন্ত।
তেলকুপির এই মন্দিরগুলো দেখতে হলে ভরসা নৌকা। দামোদরের পাড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তার পর নৌকায় ভেসে পড়া। ঘণ্টাখানেকের নৌকাভ্রমণে দেখে নেওয়া যেতে পারে বাংলার এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে।
~
তথ্য সহায়তা: আনন্দবাজার পত্রিকা