Sarbaniz Soliloquy

  • Home
  • Sarbaniz Soliloquy

Sarbaniz Soliloquy Sarbaniz Soliloquy is an interactive blog page for travel and travel related conversations.

বুর্জাহম (Burzahom, an Archeological Wonder)বুর্জাহমের অর্থ বার্চের জায়গা (Home of Birch)! এই প্রাচীন ঢিবি আবিষ্কারের স...
06/10/2024

বুর্জাহম (Burzahom, an Archeological Wonder)

বুর্জাহমের অর্থ বার্চের জায়গা (Home of Birch)! এই প্রাচীন ঢিবি আবিষ্কারের সময়ে সর্বত্র বার্চ গাছের পোড়া ডালপালা পাওয়া গিয়েছিল, তাই থেকে স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে এই নামের প্রচলন।
Burzahom! চেনো না? নাম শুনেছো নাকি তাও শোনোনি ? জিজ্ঞেস করি আমি আকাশকে। নঙার্থক ঘাড় নাড়ে সে।
- কখনও কোন টুরিস্ট কে নিয়ে যাওনি সেখানে? এবারেও না বলে সে। অবাক লাগে আমার। কাশ্মীর উপত্যকায়, শ্রীনগরের এত্ত কাছে এই প্রাচীন প্রত্নতাত্বিক সাইট দেখতে কেউ আসেনা! যেখানে আনুমানিক ৩০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে ইতিহাসের পাতা লুকোনো ছিল মাটির নীচে, তা দেখতে কারো আগ্রহ জাগে না? তাছাড়া ২০১৪ থেকে এ ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে tentative list এর অন্তর্ভুক্ত। ইতিহাস অনুযায়ী বিংশ শতাব্দীর ১৯৩৯ সালে প্রথম এই বুর্জাহমের উল্লেখ পাওয়া যায়।
গাড়ী থেকে যেখানে নামলাম, বার্চ গাছের ছায়াময় চারপাশ। পিচ রাস্তার একপাশে ASI এর বোর্ড লাগানো আছে। আর লোহার বেড়া ঘেরা নির্দেশিত জায়গাটা একটু উঁচুতে। পাহাড়ী এলাকা। তাই ঢিবি না বলে ঢেউ খেলানো উপত্যকার অংশও বলা যায়।
এই বুর্জাহমে নাকি খনন স্থলের সিংহভাগ মাটি দিয়ে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, কাশ্মীর উপত্যকার মানুষের প্রাগৈতিহাসিক যোগের নিশান শুরু থেকেই অবহেলিত। নইলে প্রত্নক্ষেত্রের মাঝ দিয়ে রাস্তা, পাশেই T-20 ক্রিকেট খেলার মাঠ এসব তৈরি হতো না। বেশ ক্ষোভের সাথে একথা আমায় জানায় স্থানীয় খুরশীদ, খুরশীদ হুসেন।
ওপরে পৌঁছে দেখি, দূরে দাঁড়ানো পাহাড় পাঁচিল ঘেরা ছড়ানো ঢিবি।উপরিতল, অসমান ঢেউ খেলানো। পথ যেখানে আমাদের পৌঁছে দিল, তার ডান দিকে কিছু জায়গা লোহার বেড়াজালে আবদ্ধ। ওই ডান দিকে পরপর চারটে অংশে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে হুসেন।
১) উত্তর পূবের দিক ঘেঁষে এক জলহীন গভীর গহ্বর মতো। ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কিছু পাথরের টুকরো। হুসেনের কথামত, নীচে প্রাচীন মানুষের বসবাসের নিশান ছিল, এখন বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে।
২) গহ্বরের পরে এক উঁচু লোহার রেলিং ঘেরা ময়দান। সেখানে সোজা এবং তেরছা করে দাঁড়িয়ে আছে দুটো বিশাল একশিলা পাথর (monolithic stone)। আরো কয়েকটা বিশালাকৃতি মনোলিথিক পাথরের স্ল্যাব শোয়ানো আছে মাটিতে। কাছে গিয়ে দেখার উপায় নেই, কারণ রেলিংয়ের সঙ্গে লাগানো গেটে তালা ঝোলানো।
৩) তৃতীয় জায়গাটা কিঞ্চিৎ নীচু। কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে একটা নাবো চাতালের মতো। সেখানে নীচ থেকে অসমান কতকগুলো ইঁটের থাম দাঁড়িয়ে। এ একেবারেই প্রাচীন কোন নির্মাণ নয়! হুসেন বলে, কোন এক সময়ে এই থামের ওপরে ছাউনী দিয়ে নীচে খোদিত জায়গা ও সেখানে প্রাপ্ত সামগ্রী প্রদর্শনী হিসেবে রাখার কথা ছিল। পরে সরকারি সিদ্ধান্তে, থামগুলো এই অবস্থাতেই ফেলে রেখে, খোদিত ক্ষেত্র পুরোটা মাটি দিয়ে ভরাট করে দেওয়া হয়েছে।
৪) এরই ডান দিকে কোনাচ করে বানানো চারপাশ খোলা বিশাল কাঠের ছাউনী। এটিও লোহার রেলিং ঘেরা। ভেতরে ঢোকার গেট আছে, তবে তালা বন্ধ। রোলিং নেটের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করি ছাউনীর নীচের নির্মাণ, হুসেনের বয়ানে যা মাটির গুহাঘর!
গোল করে ঘেরা রেলিং প্রদক্ষিণ করতে গিয়ে দেখি, ছাউনীর ভেতরে বেশ গাভীর মাটির গর্ত। সে গর্তের ভেতর বসে, সাদা কাপড়ের নুটি দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করছেন এক ব্যক্তি!
ডাকাডাকিতে হাতের কাজ সেরে উঠে আসেন ASI এর স্টাফ, জাবেদ মনজুর (Jabeed Manzoor)। আর আমার আসার কারণ জেনে তালা খুলে দেন। ভেতরে ছাউনী জুড়ে আঁকাবাঁকা কাঠের তক্তা পাতা পথ। পথের পাশে দুদিকেই নানান স্তরে কোথাও নিটোল গোলাকার, কোথাও চৌকোনা আকৃতির গর্ত,গুহা। একজায়গায় ওপরে বেড়ে থাকা শেলফের সমান্তরাল একটা যেন স্ল্যাব বানানো! সবই মাটির। মনজুর কোন বিজ্ঞানী না হলেও, বুর্জাহম তার প্রাণের জায়গা, জানে সে সব। বোঝায় সে আমায়, নেওলিথিক সময় থেকেই আদি মানবকুলের পছন্দের জায়গা ছিল বুর্জাহম। মোট চার সময় স্তরের চিহ্ন/ অবশেষ পাওয়া গেছে এখানে। অর্থাৎ আদি যুগ থেকে চলতে থাকা মানব বসতি।
পড়েছিলাম, বুর্জাহমে প্রাগৈতিহাসিক পেত্রগ্লিফ (ধারালো কিছু দিয়ে পাথরের ওপর আঁচড় কেটে আঁকা) পাওয়া গেছে। যেখানে আকাশে দুই সূর্যের সাথে মাটিতে শিকারের দৃশ্য চিত্রায়িত। নানান সময়ের আরো অনেক কিছুর উল্লেখ ছিল প্রাপ্ত জিনিষের ভেতর। আশেপাশে কোন মিউজিয়াম গোছের কিছু তো চোখে পড়েনি। তাও মনজুর কে জিজ্ঞেস করি,
- এখানে পাওয়া পাথরের ওপরের আঁকা, কি মৃৎপাত্র, পাথরের অস্ত্রশস্ত্র কিছু কি এখানে কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে?
- নাহ্! সেসব কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের গ্যালারিতে রাখা আছে। কাছাকাছি কেন শ্রীনগরের মিউজিয়ামেও আপনি বুর্জহমের তেমন কিছু পাবেন না। তবে...বলে এরপরে মনজুর যোগ করে,
- এখানকার এই মাটির পুরু দেওয়াল, খোপ কাটা ঘর, সেসবকে কি বলে জানেন নিশ্চই!
- কি?
- পিট হাউস। এখানেই শুধু নয়, পাশাপাশি অনেক খানেই এমন পিট হাউস পাওয়া গেছে। শীতে জমা বরফের হাত থেকে বাঁচাতে, এখানে যেমন উঁচু করে ছাউনী দেওয়া হয়েছে, সেকালের মানুষজন ও মাটির দেওয়ালের মাথায় তেমনি ছাউনী দিত। বার্চ গাছের ডালপালার ওপরে মাটি চাপিয়ে।
বুঝি, এখানে ছাউনী দিয়ে ঘিরে ঘর দোরের আকৃতি অটুট রাখার যে চেষ্টা করা হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক সময়ে এই পিট হাউসেরও ছাউনী থাকতো, গাছের ডালপালার ওপরে মাটির প্রলেপ দিয়ে বানানো। কথায় কথায় মনজুরের কাছে আবারও বুর্জাহমের নামের উৎস জেনে গেলাম!
হম তো ঘর আর বুর্জ হলো বার্চ গাছ!
ছবি তুলতে তুলতে ভাবছিলাম, মৃৎ পাত্রের টুকরো, নকশা কাটা মৃৎ পাত্র যখন পাওয়া গেছে, পোড়ানোর উনুন (klin) তো থাকার কথা। নইলে কি বিনিময়ের মাধ্যমে সেসব এখানকার মানুষের কাছে পৌঁছতো?

আমার চিন্তায় ছেদ পড়ে মনজুরের ডাকে। আমায় সে নিয়ে চলে সেই menhir পোঁতা ময়দানে। তালা খুলে ভেতরে ঢুকে অবাক লাগে আমার। এত্ত চওড়া পাথরের স্ল্যাব পাহাড় থেকে বয়ে এনেছিল প্রাচীন মানুষেরা! কি করে? মনজুর বোধহয় বুঝতে পারে আমার মনের কথা। সবচেয়ে বড় একশিলা পাথরটাই শুধু নয়, মাটিতে গেঁথে থাকা দুখানা পাথরেরই ওপরের দুগুন দৈর্ঘ্য নাকি মাটির ভেতরে পোঁতা আছে! খাড়াই পাথরটার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সময়ে দেখেছি আমার প্রায় আড়াই গুণ লম্বা সেটা। আমার উচ্চতা ৫ফুট। মানে মাটির ওপরে ১২, আর নীচে আন্দাজ ২৪ ফুট মিলে মোট ৩৬ ফুট লম্বা একশীলা পাথর!
মনজুরের কথা অনুযায়ী কোন কোন বিজ্ঞানী মন করেন, এইসব দাঁড় করিয়ে রাখা পাথরে সূর্যের আলোয় সৃষ্ট ছায়া মেপে দিনের বিভিন্ন সময়ের হিসেবে রাখতো বাসিন্দারা ! অর্থাৎ সূর্য ঘড়ির মতো ব্যবহারে লাগানো হতো এদের কোন কোন পাথরকে। মাটিতে শুয়ে থাকা পাথরগুলোয় গভীর অর্ধগোলাকার চিহ্ন ! সে খুঁটি পোঁতার হতে পারে, হতে পারে খল নুড়ি ব্যবহারের চিহ্ন বা অন্য কিছু। যাই হোক, এসবই মনুষ্য সৃষ্ট। দুটো পাথর স্ল্যাবের (তার একটা দুটুকরো হয়ে গেছে) একদিক বেশ মসৃণ। ওপরে অজস্র লাইনের মতো আঁচড় কাটা। কালের বলিরেখা নাকি এরও কোন অর্থ আছে ! এও কি মানুষেরই সৃষ্টি? কে জানে! মোটা স্ল্যাবের ইতিউতি বুনো সুন্দর ফুলের মেলা! চড়চড়ে রোদ্দুরে ময়দান ছায়া মেলেছে পাথরের থামেরা। তেরছা হয়ে শুয়ে থাকা একটা স্ল্যাবের নীচে বসে আমার ছবি তুলে দেয় মনজুর।
সেখান থেকে বেরিয়ে গেটে তালা লাগাতে লাগাতে মনজুর আমায় বলে,
- এখানে কিছু কঙ্কাল পাওয়া গেছিল। জানেন কি?
মনে পড়ে, অন্যান্য প্রাগৈতিহাসিক মানব বসতির মতো বুর্জাহমেও সমাধি আর তার ভেতরে কঙ্কাল পাওয়া গেছে। খুবই বিস্ময়কর বিষয় হলো, শুধু মানুষ নয়, কুকুরেরও কঙ্কাল আছে সেখানে। আরেকটা বিস্ময়কর বিষয়,
কোন এক মহিলার (কঙ্কালের) খুলিতে নাকি বেশ কয়েকটা ছেদ মানে ফুটো পাওয়া গেছে ! তার কিছু দুপাশেই দেখা যাচ্ছে, অর্থাৎ সম্পূর্ণ ছিদ্র আর কিছু ছেদের চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু সম্পূর্ণ নয়। আর তাই দেখে বিজ্ঞানীদের অনুমান, কোনভাবে এগুলো করা হয়েছিল। অর্থাৎ প্রাচীন সার্জারি হয়েছিল হয়তো সেই মহিলার মাথায়!!
Copyright belongs to Sarbani Mukhopadhyay










ফুক তার/ফুক তাল গুম্ফা দুলদুলে ব্রিজে সারাফ চু পারসারাক্ষণ আমরা সরাফ চুয়ের ডান পাড় ধরে চলছিলাম। এ পথের শেষে আমাদের চু ...
29/09/2024

ফুক তার/ফুক তাল গুম্ফা

দুলদুলে ব্রিজে সারাফ চু পার

সারাক্ষণ আমরা সরাফ চুয়ের ডান পাড় ধরে চলছিলাম। এ পথের শেষে আমাদের চু পেরিয়ে ওপারে যেতে হবে। কারণ, ফুকতাল গুম্ফা ওই পারে। মৌমিতা বলেছে, চু পার হলেই সামনে জ্বলজ্বল করবে গুম্ফার তোরণ! ভেবেই আমি নতুন উৎসাহে পা চালাই, আর সাথেসাথে চোখের সামনে হাজির (দৃষ্টি সীমার ভেতরে, তবে বেশ দূরে!) একটা নয় দু দুটো ব্রিজ, একটা কাঠের আর দ্বিতীয়টা দড়ির। চটপট ওখানে পৌঁছনোর আগে শক্তপোক্ত কাঠের ব্রিজের দখল নিয়ে নিল ভারবাহী খচ্চরের দল। সঙ্গে চাবুক হাতে তাদের পরিচালক। তারা চলেছে পূর্নে গ্রাম থেকে রেশন আনতে। মুহূর্তে তারা আমাদের কাছে পৌঁছে গেল। আর তাদের যাওয়ার জন্যে সরু রাস্তায় পাহাড়ের দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। কাঠের ব্রিজ হওয়ার আগে, মানুষজন পাশের ঝুলন্ত দড়ির সেতু দিয়েই এপার ওপার যাতায়াত করতো।
দুটো ব্রিজেরই দুপাশ জুড়ে দড়িতে বাঁধা অজস্র ধর্ম বাণী ওলা উড়ন্ত পতাকা। আর ব্রিজে ওঠার আগেই ওপারের পাহাড়ের গায়ে দেখা যাচ্ছে গুম্ফার রঙিন তোরণ!
ব্রিজ পেরোনোর আগে এক গ্রামবাসী গৃহিণীর দেখা মিলল। দুজনে ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিলাম, তাই খেয়াল করিনি, জনা চারেক বিদেশী ব্রিজ পেরিয়ে এদিকে নামছে। পিছে তাদের গাইড। তারা পদম থেকে ঘুর পথে এসে রাত্রে কোথাও ক্যাম্প করে ছিল। এখন ফুকতাল ঘুরে পূর্ণের দিকে যাচ্ছে। এত মানুষজন অনায়াসে ফুকতাল ঘুরে আসছে দেখে, নতুন উদ্যমে ব্রিজ, তার পরে এক দুরন্ত ঝর্ণা পেরিয়ে হাঁকু পাকু করে প্রায় তিনশো ফুট ওপরের তোরণ মুখে পৌঁছে গেলাম। ঝকঝকে রঙিন তোরণের ওপরে আপন জংস্কারি ভাষায় লেখার নীচে ইংরাজীতে লেখা, PHUKTAR MONASTERY (Phuktal নয়)!

শেষের সে পথ বড় কঠিন !

তোরণের ভেতরে পা রেখে আমি হতাশ ! সামনে, ডানদিকে একটা পাথরের একতলা বাড়ী, যেখানে টুকটাক খাবার মেলে (রেস্তোরাঁ লিখলাম না)। আর সোজা পথে কয়েকটা প্রাচীন চর্তেন। দূরে, অ-নে-ক উঁচুতে পাহাড়ী মাথার একটু নীচে, গুহা কন্দরের ভেতর থেকে বেরিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে আছে ছবির মতো ফুকতাল গুম্ফা। গাইডকে জিজ্ঞেস করি, "আর কত দূর?"
"আন্দাজ আধ কিমি।" তবে খালি চোখেই মালুম হচ্ছে সে পথ বেশ উঁচু, মানে আধ কিমি পুরোটাই পাথুরে চড়াই।
আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, তার ডানদিকে নদীর পাড় বেশ নীচে। আর বাঁয়ে খাড়া পাথরের পাহাড়। মাঝের জায়গা সংকীর্ণ। তায় সমতল নয়। পাহাড়ের দিক উঁচু। নীচু দিকে ইমারতি কাজ চলছে। তাই ওপরের সংকীর্ণ পথেই এগোতে শুরু করি আমি। সামনে এক বিশাল চর্তেনের মধ্যে দিয়ে পথ ওপরের দিকে উঠেছে। আমার সঙ্গে আসা গাইড কিছুতেই আমায় চর্তেনের ভেতর দিয়ে যেতে দেবে না। সে পথে নাকি মেয়েদের যাওয়া মানা! শুধু ছেলেরাই সেখান দিয়ে যেতে পারে। নইলে 'ঘোর অমঙ্গল !' যত বলি অমঙ্গল হলে আমার হবে, সে শোনে না। শেষে তার দাবি মেনে চর্তেনের বাঁদিক দিয়েই উঠি আমি। পরের অংশে আর পথ বলে কিছু নেই। ক্রমশঃ সংকীর্ণ হয়ে আসা পাথরে ধাপ কেটে তৈরি হয়েছে গুম্ফার পাঁচিল, ঘরদোর। এঁকে বেঁকে অসমান (কোনটা ন ইঞ্চি তো পরেরটা পনেরো ইঞ্চি!) সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উঠতে এবং ঢুকতে থাকি গুম্ফার অন্দরে। ডানদিকে ধাপে ধাপে সাজানো ঘর, মাঝে কোথাও চওড়া উঠোন, কোথাও অন্ধকার গলি, কুঠুরি। কোথাও আবার চারদিক ঘেরা সুড়ঙ্গপথ। পুরোটাই পাথর আর মাটিতে গড়া।সব্বার ওপরে পাহাড়ের গুহার গহ্বরে যেন গোঁজা আছে মূল প্রার্থানাঘর। তার আশপাশে ওপর নীচে ধ্যান/মেডিটেশন কক্ষ আছে বেশ কয়েকটা। সেসব একাকী তপস্বীর মন সংহত, শান্ত করার উপাসনা স্থল।
মূল হলে জুতো খুলে ঢুকতে হয় এবং ফটো তোলা নিষেধ। দরজার বাইরে থেকে জুম করে ছবি নিতেই রে রে করে ওঠেন এক লামা প্রহরী! ক্ষমা চেয়ে আমি মনযোগ দিই গুম্ফার গঠন শৈলীতে। গুহা মুখ তো খোলা। কিন্তু ভেতরটা মানে সে খোলা মুখ সব মিলে আন্দাজ চল্লিশ ফুট উঁচু। সেখানে কিছু অংশে পাথর কুঁদে সুড়ঙ্গ পথ, কক্ষ বা ঘর বানানো হয়েছে। ফাঁকা জায়গাগুলোয় কাঠের তক্তা দিয়ে চলাচলের পথ, খোলা বারান্দার মতো বানানো। মূল প্রার্থনা ঘরের নীচে সামনে খোলা বিশাল পাথরের উঠোন। সেখানে লাল টুপি লামাদের দল বসে আছেন। প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজে, যেমন ভক্তদের উপদেশ দেওয়া, প্রণাম ও প্রনামী গ্রহণ ইত্যাদিতে ব্যস্ত। উঠোনের সামনে ছোট্ট পাথরের রেলিংয়ের পর নদীর ওপারে সবুজ সুন্দর গ্রামের ছবি। আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে হলুদ ঠোঁটের আলপাইন চৌঘ। সারা মেঝে জুড়ে লম্বা লম্বা কার্পেট পাতা সবার বসার জন্যে। কিন্তু এমন সুন্দর পরিবেশ যে কার্পেটে না বসে বরফ ঠাণ্ডা মেঝেতেই দুদণ্ড বসে পড়ি।
মূল প্রার্থনা গৃহের পাশে এক্কেবারে নীচু তেরছা ঢালু পাথরের ছাদের গুহা কন্দরে মনাস্ট্রির রান্নাঘর। গুম্ফার সবার জন্যে খাবার তৈরি হয় সেখানে। আমার সাথী বন্ধুরা ওপরের রেলিং থেকে গরম মাখন চা খাবার ডাক পাঠাতেই আমি হাজির। সমস্ত দর্শনার্থীদের আপ্যায়নের জন্যেই এই তিব্বতীয় নোনতা চা বানানো থাকে। ছোট্ট ছোট্ট কাপে চুমুক দিলেই ফুরিয়ে যাওয়ার মতো পরিমাণ হলেও, শরীরটা চনমনে হয়ে যায় একেবারে।
ওপরে উঠে দেখি, মূল ঘরের পাশ দিয়ে সবাই এক চক্কর দিচ্ছে। ঢুকলাম সেখানে। আর মিলে গেল প্রদীপের ভূষকালীর টিকা আর সংগৃহীত ফসিলের ছবি। যেগুলো স্পর্শ করে ধন্য আমি!

ফেরার পালা

(পাহাড়ে) ওঠা সহজ, নামা কঠিন। অন্ততঃ আমার মতো জং ধরা হাঁটুর মানুষের জন্যে এ বড় নির্মম সত্যি। মনে মনে প্রস্তুত হয়ে নামার শুরুতে দুই গাইড বলে, চলুন বৌদ্ধ মূর্তি দর্শনে। কোথায়? এই গুম্ফাতেই। বলে সেই খোলা উঠোনের একধাপ নীচে এক অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে তারা ঢোকায় আমাদের। অন্ধকারের শেষে আলোয় বেরোলাম পাহাড়ের এবং গুহামুখের বাঁ পাশে। কোনো রেলিং ছাড়া উঁচু ধাপের পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে এক ছোট্ট খোলা চাতাল। তারই একপাশে পাহাড়ের গায়ে সরু এক চিলতে গুহা। ভেতরে প্রয়ান্ধকার বেদীতে আসীন এক লম্বা বুদ্ধ, শাক্যমুনির মূর্তি। তাঁর দীর্ঘ মূর্তির দুপাশে আকারে ছোট বোধিসত্বের মূর্তি। আমাদের দুই গাইড বলে তাঁরা নাকি অবলোকিতেশ্বর ! শাক্যমুনির মূর্তিটি নাকি বহু প্রাচীন, দ্বাদশ শতাব্দীর ! মূল প্রার্থনা হলের মতো এখানেও ছবি তোলা নিষিদ্ধ। এখানে শুধু স্থানীয় ও ধর্মীয় দর্শনার্থী বৌদ্ধরাই এসে থাকেন। আমাদের মতো পর্যটকদের যাতায়াত তেমন নেই!

ফেরা শুধু ফেরা নয়

একই পথে ফিরতে হবে। মজা এই যে গেছি চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, ফিরতেও হবে তেমনি করেই। শুধু ওঠা বা শুধুই নামা নেই এ পথে। আন্দাজ দু ঘণ্টায় পৌঁছে ফুকতালে কাটিয়েছি প্রায় ঘণ্টাখানেক। ফেরার সময়ও আমিই শেষ ব্যক্তি। আসার পথে যে মালবাহীদের দেখেছিলাম। তারা এই টুকু সময়ের ভেতরে মাল বোঝাই করে ফিরে চলে এলো। দেখা হলো এক ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে আসা হায়দ্রাবাদের দম্পতির সাথে। চলা, থামা , চলার ফাঁকে চারপাশ দেখতে দেখতে, শেষে সেই গড়ান পথের নীচে পৌঁছলাম। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি, লবজং আমার অপেক্ষায় ওপরের ঝুলন্ত এক কোনায় বসে আছে।।

Copyright belongs to Sarbani Mukhopadhyay











ফুকতার / ফুকতাল গুম্ফাজানস্কর পতন মূলক নামার শেষে সামান্য (আন্দাজ দেড় ফুট) চওড়া পা রেখে চলার মতো পথ ডান দিকে চলে গেছে।...
22/09/2024

ফুকতার / ফুকতাল গুম্ফা
জানস্কর
পতন মূলক নামার শেষে সামান্য (আন্দাজ দেড় ফুট) চওড়া পা রেখে চলার মতো পথ ডান দিকে চলে গেছে। সেখান থেকে ওপরের সে ময়দানের কোন চিহ্নই দেখা যাচ্ছেনা, তবে নদী তল থেকেও তা প্রায় শ তিনেক ফুট উঁচু। এপথ এঁকে বেঁকে পাহাড় সারির গা বেয়ে চলে গেছে নদী রেখা ধরে। চলতে থাকি। আমার সুবিধে এই যে গাইড যুগলের একজন আমার কাছে আছে। আমিই শেষ ব্যক্তি কিনা !
এবার মৌমিতার নিষেধ অগ্রাহ্য করে টুকটাক ছবি তুলতে থাকি। পথ ঈষৎ ঊর্ধ্বগামী। কোথাও বেড়ে থাকা পাথরের নীচ দিয়ে নীচু হয়ে, কোথাও আবার বেরিয়ে থাকা ছোট পাহাড়কে বেড় দিয়ে এগিয়ে চলি। খানিক চলার পর পথ নেমে নদী তট ছুঁয়ে ফেলল। আমার অগ্রবর্তী সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে সেখানে বসে দাঁড়িয়ে মজা করছে। গাইড বলল অর্ধেক রাস্তা শেষ। তবে আইবেক্স আতঙ্কের জায়গা পার হতে এখনও বাকি!
দিনের শুরু মেঘলা ছিল। আধা পথ পেরোনোর মধ্যেই দেখি সুজ্জিমামা তার প্রভাতী আলোয় নদীর বুক ভাসিয়ে দিচ্ছেন। এই নাকি আইবেক্সদের আসার মোক্ষম সময়! সামনে আর এক কিমি পথ পেরোলেই আমরা আইবেক্স চিন্তা মুক্তো হতে পারবো। একথা জেনে, তাড়াতাড়ি পা চালাই।
সারাক্ষণ আমরা সরাফ চুয়ের ডান পাড় ধরে চলছিলাম। এ পথের শেষে আমাদের চু পেরিয়ে ওপারে যেতে হবে। কারণ, ফুকতাল গুম্ফা ওই পারে। তবে তো পূর্নের সেতু পেরিয়ে ওপাশ দিয়ে এলেই হতো! ভাবি আমি। পথের খোঁজে ওপারের পাহাড়ে চোখ বোলাই। নদীর স্নেহে হোক বা আক্রোশে ওপারের পাথরে ছেদ/ erosun অনেক। আর দেওয়ালও নদী তল থেকে খাড়া উঠেছে। এপারের মতো নুড়ি পাথরের উপস্থিতি অন্তত খালি চোখে ধরা পড়লো না। আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে স্ট্যঞ্জিন জানায়, এপারের এই পথ ও নাকি বছর দশেক কি তার একটু বেশী আগের। অতীতে এপারের পাহাড়ী মাথা ধরেই গ্রামবাসীরা গুম্ফা দর্শনে যেতেন। ওপর দিয়ে যাওয়ায় আইবেক্সের ভয় ছিলনা ঠিকই, তবে শীতকালে, পিছল বরফের ওপরে পা রেখে অসম্ভব কঠিন যাত্রাপথে পৌঁছতে হতো গুম্ফায়। স্ট্যঞ্জিনের বাবা মাও নাকি তেমন করে ফুকতাল যাত্রা করেছেন ! কথা বলতে বলতে শম্বুক গতিতে এগোচ্ছিলাম আমরা। হঠাৎ পেছনের দিক থেকে এক বয়স্ক ভদ্রলোক আমাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলেন। পিঠে তাঁর দড়ি দিয়ে বাঁধা এক ভর্তি গ্যাসের সিলিন্ডার! যে পথে আমি নিজেকে নিয়ে নামতে পারছিলাম না, সেপথে আন্দাজ ১৪/১৫ কেজি ভার নিয়ে উনি কিভাবে যে এসেছেন, ভেবে আমি অবাক! আমাদের টপকে, তুলনামূলক একটু চওড়া জায়গায় পিঠের ভার নামিয়ে তিনি বসলেন। ঘাম মুছে, রাস্তার পাশে উবু হয়ে বসে, আঁজলা ভরে জল খেতে লাগলেন তিনি। দূর থেকে শুধু ওনার জল খাওয়া দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু নদী থেকে সে একটু উঁচু এবং অন্য কোন জলের উৎস আমার চোখে পড়েনি! আমার অবাক হওয়া দেখে স্ট্যাঞ্জিন বলে, সরকারি ব্যবস্থাপনায় ওপর থেকে ঝরা জল, পাইপের ভেতর দিয়ে এনে ওখানে একটা মুখ বসানো আছে। এপথে যাতায়াত করা মানুষজন সবাই সেখানে জল খান, মুখে চোখে জল দেন আর ভরে নেন সাথে থাকা খালি বোতল!
জলপান শেষে, তিনিও বোতলে জল ভরলেন। তারপর আমাদের দিকে টুকরো হাসি ছুঁড়ে পিঠে বোঝা চাপিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলেন তাঁর গন্তব্য অভিমুখে।

পাথরের দেওয়ালে আইবেক্স!

সরাফ চুর নীলচে সবুজ জল কোথাও কোথাও বেশ গভীর। সেসব জায়গায় সফেদ ফেনার বদলে গভীরতায় নীল, গম্ভীর সে।
একটু আগে গাইড জানিয়েছে আমরা আইবেক্স শঙ্কার এলাকা পেরিয়ে এসেছি। সেকথা শুনে ফুর্তিতে আমি বেশ জোরেই হাঁটছিলাম। আসলে কঠিন ওঠা পড়া ওলা পথ পার হয়ে, পথ তখন মোটামুটি সমান। তবে পাশে গম্ভীর গভীর নদীজল ! হঠাৎ দেখি পথ সামান্য নীচে নেমে দুভাগ হওয়া নদী জলের মাঝে বৃত্তের জ্যা আকৃতিতে ঘুরে আবার ওপরে উঠে গেছে। পথের ডানপাশে তুলনামূলক বদ্ধ নদী জল আর বাঁয়ে সে গতিময়, অবাধ্য, উচ্ছ্বল। বদ্ধ জলের পাশে খাড়াই পাথরের দেওয়াল। পাথরে নানান ভাঁজ, ওপরের দিকে আধ ঢাকা গুহমুখের মতোও আছে। সেখানে, গা শিরশির করা ঠাণ্ডা হাওয়ায় আমায় দাঁড় করায় স্ট্যাঞ্জিন।
- কি আছে এখানে? জিজ্ঞেস করি আমি।
- আইবেক্স।
- একটু আগেই তো বললে, আমরা সে জায়গা পেরিয়ে এসেছি..! তবে? উদ্বিগ্ন বোধ করি আমি।
- না। আইবেক্সের ছবি।
- কোথায়? কে এঁকেছে? গাঁয়ের লোকেরা?
বলতে বলতে চারপাশে চোখ বোলাই আমি। ছবি বা কোন আঁকিবুঁকি কিছুই চোখে পড়েনা আমার!
হাতের লাঠিটা তুলে পাথরের ওপরে নির্দেশ করে স্ট্যাঞ্জিন। সেখানে অস্পষ্ট কিছু রেখা...
ভালো করে দেখে বোঝা গেল, কোনকালে সাদা রঙে পরপর চারটে ছবি আঁকা হয়েছিল। বাঁদিক থেকে প্রথমে কোন চারপেয়ে প্রাণী, তারপর ছোট একটা কিছু, তৃতীয় চৌকো আকৃতির মাথার দুপাশে বাঁকা শিং। আর সব শেষে দু লাইনে আঁকা একটা বর্গক্ষেত্র! পূর্বপুরুষদের কাছে শুনে স্ট্যাঞ্জিন জানে, বহু বছর আগে তখনকার মানুষেরা এমনি করে পাথরের ক্যানভাসে আইবেক্সের ছবি এঁকে রেখেছিল। আরো দু জায়গায় সে কিছু আঁকিবুঁকি দেখালো বটে, তবে তা আরও অস্পষ্ট, কিছুই উদ্ধার করতে পারলাম না। এইটুকু হাঁটাপথে কতই না বিস্ময় জমানো আছে, ভেবে অবাক হই আমি!
Copyright belongs to Sarbani Mukhopadhyay










ফুকতার / ফুকতাল গুম্ফা (Phuktal Gompha)জানস্কর (Zanskar)গুম্ফা মানেই পাহাড়, হাওয়ায় ওড়ানো বৌদ্ধ ধর্মের বাণী সম্বলিত র...
17/09/2024

ফুকতার / ফুকতাল গুম্ফা (Phuktal Gompha)
জানস্কর (Zanskar)

গুম্ফা মানেই পাহাড়, হাওয়ায় ওড়ানো বৌদ্ধ ধর্মের বাণী সম্বলিত রঙিন কাপড়ের টুকরো আর মেরুন বসনে সজ্জিত লামাদের ছবির ঝলক! কিন্তু এই ফুকতার বা তাল যেমন তেমন গুম্ফা নয়, বড়ই দুর্গম তার অবস্থান! সত্যি বলতে কি, বছর দুয়েক আগে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ভ্রমণ বিভাগে এর ওপরে একটা লেখা পড়ে প্রথম এই নামের সঙ্গে আমার পরিচয়।

তিব্বতীয় মালভূমির দিক থেকে ধরলে, লাদাখে পরপর তিনটে পর্বত শিরা আছে। কারাকোরাম, লাদাখ আর ঝাংস্কর। কার্গিল জেলার অন্যতম তালুক ঝাংস্কর তুলনায় নবীন পাহাড়। বেশিরভাগই ঝুরঝুরে কাদা মাটি পাথরে গড়া। এই ঝাংস্করেই আমাদের আলোচ্য ফুকতাল গুম্ফার অবস্থান, পুরোনো জনপদ পদম থেকে কম বেশী ৫০/৬০ কিমি দূরে। পদম থেকে দুপথে পৌঁছনো যায় সেখানে।
হয় উঁচু এক গিরিপথ পেরিয়ে, নয়তো সরফ চূ র ধারে ছোট্ট গ্রাম পূর্ণে হয়ে। আমরা ওই সরফ চূ পাড় বেয়েই চলেছি, পূর্নের দিকে।
যাত্রাপথের পুরোটাতেই কল্লোলিনী স্রোতস্বিনী সঙ্গী সরাফ চু নানা ভাবে পাহাড়ের গা কুরে নকশা বানিয়েছে কত প্রাকৃতিক স্থাপত্য ! গাড়ী চলেছে বেশ উঁচু পাক দণ্ডী বেয়ে। সেখান থেকেই নদীর দুপাড় জোড়া এক খেলনার মতো ব্রিজ দেখা গেল। ব্রীজের দুপাশে ক্ষয়ে যাওয়া পাথর/ মাটিতে গভীর ভাঁজ ওলা অপূর্ব ' প্রাকৃতিক নকশা '! ছবি তুলতেই ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু পথের যা অবস্থা, ঝাঁকুনিতে হাত স্থির রাখাই মুস্কিল! ক্যামেরার শাটার টেপার আগেই হুড়মুড়িয়ে সেই সেতু পার করে গোঁ গোঁ করে গাড়ী উঠে পড়লো এক ক্যাম্প সাইটে ! এই নাকি আমাদের গন্তব্য, পূর্ণে ক্যাম্প! কয়েক ঘর গৃহস্থ বাড়ী, আর লাগোয়া এক অস্থায়ী (seasonal) ক্যাম্প সাইট। মালিক নরবু আমাদের সারথি লবজঙের কোন একরকম তুতো ভাই। একটা পাথরের দোতলা বাড়ী , সামনের উঠোনে জনা দশ বারোজনের মতো খাবারঘর, রান্নাঘর আর রাস্তার ওপাশে গোটা পাঁচেক সুইস টেন্ট। মালিক কর্তা গিন্নী দুজনে মিলে ওই টেন্ট আর বসত বাড়ীর ঘরে বেশ কিছু অতিথির থাকা, খাওয়ার বন্দোবস্ত করে রেখেছে। মৌমিতা কে নিয়ে আমাদের ১২ জনের দল। পাঁচটা টেন্টে দশ জন আর পাথরের বাড়ীর একতলার ঘরে বাকি দুজনের থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। উত্তরাখন্ড বাসী নেপালি ছেলে রাজেশ এই অতিথি আবাসের একাধারে কুক কাম অ্যাটেনডেন্ট। সাফ সাফাই থেকে বাসন ধোয়ার মতো সব কাজ অবশ্য মালকিন নিজেই সামলান। আর মালিকের কাজ সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা (PRO!)।
এর আগে বহু জায়গাতেই সুইস টেন্টে থেকেছি। কিন্তু এখানে টেন্ট গুলোর অবস্থান নদীর উত্তর পাড়ে, পাহাড়ের কোলে হওয়ায়, রোদ হাওয়া দুয়েরই প্রবল প্রকোপ । তবে পৌঁছনোর সাথেসাথে টেন্টের ছায়া মিলল না। থাইল্যান্ড থেকে একদল বৌদ্ধ পর্যটক ভোরে ফুকতাল গোম্ফা দর্শনে গেছে, আর তাদের জিনিসপত্র সব টেন্টে পড়ে আছে। ফিরে এসে তারা সেসব বের করলে, টেন্ট পরিষ্কার হবে। তারপরেই ঢুকতে পারবো আমরা। তাই আমরা সদলবলে কিছুক্ষণ গাছের তলায় বসে রইলাম। পেছনেই সেই থাইল্যান্ড বাসীদের জন্যে মাংসের হজপজ মানে খিচুড়ি রান্নার সুগন্ধে চারপাশ আমোদিত।

অবশেষে ফুকতাল গুম্ফা অভিযান

আগেই বলেছি, ফুকতাল গুম্ফায় দুদিক দিয়ে যাওয়া যায়। গিরিপথ পার হয়ে পৌঁছনোর প্রথম অপশন আমরা আগেই ফেলে এসেছি। দ্বিতীয় অপশন, এই পূর্ণে থেকে সরাফ চু র পাড় ধরে পৌঁছনো। সেপথে প্রায়শঃই বিপদ ঘটে! বিপদের প্রকৃতি ভারি অদ্ভুত! পূর্নে তে সরফ চূর স্রোত ধারা বেশ পরিণত, চওড়া এবং দুপাশের পাথর, পাড়ের বালিমাটি অসংখ্য প্রাকৃতিক নকশায় ভরা ! শুধু তাই নয়। বছরের প্রায় অর্ধেক সময় চুড়ো/মাথা থেকে শুরু করে নদী, পাড়ের বালি নুড়ি পাথর সব বরফ ঢাকা থাকে। যেই না বসন্তের শুরুতে সে বরফ গলে ঝুরঝুরে বালিমাটি ভিজিয়ে তোলে, শেওলা, ঘাস, মানে সবুজের সমাগম ঘটে পাহাড়ের বুকে। সে সবুজের লোভে দল বেঁধে হানা দেয় আইবেক্সরা। ক্ষিপ্র গতিতে পাথরের দেওয়াল, এমনকি ঝুরঝুরে নুড়ি পাথরের ঢাল বেয়েও তারা স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারে। তবে তারা ' উচ্চমার্গের ' প্রাণী। কখনোই নদীর পাড় অব্দি নামেনা। ওপরে তাদের চলাফেরায়, উঁচু থেকে ছোট বড় নানা আকারের পাথর গড়িয়ে নামে। আর গতি বিজ্ঞানার নিয়মে সে পড়ন্ত পাথর গতিবেগ বাড়িয়ে প্রাণঘাতি বোল্ডারের মতো নীচে এসে পড়ে। তাই 'হাঁটতে পারি ' মানুষ হলেই ফুকতালে চলে যাওয়া যায় না। বেঁচে ফিরতে হলে, এ পথে চলাফেরায় অভিজ্ঞ মানুষের সঙ্গে যাওয়াই শ্রেয়। তাই মৌমিতা নরবু কে বলে দুজন local guide এর ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু সকালে আমরা তৈরি হয়ে দেখি, গাইডরা আসেনি। অগত্যা, গাইড ছাড়াই যাওয়া হোক, এমন যখন মনের অবস্থা, হাঁপাতে হাঁপাতে দুই সদ্য যুবক এসে হাজির। একজন এসেছে সরাফ চু পেরিয়ে পাহাড়ী মাথার এক গ্রাম থেকে আর দ্বিতীয় জন এসেছে পূর্নের পূর্ব দিকে পাঁচ কিমি দূরের কোন গ্রাম থেকে। পাহাড়ে এমনি কোন যানবাহন তো নেই, তাই ভোরে উঠে হেঁটে আসতেই এই দেরী!
আগে নাকি এই ক্যাম্প থেকেই হাঁটা শুরু হতো। তবে এখন দু কিমি অব্দি গাড়ী যাওয়ার মতো পথ হয়েছে। তাই লবজং আমাদের দু কিমি হাঁটা বাঁচিয়ে দিল। পড়ে রইলো আর কম বেশী পাঁচ কিমি। অর্থাৎ আমাদের একদিনে যাওয়া ফেরা মিলিয়ে মোট দশ কিমি হাঁটতে হবে।

চলো নিয়ম মতে...

লবজং রাস্তার ডানদিকে যেখানে গাড়ী থামালো, সেটা একটা চেপ্টা ময়দান। বাঁদিকে, একটু পরেই দু পাহাড়ের মাঝের চওড়া গভীর ভাঁজে রাস্তাটা নেই হয়ে গেছে ! সে ভাঁজের মাঝ বরাবর নুড়ি পাথরে পা রেখে সো-ও-জা নেমে যেতে হবে নদীর গর্জন লক্ষ্য করে। গাইড স্ট্যাঞ্জিন (Stanzin) আর তেনজিং (Tenzin) দুজনে সম্মিলিতভাবে সেকথাই জানালো। ভাঁজের কৌণিক মাপ আন্দাজ ৪০-৪৫°! গাইডদের একজন সবার আগে আর দ্বিতীয়জন সবার পিছনে থাকবে, মাঝে আমরা আটজন ! চলা, মানে নামার শুরুতেই বুঝলাম, আমার জন্যে এ চলা নয় পতন হবে! দুপাশের পাহাড়ের গায়ে মনমোহিনী রঙ! নুড়ি পাথরের রঙও তেমনি। সামনের পাহাড়ের মাথার ছুঁচলো ধারালো ধরন দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে, গ্রীষ্মের সময় ছাড়া তারা বরফের চাদরে মোড়া থাকে। আমার চোখে কোথাও কোথাও তাদের আকার যেন একসাথে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে মহিলা পুরুষ!
কিন্তু দেখবো কি! রবি ঠাকুর গুনগুনিয়ে চলেছেন অন্তরে..
চলো নিয়ম মতে.
দূরে তাকিও নাকো, ঘাড় বাঁকিয়ো নাকো
চলো ..... পথে.
প্রায় প্রতি মুহূর্তে, হাতের লাঠি ওই ঝুরো পাথরের ফাঁকে গেঁথে পতন রুখতে রুখতে কোনদিকে তাকানোর অবসরও অবশ্য নেই। বুঝলাম, মৌমিতা কেন বলে দিয়েছে,
"যাওয়ার পথে ছবি তুলতে দাঁড়াবে না। যদি তেমন ইচ্ছে হয়, তো ফেরার পথে তুলবে..।"
Copyright belongs to Sarbani Mukhopadhyay











সানি উৎসব (Sanee Festival)২১ শে জুলাই, ২০২৪ বিকেলে যখন সানি গ্রামের কাছে পৌঁছলাম, রাস্তাতেই ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা। লব...
10/09/2024

সানি উৎসব (Sanee Festival)

২১ শে জুলাই, ২০২৪ বিকেলে যখন সানি গ্রামের কাছে পৌঁছলাম, রাস্তাতেই ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা। লবজং আমাদের যেখানে নামিয়ে দিল, সেখান অনেকটা হেঁটে আমরা গোম্ফার গেটের সামনে পৌঁছলাম। দূর থেকেই মাইকে ঘোষণা শোনা যাচ্ছিল। সেসব কিছুই আমাদের বোধগম্য নয়। তাও এটুকু বোঝা গেল, সকাল থেকে উৎসব শুরু হয়ে গেলেও, পুরোহিতদের ওই আরাধ্য দেবের আরাধনার সময় আসন্ন। হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে বিহ্বল আমরা ! স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে, দেশী বিদেশী পর্যটক সবাই ইয়া বড় বড় লেন্স ওলা ক্যামেরা স্ট্যান্ডে বসিয়ে মাটিতে থেবড়ে বসে আছে।
গেট অব্দি কোথাও দাঁড়ানোর জায়গাও নেই। সূর্যদেব পশ্চিমের দিকে একটু হেলে মনাস্ট্রির ছাদের ওপর দিয়ে উল্টো দিকে দাঁড়ানো দর্শকদের মুখে ফোকাস করে আছেন। অর্থাৎ সেখানে দাঁড়ালে কি বসলে উঠোনে কি চলেছে তা চোখ তুলে দেখা অসম্ভব!
কিন্তু আর কোন উপায়ও নেই। অগত্যা রোদ্দুর মুখে নিয়েই এক্কেবারে সামনে গিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম।

সানি গোম্ফা ও উৎসব অনুষ্ঠান

সানি (Sa-ni) গোম্ফা নাকি মনাস্ট্রি? মাঝে মাঝে আমার সব গুলিয়ে যায়। গোম্ফা হলো একটা ঘর (ছোট, মাঝারি কি বিশাল যে কোন মাপের!) যেখানে বসে সন্ন্যাসীরা সাধনা/ধ্যান ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেন। আর মনাস্ট্রি একটা প্রতিষ্ঠান। যেখানে সন্ন্যাসী/ সন্ন্যাসিনীরা থাকেন, শিক্ষা নেন, আরাধনা করেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখন প্রশ্ন, সানি কি গোম্ফা নাকি মনাস্ট্রি?
সে যাই হোক, এর ইতিহাস বহু প্রাচীন! আগেই বলেছি সানি দ্রুকপা কর্গিউ সেক্টের অন্তর্ভুক্ত। তবে এ নাকি বিভিন্ন শতাব্দীতে দফায় দফায় তৈরি ঝানস্কারের সবচেয়ে প্রাচীন কা-নি-কা ( Ka-Ni-Ka) মনাস্ট্রি। এই কা নি কা ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়। ইতিহাস বলছে, সানির অস্তিত্বের শুরু কুষাণ যুগে। রাজা কণিষ্কর নাম জড়িয়ে আছে এই মনাস্ট্রির সঙ্গে। এর শুরুর সময় নাকি আনুমানিক দ্বিতীয় শতাব্দী।
চিন্তায় ছেদ পড়ে, পাশে বসে থাকা মানুষজনের অবাক দৃষ্টিপাতে! অনেকের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটা অশোভন! তাই মুখে রোদ নিয়ে বসেই পড়ি। যেখানে বসলাম, তার উল্টো দিকেই সানির ছড়ানো দোতলা বাড়ী। নীচের তলার তুলনায় ওপরের তলা উচ্চতায় বেশী বলে বোধ হলো আমার। নীচ তলার মধ্যিখানে সদর দরোজা। তারই সামনে বিশাল জটলা। ওখান দিয়েই সব লামার দল সেজে গুজে বের হবেন উৎসবের শেষের নৃত্য পরিবেশন করতে। আমাদের ডান বাঁ দুদিকেই, সানির মূল বাড়ীর দুপাশে, ছাদ ওলা খোলা দালান। বাঁদিকের দালানে, ছাদের নীচে লাল টুপি মেরুন বসন লামারা সারি দিয়ে বসে আছেন। আমাদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন যিনি, তিনিও হয়তো আছেন সেখানে!
দরোজার মুখোমুখি, উঠোনের মধ্যিখানে মেরুন রঙের উঁচু বেদী। সেখানে পোঁতা লম্বা দন্ডের গায়ে সবুজ হলুদ কুঁচি দেওয়া পতাকা। সারা উঠোনের মেঝেয় সাদা রঙ দিয়ে আলপনা আঁকা। মাঝের বেদীর সামনে রাজ পোশাকে (আমার মনে হলো!) একজন পুরুষ, তাঁর পাশে জানস্করি মহিলা পোশাকে আরেকজন দাঁড়িয়ে। আমন্ত্রিত অতিথিরা সাদা খাদা পরিয়ে তাঁদের সম্বর্ধনা জানাচ্ছেন। এত খাদা জমা হয়েছে, যে তাঁদের পোশাকই দেখা যাচ্ছে না! মেরুন বসনে এক লামা কমণ্ডুলুর মতো কি একটা হাতে নিয়ে ওনাদের পাশে দাঁড়িয়ে। সবাই যেন কিসের অপেক্ষায়। আমরাও তাই!
অপেক্ষার মধ্যেই উঠোনের বাকি অংশে চোখ বুলিয়ে নিই আমি। আমাদের পেছন দিকে, উঠোনে ঢোকার গেট/ তোরণের ডান পাশে সোনালী মাথার পেল্লায় বড় সাদা চর্তেন, উঁচু পাঁচিলের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। ঐটিই নাকি কনিষ্কের সময়কার! অদ্ভুৎ গোলাকার উঁচু চুড়ো, অন্যান্য চর্তেনের তুলনায় বেশ আলাদা।

হঠাৎ শিঙ্গার সাথে গাবদো করতালের (cymbal) যৌথ যন্ত্র সঙ্গীত শুরু হলো। সেই সঙ্গে যেই না সুরেলা মন্ত্রচ্চারণ যোগ হলো, গায়ে চিত্র বিচিত্র জোব্বা, মাথায় চৌকোনা টুপিতে সেজে দীর্ঘ দেহী পুরোহিত দল (লামা বললাম না, কারণ তাঁরা তখন তো একেবারে অন্যে পোশাকে!) নাচের ভঙ্গিমায় উঠোনে প্রবেশ করলেন। আমাদের নারায়ণ শিলা রাখার আসনের চেয়ে একটু বড় ওমনি একটা সিংহাসনে কাপড়ে মুড়ে এক মূর্তি এনে রাখলেন সেই কমণ্ডুলু সহ ঘুরতে থাকা লামা। আর পুরোহিত দল গোল হয়ে নাচতে নাচতে তাঁকে অভিবাদন জানাতে থাকলেন। খাদার ভার লাঘব করে সেই যুগল মধ্যের পতাকা ওলা বেদীর সামনে দাঁড়িয়ে। লোকটির মাথায় মুকুটের মতো কি পরা আর মহিলার পোশাকও বেশ ঝলমলে।
সেই কমণ্ডুলু লামা থেকে থেকে কমণ্ডুলু থেকে জল ঢেলে দিচ্ছিলেন আর পুরোহিত দলের প্রধান, কাপড়ে মোড়া মূর্তিকে বিশেষ শ্রদ্ধা জানাতে, নাচের ফাঁকে ফাঁকে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে জল দেওয়ার সাথে সাথে তাঁকে অভিবাদন জানাতে থাকলেন।
লবজং সঙ্গে থাকলে পুরো বিষয়টার একটা ধারা বিবরণী পাওয়া যেতে পারতো। আমার চারপাশে বহু স্থানীয় মানুষ বসে আছেন। কিন্তু কেউ তো কারো ভাষা জানিনা। তাও আকারে ইঙ্গিতে বহু চেষ্টায় এটুকু জানা গেল, ওই কাপড় মোড়া মূর্তি নারোপা নামক এক শুদ্ধত্মার। তিনি নাকি এইখানে এসে সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। পবিত্র সাদা চর্তেনের পাশে তাঁর সাধনা গৃহ আজও বর্তমান। আর বছরের এই দিনটি বাদে সারা বছর ওনার মুখ ঢাকা থাকে। সর্ব সাধারণ শুধু এই উৎসবের দিনটিতেই তাঁর মূর্তিমূখ চাক্ষুষ করতে পারে। কারণ এই একদিনই খোলা হয় মুখের আবগুণ্ঠন!
মাঝে মাঝে বাজনদাররা বাজনা বন্ধ করে দিচ্ছিলেন। তখন মন্ত্রচ্চারণ আরও জোরদার হতেই, প্রধান পুরোহিত বাদে সবাই স্থির স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন। শুধু ওই প্রধান জন সে অবসরে ওই শ্রদ্ধা জানানোর কাজটি সারছিলেন । ক্রমাগত একই জিনিষ চলতেই থাকলো। হয়তো প্রতিবারের অর্থ আলাদা, মন্ত্র আলাদা। কিন্তু না বুঝতে পারলে সবই এক। তাই শেষমেশ মেলার হট্টগোল দেখতে উঠেই পড়ি আমি নাচের উঠোন থেকে। সামনের সিংহদুয়ারে প্রচণ্ড ভিড়, তাই পাশের ছোট দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসি বাইরে। চর্তেনের মতো নাকি আরেক নিশান আছে সানি গোম্ফায়। যে দরজা দিয়ে বেরোলাম, তার বাঁদিকে, অর্থাৎ গোম্ফার পেছনের দিকে প্রাচীন সমাধি ক্ষেত্র আছে। সেখানে স্তুপ আছে কিনা জানিনা, তবে সমাধির ওপরে ওপরে নাকি পাথরের লম্বা ফলক লাগানো আছে। তারই ভেতরে আছে মৈত্রেয় বুদ্ধের মূর্তি খোদাই করা এক ফলকও। কিন্তু উৎসব উপলক্ষে, সেখানে যাওয়ার উপায় নেই! অগত্যা, ঘুরে ফেরৎ আসি আবার প্রবেশ তোরণের সামনেই। সেখান থেকে উল্টোদিকের সানি লেক অব্দি তখন মেলার পরিবেশে মানুষের ঢল নেমেছে।
Copyright belongs to Sarbani Mukhopadhyay














সানি উৎসব ঝানস্কার(Sanee Festival Zanskar)উৎসব মানে অনেক মানুষ, হইচই, খাওয়া দাওয়া আর আনন্দ! কিন্তু এই সানি উৎসব (পুরো ...
03/09/2024

সানি উৎসব ঝানস্কার
(Sanee Festival Zanskar)

উৎসব মানে অনেক মানুষ, হইচই, খাওয়া দাওয়া আর আনন্দ! কিন্তু এই সানি উৎসব (পুরো নাম Sanee/Sani Naro-Nasjal বা Sani-Nasjal Festival) জানস্কারের পাহাড়ে এক বাৎসরিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান। কপাল জোরে আমি সচক্ষে এমন উৎসব দেখতে পেয়েছি, সাক্ষী থেকেছি এক বর্ণাঢ্য প্রাণবন্ত মাটির কাছের উৎসবে।

জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে, রংদুম থেকে পদম যাবার পথে পাহাড়ের ফাটল/ গুহায় পোরা জংখুল গোম্ফা (Zongkhul Gonpa) তে থেমেছিলাম আমরা। গোম্ফা দেখে বেরোনোর মুখে মেরুন বসন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ছবি তোলা হচ্ছিল। হোমরা চোমরা এক সন্ন্যাসী বলেন,
"তোমরা যখন পদম যাচ্ছো, সানি উৎসবে যোগ দিও। ২০, ২১ দুদিনই সানি গোম্ফায় উৎসব আছে।" সঙ্গে এও বললেন, উনি নিজে পরদিন অর্থাৎ ২১ তারিখে থাকবেন সেখানে। বিশাল মেলা বসবে, দিগ্বিদিক থেকে মানুষজন, আশপাশের গোম্ফা থেকে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা সব যোগ দেবেন সে উৎসবে।

উৎসবে সামিল হবার আগে লাদাখ - জানস্করে বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা, তার পালন, উৎসব ইত্যাদি সম্পর্কে একটু জানতে ইচ্ছে হলো। আসলে সাজগোজ, নাচগান এসব দেখা আর তাতে সামিল হওয়ায় বিস্তর তফাৎ। আমাদের দেশে বারো মাসে তেরো পার্বণ পালন সব জায়গায় একরকম নয়, সে অভিজ্ঞতা থেকেই একটু জানার চেষ্টা, এই আর কি!
লাদাখের ভূ প্রকৃতি, পরিবেশ, তিব্বতীয় পরিবেশের সাথে খুব মেলে। আর বাসিন্দারাও মূলতঃ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। অন্যান্য ধর্মের মতোই, নানান ভাগ, তস্য ভাগ এ ধর্মেও আছে। তবে প্রধানতঃ চার ধারার বৌদ্ধ ধর্মাচরণ তিব্বত ও লাদাখে প্রচলিত -
সর্ব প্রাচীন, অষ্টম শতাব্দী থেকে নিংমা (Nyingma), দ্বিতীয় - একাদশ শতাব্দী থেকে কাগিয়ু (Kagyu), তৃতীয় - ওই একাদশ শতাব্দী থেকেই শাক্য (Sakya), আর চতুর্থ - পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে গেলুগ (Gelug)।
বুদ্ধের প্রধান নিয়মাবলীর কিঞ্চিৎ পরিবর্তন বা পরিবর্ধন বা নতুন কিছু সংযোজন হয়েছে প্রতিবারেই। আর এই চার স্কুলের গুরু, চিন্তাধারা, আচরণ বিধি কি উৎসবেও তার প্রতিফলন স্পষ্ট। আমাদের নিমন্ত্রণ সানি উৎসবে। সানি, এবং জংখুল গোম্ফায় তিব্বতীয় দ্বিতীয় ধারা, কাগিয়ুর উপধারা ড্রুকপা কর্গিউ বৌদ্ধ আচরণ পালিত হয়। তবে জংখুলে আরাধ্য নারোরা আর সানি তে পদ্মসম্ভব।

সানি লেকের পাড়ে মেলা চত্বরে :

পদম ঢোকার মুখে রাস্তার বাঁদিকে বিশাল এক পদ্মসম্ভবের রঙিন মূর্তি বসানো। সে দেখে গাড়ী থামালাম আমরা। আর কাছাকাছি গিয়ে দেখার বাসনায় নেমে পড়লাম সদলবলে। রঙচঙে মূর্তিখানা উঁচু মঞ্চের ওপরে বসানো। মূর্তি মঞ্চের তিনদিক ঘিরে আকাশের ছায়া ওলা নীল জল। দুপাশে উঁচু রাস্তা আর পেছনের দিকে বরফ মাথার পাহাড় ঘেরা জায়গাটা ঠিক জলাশয় না হলেও, নাবো। তাই পাহাড় বেয়ে নামা বরফ গলা জল জমে খানিক জলাশয়েরই চেহারা নিয়েছে। মাঝের নীল জল ঘিরে, ডাঙা জমি নয়, উঁচু নীচু ঘাস ঢিবি ওলা জলাভূমি। উঁচু রাস্তার উঁচু পাঁচিল ঘেরা পার্কিংয়ে গাড়ী রইলো, আর আমরা খাড়াই ঢালে বানানো র‍্যাম্প দিয়ে জলের ধারে পৌঁছলাম। জলাশয়ের নাম নাকি সানি লেক!
তখনই মূর্তি ঘিরে বেশ কয়েকটা তাঁবু, মানুষজনের ভিড়, বেশ মেলা মেলা ভাব। চড়চড়ে রোদ হলে কি হয়, চারপাশের পাহাড়ের গা ছুঁয়ে ধেয়ে আসা কনকনে হাওয়া একেবারে অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিচ্ছে। সে হাওয়ায় নীল জলের বুক জুড়ে ওঠা ছোট ছোট ঢেউয়ের সারি ভাঙছে এসে পাড়ে।
ছোট্ট পায়ে চলা ব্রীজ পেরিয়ে পদ্মসম্ভবের কাছেও পৌঁছে গেলাম। মঞ্চের ওপরে উঠে তাঁর সঙ্গে সরাসরি মোলাকাতের ব্যবস্থা আছে। তবে তার চেয়ে চারপাশে আমার আকর্ষণ বেশী। কত রকমের পাখী, খঞ্জন, টার্ন উড়ে বেড়াচ্ছে। ভিড় করা মানুষজনের ভেতরে
মেয়েরা সব তিব্বতীয় বাক্কো পরে হাতে ফুল নিয়ে মূর্তির সামনে তাদের সঙ্গীর সঙ্গে ছবি তুলছে। উৎসবের পরিবেশ, কিন্তু উৎসব অনুষ্ঠান কিছু চোখে পড়লো না।
লেকের উল্টো দিকে রাস্তার পাশে বেশ কয়েক ঘর গৃহস্থ বাড়ী নিয়ে ছোট্ট সানি গ্রাম। সেখানেই আছে সানি গোম্ফা। তবে গোম্ফা নয়, পদ্মসম্ভবের মূর্তির পাশের মেলা চত্বরই আমাদের কাছে তখন বেশী আকর্ষনীয়।
আমাদের রকম সকম দেখে সারথি লবজং হেসেই অস্থির। বলে পরদিন মানে ২১ তারিখে গোম্ফায় আসল উদযাপন হবে। সারাদিন আশপাশের সব গ্রাম থেকে ভক্তবৃন্দ আর মনাস্ট্রি থেকে লামারা আসবেন। মুখোশ, রঙচঙে জোব্বা পরে বাজনার সঙ্গে পুরোহিতরা আরাধ্য দেবমূর্তির আরাধনায় নাচবে। গোম্ফার উঠোনের চারপাশে বসে সবাই তা দেখবে। আম জনতা মেলায় গয়না, বাসনকোসন, খাবার দাবার কিনবে, বাচ্চারা দোলনায় চড়বে। অর্থাৎ প্রধান উৎসব কাল। তাই সেদিনের মতো আমরা রণে ভঙ্গ দিয়ে আবার গাড়ীর পেটে ঢুকলাম। আর রাত কাটলো আন্দাজ পাঁচ/ছ কিমি দূর পদমের হোটেলে। কিন্তু মনে এলার্ম দিয়ে রাখলাম, কাল সানি উৎসব।

....উৎসবের বর্ণনা পরের পর্বে
Copyright belongs to Sarbani Mukhopadhyay












Address


Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Sarbaniz Soliloquy posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Videos

Shortcuts

  • Address
  • Alerts
  • Videos
  • Claim ownership or report listing
  • Want your business to be the top-listed Travel Agency?

Share