23/11/2020
ঘুরে এলাম সান্দাকফু থেকে
পশ্চিমবঙ্গ ভারতবর্ষের একটা ছোট প্রতিরূপ। তাকে সাগর, বনভুমি, ঝরনা, পাহাড় দিয়ে যে মনিমালা সাজিয়েছে তারমধ্যে অন্যতম প্রধান মনিটি হলো দার্জিলিং। যেন পশ্চিমবঙ্গের মাথায় একটি উজ্জ্বল হীরে; যার ছটা ছিটকে পরে পশ্চিমবঙ্গকে আরও মহিমান্বিত করছে। আর দার্জিলিঙের একটু বাঁদিকে একটু সরে গিয়ে সান্দাকফু শুধু পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ স্থান নয়, সান্দাকফু পৃথিবীর একমাত্র মোটরচালিত জায়গা যেখান থেকে হিমালয়ের একসাথে চারটি সর্বোচ্চ শৃঙ্গ দেখা যায়। সাথে আরও কত কি!
মানেভঞ্জন থেকেই আপনার সঙ্গী পাইনের ঘন বন, আবছা অন্ধকার আর তার বুক চিরে মসৃণ পিচের রাস্তা। বনের নিস্তব্ধতা চিরে আপনার বাহনের যান্ত্রিক আর্তনাদ। হটাৎ জঙ্গল চিরে আপনার সামনে হাজির ছোট্ট পাহারী গ্রাম চিত্রে। একটি বৌদ্ধ গুম্ফা চিত্রের পরিবেশকে আরও ভাব-গম্ভীর করে দিয়েছে। আগে পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ। পেছন ফিরে দূরে ছবির মত সুন্দর চিত্রে। একটু এগিয়ে লামিধুরা – আর একটি ছোট্ট জনপদ। আপনার বাহনকে একটু বিশ্রাম দিতে হয়তঃ এক কাপ চা সঙ্গে ডিম ভাজা – বাঙালির মামলেট। মুখে ডিমভাজা নিয়ে একবার ডানদিকে তাকিয়ে দেখুন, প্রকৃতি প্রসন্ন হলে মাউন্ট পান্ডিম আপনাকে স্বাগত জানাতেই পারে। আপনার জীপ আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে প্রস্তুত। সামনে মেঘমার বৌদ্ধ মন্দির আপনাকে জানান দিচ্ছে আপনি বিদেশ-বিভূঁই থেকে কয়েক ফুট দূরে মাত্র। পুঞ্জীভূত মেঘ কুয়াশার মাঝে ডানদিকের রাস্তা দিয়ে সোৎসাহে এগিয়ে চলে আপনার বাহন; মনে সাময়িক চাঞ্চল্য! এবার কী? হঠাৎই সমস্ত বাস্তবতাকে দূরে সরিয়ে আপনি হাজির হন এক অপরূপ স্বর্গরাজ্যে! অপার বিস্ময়ে আপনি দেখছেন আপনার সামনে শুভ্রকান্তি ধ্যানস্থিমিত শায়িত লিটল বুদ্ধ! আপনার প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপালের মাটি - তুমলিংএ আজ রাত্রিবাস। সন্ধ্যা নামার আগে হিমশীতল তীক্ষ্ণ হাওয়া আপনার মর্মে প্রবেশ করে, ঠাণ্ডার তীব্র হুল ফোটায়।
পরদিন সকালে হিমঘর ছেড়ে সামনে এসে প্রাণভরে দেখতে এলেন কাঞ্চনজঞ্ঘার পরিবারকে। অবর্ণনীয় সে দৃশ্য। সামনে কাব্রু সাউথ, কাব্রু নর্থ, কাব্রু ডোম, শিম্বু, গোচা, পান্ডিমের গুষ্টিবর্গ নিয়ে কাঞ্চনজঞ্ঘার সংসার। দূরে থ্রী সিস্টার তার হাতছানিতে আপনাকে সান্দাকফুর পথে টেনে নিয়ে যাবে, আজই। কিছু প্রাতরাশ সেরে আপনি বাহনে আসীন হলেন। গন্তব্য পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ স্থান সান্দাকফু। সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যানের গেট পেরিয়ে আলো-আবছায়ার ঘন জঙ্গল চিরে মসৃণ পথে বাঁদিকে কাঞ্চনজঞ্ঘার পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা হলো শুরু। পথে গৈরিবাসে আপনার বাহন একটু জিরিয়ে নিয়ে শুরু হলো পাথর বাঁধানো রাস্তায় তিরিং বিড়িং যাত্রা। আপাতত এটাই চলল শেষ পর্যন্ত। কালিপোখরি পৌঁছে একটু বিরতি। সমস্ত পথের ঝাঁকুনিকে অগ্রাহ্য করে মন পড়ে রইল সান্দাকফুর প্রতি। আমাদের সারথি আমাদের দূরে, সান্দাকফুর হোটেলের মাথা দেখিয়ে আরও মন চনমনে করে দিলেন। ভিখেভঞ্জ হয়ে চললাম শেষ চড়াই চড়তে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমাদের এতদিনের সাধের আমাদের এতদিনের পরিকল্পনার সমাপ্তিতে – সান্দাকফুতে। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। নীল আকাশের ক্যানভাসে একটার পর একটা শ্বেতশুভ্র তুষারগিরি নিয়ে দেবালয়। চোখ ফেরালে দূরে দেখা যায় এভারেষ্ট মাকালু লোতসে হাতছানি দিচ্ছে। যেন এক একটি শ্বেতশুভ্র জটাজুটধারী ঋষি সব ধ্যানে বসে আছেন। কিছু পরেই দেখা গেল তাদের জটায় সোনার জল ঢেলে দিল সূর্যের দিনশেষের আলো। ক্রমশ লাল আভা বিবর্ণ হয়ে অন্ধকার নামে। হোটেলের ঘরে গরম গরম খাবার পরিবেশন শীতের কাঁপুনি থেকে বাঁচতে দারুন লাগে। অন্যান্য সহযাত্রীদের হৈ-হল্লা, হাসি-ঠাট্টা, উচ্চ স্বরে গান ইত্যাদি শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়বেন। রাত শেষে মেঘমুক্ত সুনীল আকাশে দেখবেন সেই ঋষিদের মাথায় গৈরিক আভা। ওদিকে সূর্য ততক্ষণে এভারেস্টের সারা শরীর গেরুয়া চাদরে মুড়ে দিয়েছে।
যাত্রাশেষে বাড়ি ফেরার পথে মন পড়ে থাকে সেই উদাসীন ধ্যানমগ্ন, শান্ত সুন্দর ঋষিরাজ্যের প্রতি।
যোগাযোগ : 9433153218
লেখকঃ শ্রী সুজিত বিশ্বাস
কাশীপুর গানশেল ফ্যাক্টরি
