04/02/2024
এক কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি আটাশ বছর বয়সে এসে বিয়ে করবেন বলে দেশে আসলেন। বাবা-মা হুলুস্থুল হয়ে মেয়ে খুঁজছে, মেয়ে হতে হবে বাঙালি, লম্বায় পাচ ফুট তিন থেকে পাচ ইঞ্চি। এর কম না, বেশি না। রঙ ফর্সা কিংবা উজ্জ্বল শ্যামলা, উচ্চ বংশ, পড়ালিখা অনার্স পাশ। ষোল আনা চাই পরিবারের।
তিন মাসের বাংলাদেশ ভ্রমণ, এক মাসের মাথায় মেয়ে ঠিকঠাক। ষোল আনা পেয়েছিল কিনা জানিনা, তবে ছেলের জ্বলজ্বল করা চোখ দেখে মনে হল যা চেয়েছে তার চেয়ে বেশি গুণবতী মেয়ে। আমি আগ্রহ নিয়ে দাওয়াত পাওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। দাওয়াতের উদ্দেশ্য মুরগীর রোস্ট চাবানোর জন্য না, ষোল আনা পারফেক্ট মেয়েটাকে দেখা।
কথা অনেক এগিয়েছে শুনেছিলাম, তবু কেন জানি ছেলেটা পরিবার নিয়ে কানাডায় ফিরে গেল। আমার আর মেয়েটাকে দেখা হল না, নিশ্চয় কানাডায় বড় হওয়া ছেলেটা মেম সাহেব নিয়ে জীবন কাটানোর চিন্তা করেছে।
তিনমাস পর ছেলের বাবা ফিরে এল। গ্রামের বাড়ি, জায়গা জমি কি ছিল তার আবছা মনে আছে। সেই আবছা মন নিয়ে সব বিক্রি করলেন অল্প সময়ে। সব সম্পদ ক্যাশ করে যেদিন ফিরে যাবেন, সেদিন এয়ারপোর্ট এ দেখা। মানুষটা বুড়ো হয়ে গেছে কম সময়ে। এই বয়সে দরকার ছিল দেশে এসে ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে চা দোকানে আড্ডা দেয়া, ডায়াবেটিক নিয়ে বউয়ের ভয়ে লুকিয়ে সন্দেশ খাওয়া, প্রতি ওয়াক্ত নামাজ শেষে দেশ কিভাবে ধংস হচ্ছে এসব আলোচনা করা। এসব না করে যাচ্ছে কানাডায় কানটুপি পড়ে পার্কের টুলে বসে থাকতে। ভবিষ্যৎ প্ল্যানিংটাই ভুল।
বিমানের জন্য অপেক্ষা করছেন দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
-- 'সব সম্পদ বিক্রি করে চলে যাচ্ছেন? দেশে ফিরবেন না আর? ছেলের বিয়ে হলো?'
উত্তর পাইনি, অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবছেন। তার বিমানের ঘোষণা চলছে এয়ারপোর্ট এ। আমি উঠে দাঁড়ালাম। সালাম দিয়ে আসার সময় মানুষটা আমার হাত ধরে রাখল।
– 'আমার ছেলে মারা যাচ্ছে বাবা। দেশে আসার পর বিয়ে ঠিকঠাক, হুট করে ছেলের পেটে যন্ত্রনার কারনে ডাক্তার দেখালাম। ছেলে যন্ত্রনায় কু কু আওয়াজ করতো। দুইদিনের মাথায় জানা গেল ছেলের ক্যান্সার। বাঁচবে সর্বোচ্চ এক বছর। কানাডায় নিয়ে গেলাম উন্নত চিকিৎসা করাবো। সেই সুযোগ নেই, কঠিন রোগ শরীরে লুকিয়ে ছিল। এখন দামী ওষুধ, দামী হাসপাতাল দিয়ে যতদিন বেঁচে থাকে। সব বিক্রি করে নিয়ে যাচ্ছি। আমার ছেলের জন্য দোয়া করো বাবা, আলৌকিক কিছু যেন হয়।'
মানুষটার বিমান ছেড়ে দিবে, লম্বা পা ফেলে চলে যাচ্ছেন। চোখে পানি নেই, হয়তো সব পানি শুকিয়ে গেছে। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, কিছুই বলার ছিল না।
ছেলেটা এক মাসের মধ্যে মারা গেল। আলৌকিক কিছু বাঁচাতে আসেনি। আমি যেদিন তার মৃত্যুর খবর শুনেছি সে রাতে অফিস থেকে ফিরে তার ফেসবুক দেখলাম। মৃত্যুর দুদিন আগে তার শেষ স্ট্যাটাস ছিল দুই লাইনের একটা শত কোটি টাকার দামী বাক্য -
– 'যদি তোমার একটা সুস্থ শরীর থাকে, তবে,
খোদার কাছে আর কোন বিষয়ে অভিযোগ কর না।'
---------
লেখা || শাখাওয়াত সাব্বির