13/10/2023
উত্তরবঙ্গের অপরূপ পাহাড় জঙ্গল
রাজাভাতখাওয়া -
চা বানানোর ফাঁকে মানসবাবুকে আমি রাজভাতখাওয়া নামের উৎস সম্পর্কে, সেই পুরোনো প্রশ্নটা করেই ফেলি। শুনে, মানসবাবু তো হেসেই খুন। বলেন এ তো সবার জানা, ইন্টার প্রিটেশন সেন্টারে গেলেই তো দেখতে পাবেন।
ইতিহাস অনুযায়ী, ১৭৬৫ সালে, ত্রয়োদশ কোচ রাজা ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণের পিতা মহারাজ উপেন্দ্র নারায়নের সময় থেকেই বক্সা সংলগ্ন সমতল এলাকা ভুটানের বলে দাবি করে আসছিল ভুটানের রাজা দেবরাজ। ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ সিংহাসনে বসার সুযোগে সে দাবী জোরদার করে ভুটান রাজ তাঁর সেনাপতি পেন্সু তমের (Pensu Tome) সহায়তায়, ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ কে বন্দী করে রাজধানী পুনাখা তে নিয়ে যান। স্থায়ী রাজার অবর্তমানে, কোচ রাজ্য জুড়ে বিশৃংখলা দেখা দেয়। আর চিন্তা ভাবনা করে কোচ রাজার নাজির দেও খগেন্দ্র নারায়ণ, কোচ রাজার উদ্ধারে সহায়তার জন্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শরণাপন্ন হন। প্রথমে আমল না দিলেও, বন সম্পদ ভোগ দখলের কথা মাথায় রেখে তারা ভুটানের সঙ্গে বিনিময় চুক্তিবদ্ধ হয় আর ১৭৭৪ সালে ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ মুক্তি পান। মুক্ত কোচ রাজ ভুটান থেকে বক্সার অরণ্য পথে কোচবিহারের দিকে আসছিলেন, আর তাঁর রাজ্যবাসী তাঁকে অভ্যর্থনা জানতে উল্টোপথে যাচ্ছিল। দুই দলের দেখা হয় চেচাখাতার কাছে, অরণ্য মধ্যে আজকের এই জায়গায়; যেখানে মহারাজ ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ অন্ন গ্রহণ করেন আর জায়গায় নাম হয়ে যায় 'রাজা ভাত খাওয়া।'
সুন্দর নাম ও নামকরণ! সত্যিই ভারী সুন্দর জঙ্গলে ঘেরা এই ছোট্ট জনপদ। ফরেস্ট বাংলোর পাশ দিয়ে আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে নিউ জলপাইগুড়ি রেল লাইনের ওপরে আছে রাজাভাতখাওয়া স্টেশন। ইচ্ছে করলে বাংলো থেকেই রেল লাইনের ওপর উঠে আসা যায়; কিন্তু সকালে আমি বড় রাস্তা দিয়ে লেভেল ক্রসিং পেরিয়েই স্টেশনে উঠেছিলাম। রাজা যে সময়ে এখানে ভাত খেয়েছিলেন, তখন পুরোটাই ঘন জঙ্গল ঢাকা ছিল, সন্দেহ নেই। দু পাশের মোটা গুঁড়ি, ঝোলানো ঝুরি ওলা গাছেদের উপস্থিতি এখনও তার স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। স্টেশনের মেন গেট থেকে পথ চলে গেছে ছোট্ট খোলার ওপর দিয়ে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের দিকে। টুকটুক করে হাঁটতে থাকি সেদিকে। বনকর্মীদের কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে ডান দিকের রাস্তার ওপরে প্রথমে অর্কিড হাউজ, তার পাশে Nature Interpretation Centre ! পুরো জায়গাটা বক্সার জঙ্গলের অংশ। তবে এখন আর জঙ্গল নেই, একশ বছরেরও বেশী সময় ধরে 'সুন্দর' করে তা সাফ করে, চৌকো চৌকো রাস্তা বানিয়ে সাজানো বাগানের মতো চারপাশ। সোজা রাস্তা থেকে আবার ডানদিকে গিয়ে ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টারে ঢুকতে হয়। উদ্যোগের প্রশংসা না করে পারিনা। সুন্দর করে উদ্ভিদ, জীব বৈচিত্র্য থেকে বক্সার জঙ্গলের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা আছে নানান মডেল আর স্টাফড জীব জন্তু দিয়ে।
পাশের অর্কিড সেন্টারে নাকি এক হাজারেরও বেশী অর্কিডের সংগ্রহ আছে, যা এইখানে ও সংলগ্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়।
- ম্যাডাম! আপনি ওপরে গিয়ে দেখবেন না?.. মানস বাবুর ডাকে হুঁশ ফেরে আমার। চারপাশটা কেমন যেন একটু আবছা আবছা লাগে।
থেকে থেকে এই বর্তমান থেকে অতীতে (তো সে near past কি long past যাই হোক!) যাতায়াত, আমার এক মনের ব্যারাম। একটুক্ষণ নাকি অনেকক্ষণ উদাস ছিলাম, কে জানে!
আমার অন্যমনস্কতার ফাঁকে, সুজ্জিমামা সবুজের মাঝে আগুন জ্বেলে সেদিনের মতো বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি সেরে ফেলেছেন ততক্ষণে। আমি একাই তার প্রতিটা মুহূর্ত তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি।
এর মধ্যে আসে দুঃসংবাদ। ফোনে এ ডি এফ ও সাহেবের কাছে এক মা হাতির মৃত্যু সংবাদ আসে। হাতিটিকে নাকি আহত অবস্থায় দেখা গিয়েছিল গতকাল বেশ কিছু দূরে। যাই হোক, তার autopsy হবে, সেখানে সাহেবকে উপস্থিত থাকতে হবে। অতএব, সবাই আমরা উঠে পড়ি গাড়িতে। আমাদের বাংলোর সামনের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে সাহেবের গাড়ী চলে যায় মা হাতিটির কাটা ছেঁড়া প্রত্যক্ষ করতে।
Copyright belongs to Sarbani Mukhopadhyay