06/10/2024
বুর্জাহম (Burzahom, an Archeological Wonder)
বুর্জাহমের অর্থ বার্চের জায়গা (Home of Birch)! এই প্রাচীন ঢিবি আবিষ্কারের সময়ে সর্বত্র বার্চ গাছের পোড়া ডালপালা পাওয়া গিয়েছিল, তাই থেকে স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে এই নামের প্রচলন।
Burzahom! চেনো না? নাম শুনেছো নাকি তাও শোনোনি ? জিজ্ঞেস করি আমি আকাশকে। নঙার্থক ঘাড় নাড়ে সে।
- কখনও কোন টুরিস্ট কে নিয়ে যাওনি সেখানে? এবারেও না বলে সে। অবাক লাগে আমার। কাশ্মীর উপত্যকায়, শ্রীনগরের এত্ত কাছে এই প্রাচীন প্রত্নতাত্বিক সাইট দেখতে কেউ আসেনা! যেখানে আনুমানিক ৩০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে ইতিহাসের পাতা লুকোনো ছিল মাটির নীচে, তা দেখতে কারো আগ্রহ জাগে না? তাছাড়া ২০১৪ থেকে এ ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে tentative list এর অন্তর্ভুক্ত। ইতিহাস অনুযায়ী বিংশ শতাব্দীর ১৯৩৯ সালে প্রথম এই বুর্জাহমের উল্লেখ পাওয়া যায়।
গাড়ী থেকে যেখানে নামলাম, বার্চ গাছের ছায়াময় চারপাশ। পিচ রাস্তার একপাশে ASI এর বোর্ড লাগানো আছে। আর লোহার বেড়া ঘেরা নির্দেশিত জায়গাটা একটু উঁচুতে। পাহাড়ী এলাকা। তাই ঢিবি না বলে ঢেউ খেলানো উপত্যকার অংশও বলা যায়।
এই বুর্জাহমে নাকি খনন স্থলের সিংহভাগ মাটি দিয়ে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, কাশ্মীর উপত্যকার মানুষের প্রাগৈতিহাসিক যোগের নিশান শুরু থেকেই অবহেলিত। নইলে প্রত্নক্ষেত্রের মাঝ দিয়ে রাস্তা, পাশেই T-20 ক্রিকেট খেলার মাঠ এসব তৈরি হতো না। বেশ ক্ষোভের সাথে একথা আমায় জানায় স্থানীয় খুরশীদ, খুরশীদ হুসেন।
ওপরে পৌঁছে দেখি, দূরে দাঁড়ানো পাহাড় পাঁচিল ঘেরা ছড়ানো ঢিবি।উপরিতল, অসমান ঢেউ খেলানো। পথ যেখানে আমাদের পৌঁছে দিল, তার ডান দিকে কিছু জায়গা লোহার বেড়াজালে আবদ্ধ। ওই ডান দিকে পরপর চারটে অংশে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে হুসেন।
১) উত্তর পূবের দিক ঘেঁষে এক জলহীন গভীর গহ্বর মতো। ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কিছু পাথরের টুকরো। হুসেনের কথামত, নীচে প্রাচীন মানুষের বসবাসের নিশান ছিল, এখন বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে।
২) গহ্বরের পরে এক উঁচু লোহার রেলিং ঘেরা ময়দান। সেখানে সোজা এবং তেরছা করে দাঁড়িয়ে আছে দুটো বিশাল একশিলা পাথর (monolithic stone)। আরো কয়েকটা বিশালাকৃতি মনোলিথিক পাথরের স্ল্যাব শোয়ানো আছে মাটিতে। কাছে গিয়ে দেখার উপায় নেই, কারণ রেলিংয়ের সঙ্গে লাগানো গেটে তালা ঝোলানো।
৩) তৃতীয় জায়গাটা কিঞ্চিৎ নীচু। কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে একটা নাবো চাতালের মতো। সেখানে নীচ থেকে অসমান কতকগুলো ইঁটের থাম দাঁড়িয়ে। এ একেবারেই প্রাচীন কোন নির্মাণ নয়! হুসেন বলে, কোন এক সময়ে এই থামের ওপরে ছাউনী দিয়ে নীচে খোদিত জায়গা ও সেখানে প্রাপ্ত সামগ্রী প্রদর্শনী হিসেবে রাখার কথা ছিল। পরে সরকারি সিদ্ধান্তে, থামগুলো এই অবস্থাতেই ফেলে রেখে, খোদিত ক্ষেত্র পুরোটা মাটি দিয়ে ভরাট করে দেওয়া হয়েছে।
৪) এরই ডান দিকে কোনাচ করে বানানো চারপাশ খোলা বিশাল কাঠের ছাউনী। এটিও লোহার রেলিং ঘেরা। ভেতরে ঢোকার গেট আছে, তবে তালা বন্ধ। রোলিং নেটের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করি ছাউনীর নীচের নির্মাণ, হুসেনের বয়ানে যা মাটির গুহাঘর!
গোল করে ঘেরা রেলিং প্রদক্ষিণ করতে গিয়ে দেখি, ছাউনীর ভেতরে বেশ গাভীর মাটির গর্ত। সে গর্তের ভেতর বসে, সাদা কাপড়ের নুটি দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করছেন এক ব্যক্তি!
ডাকাডাকিতে হাতের কাজ সেরে উঠে আসেন ASI এর স্টাফ, জাবেদ মনজুর (Jabeed Manzoor)। আর আমার আসার কারণ জেনে তালা খুলে দেন। ভেতরে ছাউনী জুড়ে আঁকাবাঁকা কাঠের তক্তা পাতা পথ। পথের পাশে দুদিকেই নানান স্তরে কোথাও নিটোল গোলাকার, কোথাও চৌকোনা আকৃতির গর্ত,গুহা। একজায়গায় ওপরে বেড়ে থাকা শেলফের সমান্তরাল একটা যেন স্ল্যাব বানানো! সবই মাটির। মনজুর কোন বিজ্ঞানী না হলেও, বুর্জাহম তার প্রাণের জায়গা, জানে সে সব। বোঝায় সে আমায়, নেওলিথিক সময় থেকেই আদি মানবকুলের পছন্দের জায়গা ছিল বুর্জাহম। মোট চার সময় স্তরের চিহ্ন/ অবশেষ পাওয়া গেছে এখানে। অর্থাৎ আদি যুগ থেকে চলতে থাকা মানব বসতি।
পড়েছিলাম, বুর্জাহমে প্রাগৈতিহাসিক পেত্রগ্লিফ (ধারালো কিছু দিয়ে পাথরের ওপর আঁচড় কেটে আঁকা) পাওয়া গেছে। যেখানে আকাশে দুই সূর্যের সাথে মাটিতে শিকারের দৃশ্য চিত্রায়িত। নানান সময়ের আরো অনেক কিছুর উল্লেখ ছিল প্রাপ্ত জিনিষের ভেতর। আশেপাশে কোন মিউজিয়াম গোছের কিছু তো চোখে পড়েনি। তাও মনজুর কে জিজ্ঞেস করি,
- এখানে পাওয়া পাথরের ওপরের আঁকা, কি মৃৎপাত্র, পাথরের অস্ত্রশস্ত্র কিছু কি এখানে কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে?
- নাহ্! সেসব কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের গ্যালারিতে রাখা আছে। কাছাকাছি কেন শ্রীনগরের মিউজিয়ামেও আপনি বুর্জহমের তেমন কিছু পাবেন না। তবে...বলে এরপরে মনজুর যোগ করে,
- এখানকার এই মাটির পুরু দেওয়াল, খোপ কাটা ঘর, সেসবকে কি বলে জানেন নিশ্চই!
- কি?
- পিট হাউস। এখানেই শুধু নয়, পাশাপাশি অনেক খানেই এমন পিট হাউস পাওয়া গেছে। শীতে জমা বরফের হাত থেকে বাঁচাতে, এখানে যেমন উঁচু করে ছাউনী দেওয়া হয়েছে, সেকালের মানুষজন ও মাটির দেওয়ালের মাথায় তেমনি ছাউনী দিত। বার্চ গাছের ডালপালার ওপরে মাটি চাপিয়ে।
বুঝি, এখানে ছাউনী দিয়ে ঘিরে ঘর দোরের আকৃতি অটুট রাখার যে চেষ্টা করা হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক সময়ে এই পিট হাউসেরও ছাউনী থাকতো, গাছের ডালপালার ওপরে মাটির প্রলেপ দিয়ে বানানো। কথায় কথায় মনজুরের কাছে আবারও বুর্জাহমের নামের উৎস জেনে গেলাম!
হম তো ঘর আর বুর্জ হলো বার্চ গাছ!
ছবি তুলতে তুলতে ভাবছিলাম, মৃৎ পাত্রের টুকরো, নকশা কাটা মৃৎ পাত্র যখন পাওয়া গেছে, পোড়ানোর উনুন (klin) তো থাকার কথা। নইলে কি বিনিময়ের মাধ্যমে সেসব এখানকার মানুষের কাছে পৌঁছতো?
আমার চিন্তায় ছেদ পড়ে মনজুরের ডাকে। আমায় সে নিয়ে চলে সেই menhir পোঁতা ময়দানে। তালা খুলে ভেতরে ঢুকে অবাক লাগে আমার। এত্ত চওড়া পাথরের স্ল্যাব পাহাড় থেকে বয়ে এনেছিল প্রাচীন মানুষেরা! কি করে? মনজুর বোধহয় বুঝতে পারে আমার মনের কথা। সবচেয়ে বড় একশিলা পাথরটাই শুধু নয়, মাটিতে গেঁথে থাকা দুখানা পাথরেরই ওপরের দুগুন দৈর্ঘ্য নাকি মাটির ভেতরে পোঁতা আছে! খাড়াই পাথরটার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সময়ে দেখেছি আমার প্রায় আড়াই গুণ লম্বা সেটা। আমার উচ্চতা ৫ফুট। মানে মাটির ওপরে ১২, আর নীচে আন্দাজ ২৪ ফুট মিলে মোট ৩৬ ফুট লম্বা একশীলা পাথর!
মনজুরের কথা অনুযায়ী কোন কোন বিজ্ঞানী মন করেন, এইসব দাঁড় করিয়ে রাখা পাথরে সূর্যের আলোয় সৃষ্ট ছায়া মেপে দিনের বিভিন্ন সময়ের হিসেবে রাখতো বাসিন্দারা ! অর্থাৎ সূর্য ঘড়ির মতো ব্যবহারে লাগানো হতো এদের কোন কোন পাথরকে। মাটিতে শুয়ে থাকা পাথরগুলোয় গভীর অর্ধগোলাকার চিহ্ন ! সে খুঁটি পোঁতার হতে পারে, হতে পারে খল নুড়ি ব্যবহারের চিহ্ন বা অন্য কিছু। যাই হোক, এসবই মনুষ্য সৃষ্ট। দুটো পাথর স্ল্যাবের (তার একটা দুটুকরো হয়ে গেছে) একদিক বেশ মসৃণ। ওপরে অজস্র লাইনের মতো আঁচড় কাটা। কালের বলিরেখা নাকি এরও কোন অর্থ আছে ! এও কি মানুষেরই সৃষ্টি? কে জানে! মোটা স্ল্যাবের ইতিউতি বুনো সুন্দর ফুলের মেলা! চড়চড়ে রোদ্দুরে ময়দান ছায়া মেলেছে পাথরের থামেরা। তেরছা হয়ে শুয়ে থাকা একটা স্ল্যাবের নীচে বসে আমার ছবি তুলে দেয় মনজুর।
সেখান থেকে বেরিয়ে গেটে তালা লাগাতে লাগাতে মনজুর আমায় বলে,
- এখানে কিছু কঙ্কাল পাওয়া গেছিল। জানেন কি?
মনে পড়ে, অন্যান্য প্রাগৈতিহাসিক মানব বসতির মতো বুর্জাহমেও সমাধি আর তার ভেতরে কঙ্কাল পাওয়া গেছে। খুবই বিস্ময়কর বিষয় হলো, শুধু মানুষ নয়, কুকুরেরও কঙ্কাল আছে সেখানে। আরেকটা বিস্ময়কর বিষয়,
কোন এক মহিলার (কঙ্কালের) খুলিতে নাকি বেশ কয়েকটা ছেদ মানে ফুটো পাওয়া গেছে ! তার কিছু দুপাশেই দেখা যাচ্ছে, অর্থাৎ সম্পূর্ণ ছিদ্র আর কিছু ছেদের চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু সম্পূর্ণ নয়। আর তাই দেখে বিজ্ঞানীদের অনুমান, কোনভাবে এগুলো করা হয়েছিল। অর্থাৎ প্রাচীন সার্জারি হয়েছিল হয়তো সেই মহিলার মাথায়!!
Copyright belongs to Sarbani Mukhopadhyay