04/06/2022
আমার প্রথম সাদা পাহাড় অভিযান।
#বালি_পাস চতুর্থ পর্ব ঃ
স্লিপিং ব্যাগে ঘুমাতে ট্রাই করছিলাম কিন্তু কোন ভাবেই যেনো আমার ঘুম আসছিলো না। আমি এপাশ ওপাশ করতে ছিলাম। এর মধ্যেই হটাৎ করে প্রান্ত ভাইয়ের অনেক কাশি বেড়ে যায়। উনি কাশি দিলে মনে হচ্ছিলো পুরো ঘরটাই নড়ে উঠছিলো। তাতে মোটামুটি সবার ঘুমানো চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেলো। আমি স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে গেটের পাশে শুয়ে পড়লাম। যাইহোক কোন রকমে রাতটা পার করলাম। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে সবাই ট্রেকিং এর জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। হটাৎ করে প্রান্ত ভাই এবং টিমের আরেকজন সদস্য আমাদেরকে জানালেন যে তারা আর সামনের দিকে যাবেন না। আজকে তারা এখান থেকেই পিছনের দিকে ফিরে যাবেন। আমরা তাদেরকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়ে আমাদের এজেন্সি কতৃপক্ষকে জানালাম তারপর তাদের পরামর্শ নিয়ে টিম থেকে ২ জন বিদায় নিলো। বাকী টিমে এখন আমরা মাত্র ৪ হয়ে গেলাম। আমরা সামনের দিকে হাটা শুরু করলাম। আমাদের গাইড আমার হাটার গতি দেখে আমাকে জানালেন আমি যেনো সামনের Y জাংশন দেখামাত্রই দাড়িয়ে যাই।সাধারণত আমি বান্দরবান কোন টিম নিয়ে গেলে টিমের সবচেয়ে সামনেট মেম্বারকে এই কথা বলে থাকি। যাইহোক আমি গাইডের প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে লাগলাম। এরমধ্যেই যতই সামনে যাচ্ছি প্রকৃতি যেনো আমাকে ততই মুগ্ধ করছে। প্রকৃতির রুপ সৌন্দর্যের টানেই আমি দেশের সীমানা পার হয়ে হাজার মাইল দূরের এক ট্রেইল ধরে হাটছিলাম। আমার কাছে বারবার মনে হচ্ছিলো আমার সব কষ্ট এবং টাকা সবকিছুই যেনো পরিপূর্ণতা পেয়ে গেছে। এই এক কঠিন নেশা যে নেশা আমাকে চুম্বকের মতো করে টেনে সামনে নিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে খোলা নীলাভ আকাশের যে কতটা বৈচিত্র্যময় রুপের আয়োজন। চারদিকের বিশাল আকৃতির পাথুরে খাড়া পাহাড়ের বুকে ঘন সবুজ বনের সমারোহ। মনে হচ্ছিলো পাহাড় গুলা যেনো সবুজ চাদরে নিজেকে আবৃত করে রাখছে এবং সেই চাদর গায়ে দেওয়া পাহাড়ের মাথায় সন্নাসীর মাথার পাগড়ির মতো বিশাল সাদা বরফ ঢাকা টুপি পড়ে পাহাড় গুলাও আমাদের সাথে হাটছে। আমার হাটার গতির তুলনায় ক্যামেরা ব্যাবহারের গতি ছিল অনেক বেশি। অসম্ভব সুন্দর এরকম নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক রুপ আমার হাটার গতিপথ রুদ্ধ করে চলছে। এরমধ্যেই একটা লম্বা উচু পথে উঠা শুরু করলাম, যতই উপরের দিকে উঠছি আর সামনে থেকে একটা ঝর্ণার পানির কলকল শব্দ যেনো আমাকে আরো জোরে টেনে উপরে নিয়ে যেতে লাগলো। আমি ঝর্ণা প্রিয় মানুষ, এই শব্দের মোহ আমাকে চুম্বকের মতো টানছিল। আমি দ্রুত উপরে উঠেই দেখলাম বিশাল এক ঝর্ণা যা কিনা অনেক উচুতে সাদা পাহাড়ের চূড়া থেকে বরফ গলে গলে সবুজের বুকে চিরে নিচের দিকে সাদা দুধের মতো করে গড়িয়ে আসছে।
ট্রেইলে কখনো আমি আমার নিজের ছবি তেমন একটা তুলি না। কিন্তু এটা এমন স্বর্গীয় একটা ট্রেইল যার বুকে দাড়িয়ে নিজের ছবি থাকবে না এটা মানা যায় না। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার টিমের বাকী সবাই অনেক দূরে। কিছুক্ষণ পরে সজল ভাই আসলেন, উনাকে দিয়ে নিজের কিছু ছুবি উঠালাম এবং উনাকেও কিছু ছবি তুলে দিলাম।উনি বলতে লাগলেন " ভাই আপনি যেভাবে অনবরত ছবি তুলে যাচ্ছেন,আপনার মেমোরি কার্ডে মনে হয় না আর জায়গা ফাকা থাকবে"! আমি বললাম আজকে রাতে আবার ফাকা করে নিবো। আমরা ২ জন কথা বলতে বলতে সামনে একটা সমতল জায়গা দেখে পিছনের বাকী সবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। চারদিকে স্টেডিয়ামের গ্যালারির মতো বিশাল বড় বড় পাহাড়ের মাঝে একটা সবুজ সমতল মাঠ, যার এক কোণ দিয়ে বিশাল একটা ঝর্ণা উপর থেকে নিচে গড়িয়ে এসে নিচের দিকে বহমান নদীর বুকে আচড়ে পড়ছে। বরফ গলা সাদা পানির নদী এবং ঝর্ণার পানি, ২ টার সংমিশ্রণের শব্দ সবমিলিয়ে এই পরিবেশটার কাছে যেনো পৃথিবীর সকল রুপ সৌন্দর্য হার মানতে বাধ্য!! কিছুক্ষণের মধ্যেই টিমের বাকী সবাই চলে আসছে,আমরা সবাই ব্যাগ থেকে শুকনা খাবার বের করে খেতে লাগলাম। এদিকে আমার ফোনের ক্যামেরা চলমান, যদিও আমি আমার ফোনের ক্যামেরার উপর চরম লেভেলের বিরক্ত। বারবার বলছিলাম যদি জানতাম যে এতটা ভয়ংকর সুন্দর হবে তাহলে আমি হয়তো আগে ভালো একটা মোবাইল বা ক্যামেরা কিনতাম, তারপর এখানে আসতাম। নেক্সট টাইম আগে এটাই করতে হবে।
অনেকক্ষণ রেস্ট করার পরে আমি উঠে দাড়ালাম, এবং কিছুদূর এগিয়ে গেলাম। এরমধ্যেই আমাদের সামনে একটা ব্লাক পিক করে আসা ফিরতি টিমের ক্যাম্প দেখা গেলো। আরো সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরে তাদের টিম মেম্বারদের একেকজনের চেহারার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বরফের অত্যাচারের ভয়ংকর ছাপ স্পষ্ট হতে লাগলো। তাদের থেকে আমাদের গাইড জেনে নিলেন উপরের আবহাওয়ার অবস্থা খুব একটা ভালো না। তবে আশা করা যায় যে কোন মুহূর্তেই ভালো হতে পারে। আমরা হাটতে লাগলাম আমাদের গাইড দ্রুত সবার সামনে চলে গেলেন। তিনি একটা জায়গায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।আমি ছবি তুলতে তুলতে সামনের দিকে যাচ্ছিলাম। বাম পাশে অনেক দূরের পাহাড়ের বুক ট্রেইল ধরে হারকিদুন যাওয়ার মুসাফিরদেরকে দেখা যাচ্ছিলো। মানুষ এবং গাদা গুলাকে পিপড়ার মনে হতে লাগলো। দূর পাহাড় থেকে এরকম দৃশ্য বেশ উপভোগ করার মতো ছিলো। আমাদের টিমের গাইডের সাথে দেখা হলো তিনি আমাকে নিচের দিকের জংগলের ভিতর দিয়ে নদীর পাশ ঘেঁষে এগিয়ে যাওয়া একটা রাস্তার দিকে ইংগিত করে সে পথে এগিয়ে যেতে বললেন এবং বললেন বাকী সবাইকে উনি নিয়ে আসছেন। আমি উনার কথা মতো দ্রুত নেমে যেতে লাগলাম। এখানে নামতে গিয়ে খেয়াল করলাম যে এই প্রথম কোন একটা পথ পেলাম যেটা আমাদের বান্দরবানের রাস্তার মতো কোন পাথুরে ভাজের মতো সিড়ি করা নাই। এখানের প্রতিটি উচু নিচু পথেই ছোট ছোট পাথর দিয়ে ভাজ করে সিড়ি করে রাখা, যাতে করে কারো উঠা বা নামাতে কোন প্রকার কষ্ট না হয়। সিড়ি গুলা এমন ভাবে করা যেগুলো আমাদের দেশের বিল্ডিংয়ের সিড়ির তুলনায় হাটা অনেক সহজ। দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো এরকম গহীন পাহাড়ের মাঝেও তারা যেহেতু ট্রেকারদের জন্য এতো দারুণ ব্যবস্থা করে রাখছে পারছে, তাতে করে এটা স্পষ্ট যে তাদের সরকার টুরিস্টদের নিয়ে কতটা চিন্তা করে!!
আর অন্যদিকে আমাদের দেশের অবস্থা কতটা ভয়ংকর!!! এমনকি তাদের ট্রেইল গুলা এতটা চমৎকার ভাবে বানানো যেখানে একজন নতুন মানুষের কখনো হারাবে না। যাইহোক আমি নামতে নামতে নদীর দিকে এগিয়ে গেলাম,সামনে গিয়ে আরো অবাক হলাম যে নদী পার হওয়ার জন্যও সেখানে কাট দিয়ে দারুণ ব্রীজ করে দেওয়া। অথচ তাদের পাহাড়ের ট্রেইলে সবুজ ঘন জংগল থেকে একটা গাছ ও তারা কাটে না। তারা কেবলমাত্র সেই গাছটা কাটে যেটা মরে গেছে বা বাতাসে পরে গেছে। টুরিস্টদের জন্য তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম আর আমাদের নিজেদের সাথে তুলনা করছিলাম। ট্রেইলের কোন জায়গায় কোন প্লাস্টিকের বর্জ্য নাই। আহা কি দারুণ সচেতন এই প্রদেশের মানুষ গুলা!! আমি ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে কুকার অংকিত ভাইকে দিয়ে আমার কিছু ছবি তুলে নিলাম। এরমধ্যেই হটাৎ বৃষ্টি শুরু হলে অংকিত ভাই দ্রুত সামনের দিকে করতে চাইলেন।আমি বললাম আপনি যান আমি এখানে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় একটা পাথরের নিচে আশ্রয় নিবো। উনি দ্রুত চলে গেলেন আমি পাথুরের নিচে গিয়ে ব্যাগ রেখে বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমি নিয়ত করছিলাম ট্রেইলে আমি এই পঞ্চ ছাড়াই শেষ করবো। যখন একদম না ব্যবহার করলেই না তখন ছাড়া এই পঞ্চ ব্যবহার করতে আমি আগ্রহী না। যাইহোক কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি থেমে গেলে আমি আবার দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলাম।সম্ভবত ১০-১৫ মিনিট হাটার পরেই আমাদের এজেন্সি কতৃপক্ষকে দেখা গেলো।তারা গাদার মালামাল নামাচ্ছে এবং আমাকে দেখে বল্লো যে আজকে এখানেই আমাদের ট্রেকিং শেষ। আমি অবাক হয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ভেলা ১২ঃ৪৫ মিনিট!!! নিজেকে বিশ্বাস হচ্ছিলো না,মাত্র ১২ টা বাজে আর তারা বলতেছে এখানেই নাকি ট্রেকিং শেষ। অথচ আমরা আমাদের দেশে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা ট্রেকিং করে অভ্যস্ত! যাইহোক আমি ব্যাগ নামিয়ে একটা নদীর পাশে একটা ঘরে বসলাম ২০-২৫ মিনিট পরেই আমাদের টিমের বাকি সবাই চলে আসলো। তাদেরকে আমি জানালাম যে আজকের জন্য এখানেই ট্রেকিং শেষ। এটা শুনে কেউ বিশ্বাস করছিলো না।যাইহোক আমরা ব্যাগ রেখে সবাই গল্প করা শুরু করে দিলাম। অল্প কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম আমাদের জন্য খাবার ও প্রস্তুত। এখানে প্রচুর বাতাস ফলে ভয়ংকর ঠান্ডা লাগছিলো। সবাই দ্রুত আমাদের জন্য নির্ধারিত টেন্টে গিয়ে ডুকলাম। আমি কিছুক্ষণ পরে আবার বের হয়ে অজু করে নামাজ আদায় করে নিলাম। তারপর আবারো ছবি চারদিকের মায়াবী রুপ সৌন্দর্যকে ক্যামেরায় বন্দী করতে ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। গাইডকে জিগ্যেস করলাম এই জায়গার নাম কি? উনি জানালেন এটা ওয়াটার ফলস এরিয়া, সামনে ওয়াটার ফলস।
চলবে.........