15/11/2023
রহস্যে মোড়া এই শহরে কোনো মানুষ বাস করে না
অঞ্জন কুমার মাইতি
9732 835 433...................................................................................
২০১১ সাল। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম - সে এক ইতিহাস। ২০১৭ সালে ঝাড়খণ্ডে উস্রি নদীর ঝরনা দেখতে গিয়ে হাতির তাড়া খেয়ে ভাত-তরকারি ফেলে রেখে ছুট দিতে হয়েছিল - এও এক ইতিহাস। এরকমই অ্যাডভেঞ্চারাস বাইক ট্রিপ আমরা অনেক করেছি। কিন্তু এ বারের যে অভিজ্ঞতা তা সত্যিই রোমহর্ষক।
কলকাতা থেকে মাত্র ১৬৫ কিলোমিটার, চন্দ্রকোনা রোডের অনতিদূরে অবস্থিত রহস্যে মোড়া এই শহর। ১০ বর্গ কিলোমিটার এর বেশি জায়গা নিয়ে ২০০৯ সালে একটি বেসরকারি সংস্থা এই শহর নির্মাণ করার কাজ শুরু করেছিল। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম এই ফ্লিম সিটির উদ্বোধন করের বলিউড বাদশা কিংখান ২০১২ সালে।
ঘড়িতে ২:০০ বাজাটা আমাদের কাছে একটি unique time. এখন পর্যন্ত আমরা যত bike trip করেছি, তার বেশিরভাগই ২:০০ তেই শুরু করেছি। যেমন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, ঝাড়খণ্ড, পূর্ব মেদিনীপুর আমরা যতবার গেছি প্রতিবারই রাত্রি ২:০০ তেই আমাদের বাইকের চাকা গড়িয়েছে। আবার গনগনি, ৫৮ গেট, আরামবাগ রিসোর্ট, গড় মান্দারণ, কামারপুকুর যখন গেছি তখন দুপুর ২:০০ তে বাইকের চাকা গড়িয়েছে। তাই ঘড়িতে ২:০০ বাজা আমাদের কাছে একটা unique time.
আর এবারও দুপুর ২:০০ তেই আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম রহস্যে মোড়া এই শহরের পথে। আমাদের বাড়ি থেকে এই শহর ঢিলছোঁড়া দূরত্বে অবস্থিত, মাত্র ৫৫ কিলোমিটার। আমরা যখন শহরের সিংহদ্বারে এসে পৌঁছায় তখন ঠিক পৌনে ৪:০০। তাহলে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে - এত দেরি কেন? চন্দ্রকোনার কেঠিয়া খালের সঙ্গে আমাদের এক আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। ওই পথে গেলে একবার বাইক থেকে না নেমে কখনো যাওয়া হয়নি। তারপর আছে চন্দ্রকোনা মোড়ে ঠাকুরের ফাস্টফুড। ওখানে গিয়ে লজ্জা লজ্জা করে আড়াই কেজি করে ওজন বাড়িয়ে নিই। আর তারপর হাতমুখ ধুয়ে প্রতিজ্ঞা করি - কাল থেকে no fast-food কাল থেকে ডায়েট করব। এমনি করে দেরি হয়। তারপর ভ্রমণ পথে মধ্যে মধ্যে বিচিত্রবেশী প্রকৃতি সেজে গুজে বসে থাকে, হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে তার অপার সৌন্দর্যে মিশে যেতে। প্রকৃতির এই অমোঘ টান আমরা কি উপেক্ষা করতে পারি? ফ্রেমবন্দী সেলফি এসব করেই আরো কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়।
এখন ঘড়িতে ৩:৪৫ । আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি রোড চন্দ্রকোনা থেকে একটা মোরাম রাস্তা ধরে আরো ছয়-সাত কিমি দক্ষিণে একটা আদিবাসী গ্রাম প্রান্তরে রহস্যে মোড়া শহর প্রয়াগ ফ্লিম সিটির সিংহদ্বারে। দেখলাম সদর দরজা বন্ধ রয়েছে। কিন্তু একটা ছোটো দরজা খোলা। সেই পথেই আমাদের বাইক নিয়ে প্রবেশ করতে হবে। অনুমতি নিয়ে ভিতরে ঢুকতে যাবার উপক্রম দেখে লোকটি দু নম্বর কাউন্টারে যাবার নির্দেশ দিলো। প্রবেশমূল্য মাথা পিছু ৩০০ টাকা। ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুললে আরো অতিরিক্ত মূল্য দিতে হবে শুনে বুলা বলল, 'আমরাতো ইউটিউবার। আমরা ভিডিও বানালে তবেইতো মানুষ এখানে বেশি বেশি আসবে।' তারপর লোকটি কারোসাথে ফোনে বিড় বিড় করে দু-চার কথা কয়ে নিল। তারপর লোকটি আমদের ভিতরে যেতে বললেন। পাশাপাশি এও বললেন আমাদের আর ছবি তোলার জন্য অতিরিক্ত মূল্য দিতে হবে না। আমরা মহানন্দে ভিতরে প্রবেশ করলাম।
সিংহদ্বার অতিক্রম করে বাইকের চাকা সবেমাত্র কয়েকপাক গড়িয়েছে, দেখতে পেলাম সামনেই ডানদিকে বিমান বন্দর। যাত্রী ছাড়াই বিমান দাঁড়িয়ে রয়েছে। বামদিকে বিরাট রাজপ্রাসাদ। একটার পর একটা গেট পার হয়ে পৌঁছালাম রাজ সিংহাসনে। রাজ্য জুড়ে একটাও প্রজা নেই, মন্ত্রী নেই, রাজা নেই - শুধু আমরা দুজন। চারিদিকে একটা নিস্তব্ধ, থমথমে পরিবেশ। সেদিকে আমাদের বিন্দুমাত্র হুঁশ ছিলো না। সিংহাসন কেন খালি থাকবে? বুলাকে মন্ত্রীর আসনে বসতে বলে, নিজে গিয়ে রাজ সিংহাসনে বসলাম। তারপর নিজে মন্ত্রীর আসনে বসে বুলাকে সাম্রাজ্যের রাজা বলে ঘোষণা করে দিলাম। এমনি করে বেশ কিছুটা সময় কাটলো। তারপর এগিয়ে চললাম শহরের আরো সামনের দিকে।
দেখতে দেখতে এখন আমরা সিংহদ্বার থেকে শহরের প্রায় চার কিলোমিটার ভিতরে চলে এসেছি। আয়রন স্ট্রাকচারের উপর অরিজিনাল কংক্রিটের বাড়ির মতো বিরাট বিশাল বিল্ডিং গুলো সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাঝখান দিয়ে শহরের সরু পথ। বাইক নিয়ে যাবার পথে মাঝে মধ্যে কাঁটার ঝাপটা হজম করতে হচ্ছে। কোনো কোনো বিল্ডিং মরিচা পড়ে বিপজ্জনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।
নিস্তব্ধ। শহরের ওলিতে গলিতে বাইক নিয়ে প্রায় এক ঘন্টা সময় ঘুরলাম। একটা মানুষ তো অনেক দূরের কথা, একটা কুকুর - বিড়ালের সাথেও দেখা হলো না। প্রকাণ্ড এই শ্মশান ভূমিতে আমরা এই দুইজন মানুষ ছাড়া এই শহরে আর কাউকে দেখতে পেলাম না। সূর্যের রঙ তখন লাল হয়ে এসেছে। এই নির্জন শহরের মাঝে আমরা অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থায় আছি বলে মনে হলো। তারপর পিছন ফিরে দেখি ২৫ - ৩০ মিটার দূরে একটা লোক হনহন করে এগিয়ে গিয়ে একটা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল।
শহরের এতটা দূরে এই নির্জন পোড়ো বাড়িতে কে থাকতে পারে ভেবে আমাদের গায়ের লোম তখন সোজা হয়ে গিয়েছিল। গোলা শুকিয়ে আসছিল। এক মুহূর্ত আর দেরি না করে দ্রুত ঐ স্থান থেকে আমরা বেরিয়ে আসি। আর কোথাও সময় নষ্ট না করে যখন শহরের সেই মূল প্রবেশদ্বারের কাছে এসে উপস্থিত হয়ে দেখি WB POLICE এর একটা জিপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, দুদিন আগে ঐখানে একটি মার্ডার হয়েছে। …..কিন্তু লাশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!!!
……এক দোকানদারকে সম্বোধন করে - কাকা, একটু জল খাচ্ছি।