29/06/2024
টাইটানোবোয়া: প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সাপ
আজ থেকে প্রায় ৬ কোটি বছর পূর্বে কলম্বিয়ার জলাভূমিতে ছিল বিশালাকৃতির সরীসৃপের বাস। বাস্তুতন্ত্রে ত্রাস সৃষ্টি করা এই সরীসৃপ হলো মূলত অতিকায় বৃহৎ এক সাপ। প্রাণীবিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন টাইটানোবোয়া। ২০০৯ সালে সর্বপ্রথম যখন টাইটানোবোয়ার জীবাশ্মের সন্ধান পাওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল সরীসৃপটি ১২.৮ মিটার (৪২ ফুট) লম্বা। এই আবিষ্কারের ফলে ভেঙে যায় পূর্বে আবিষ্কৃত সর্বোচ্চ লম্বা সাপ গিগানটোফিসের রেকর্ড। টাইটানোবোয়ার আগে গিগানটোফিসকে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ লম্বা সাপ (৩৫ ফুট) হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশন নির্মিত ‘টাইটানোবোয়া: মনস্টার স্নেক’ ডকুমেন্টারিতে বলা হয়েছে, টাইটানোবোয়ার দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪.৬ মিটারের (৪৮ ফুট) কাছাকাছি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ান জাদুঘরে টাইটানোবোয়ার একটি রেপ্লিকা প্রদর্শন করা হয়েছে। প্রদর্শিত রেপ্লিকায় বিশাল আকৃতি দেখে যারপরনাই অবাক হতে হয়।
৬ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা আজকের তাপমাত্রার চেয়ে বেশি ছিল বিধায় তখন টাইটানোবোয়ার দৈর্ঘ্যও ছিল সাধারণ অ্যানাকোন্ডা বা অজগর সাপের চেয়ে বেশি। একেকটা টাইটানোবোয়া আজকের যুগের অ্যানাকোন্ডার চেয়ে আকারে ১০-১২ গুণ বড় হতো।বর্তমানকালে প্রাপ্ত সাপেদের মধ্যে দৈর্ঘ্যে সবচেয়ে লম্বা সাপ হলো গ্রিন অ্যানাকোন্ডা (Eunectes murinus), যা ৩০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
এবার আলোচনা করা যেতে পারে টাইটানোবোয়ার লিঙ্গ নিয়ে। সাপেদের ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায়, পুরুষ সাপের চেয়ে স্ত্রী সাপ আকারে বড় হয়। যেহেতু ডাইনোসরের মতো টাইটানোবোয়ার জীবাশ্মের এত আধিক্য নেই, তাই এই সরীসৃপের পুরুষ-স্ত্রীর দৈর্ঘ্য নিয়ে বিজ্ঞানীরা আপাতত কিছু বলতে রাজি নন। ধরে নেওয়া যেতে পারে, টাইটানোবোয়ার ক্ষেত্রেও পুরুষদের চেয়ে স্ত্রী সাপ আকারে বড় হতো বেশি।
বসবাসের স্থান
টাইটানোবোয়ার জীবাশ্ম পাওয়া গেছে শুধু দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ার সেরেহন নামক এক কয়লাখনির অঞ্চলে। পৃথিবীতে টাইটানোবোয়াদের অস্তিত্ব ছিল প্রাগৈতিহাসিক সিলান্ডিয়ান অধিযুগে। ভূতাত্ত্বিক সময়রেখা বিবেচনা করলে সে সময়কাল হচ্ছে, আজ থেকে প্রায় ৬০ মিলিয়ন (৬ কোটি) বছর পূর্বে এবং ক্রিটেসিয়াস-টারশিয়ারি গণবিলুপ্তির ৫ মিলিয়ন বছর পর। অর্থাৎ, সেসময় মেসোজয়িক যুগের সমাপ্তি ঘটেছিল বলে পৃথিবীতে ডাইনোসরের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ওই সময়ে টাইটানোবোয়া রেইনফরেস্ট অঞ্চলে বসবাস করত।
শিকার পদ্ধতি
টাইটানোবোয়া না ছিল বিষধর, না ছিল বিষাক্ত। যেসকল সাপের বিষ নেই, শিকারকে কাবু করার জন্য তাদের সাধারণ পদ্ধতি হলো, শিকারকে শক্তভাবে পেঁচিয়ে দমবন্ধ করে মেরে ফেলা। টাইটানোবোয়া তার শিকারকে পেশি দ্বারা চেপে ধরে শ্বাসরোধ করত, যাতে শিকারের ফুসফুস বায়ু থেকে কোনো অক্সিজেন গ্রহণ করতে না পারে। তীব্র অক্সিজেন সংকটে ভুগা শিকারটিকে তখন জীবিত অথবা মৃত পেটে চালান করে দিত সাপটি। এখনকার অজগর বা অ্যানাকোন্ডার মতো তারা শিকার ভক্ষণের জন্য তাদের মুখকে শরীরের তুলনায় দশগুণ বেশি প্রসারিত করতে পারত। যেহেতু তাদের বিষ ঢালার ব্যবস্থা ছিল না, তাই সূক্ষ্ম দাঁতের বদলে তাদের উপস্থিত থাকত শক্ত ধারালো দাঁত।
আংশিক মাথার খুলি এবং চোয়ালের হাড় থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন, টাইটানোবোয়ার মুখের মধ্যে সারি সারি বাঁকানো দাঁত থাকতে পারে। শিকারকে হত্যা করতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগলেও শিকার খাওয়ার সময়টা যথেষ্ট দীর্ঘ হত। টাইটানোবোয়ার মাথার গঠন অন্যান্য সংকোচন-প্রসারণক্ষম অ্যানাকোন্ডার মতোই ছিল। তাদের নীচের চোয়াল মাথার খুলির পিছনের দিকে প্রসারিত হতো, যা তাদের মুখ অধিক পরিসরে নড়াচড়া করতে সাহায্য করত।
শিকারকে একবার পেটে চালান করে দিতে পারলে, পাকস্থলীর তীব্র ও শক্তিশালী অ্যাসিড সেই শিকারের মাংস এবং হাড়কে গলিয়ে দিত। শিকার হজম হতে কত সময় লাগত তা অবশ্যই শিকারের আয়তনের উপর নির্ভর করত। শিকার বধের পরিপ্রেক্ষিতে, টাইটানোবোয়া গাছে চড়ার চেয়ে গাছের নিচেই বসে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। বিশালাকৃতির শরীরের অধিকারী হওয়ায় মাটিতে অবিরাম গতিতে চলতেও তার সমস্যা হতো, যেটার মুখোমুখি হ্যাংলা-পাতলা গড়নের ছোট সাপগুলোর হতে হয় না। টাইটানোবোয়া হয়তো কোনো ঝোপঝাড়ের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকত। পাশে দিয়ে কোনো শিকার গেলেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত।
স্থলভাগের চেয়ে জলভাগে টাইটানোবোয়া ছিল কয়েকগুণ বেশি স্বতঃস্ফূর্ত। জলে টাইটানোবোয়া ছিল এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। জলে শরীরের ভার বহন করার সুবিধা পাওয়ায় সে ছুটতে পারত কয়েকগুণ দ্রুত গতিতে, এবং শক্তিও তুলনামূলক কম ব্যয় হতো। জলে থাকার আরেকটি সুবিধা ছিল, সে তার শরীরের অনেকখানি অংশ পানিতে ডুবিয়ে রেখে শিকারের চোখে ধুলো দিতে পারত। এছাড়াও টাইটানোবোয়া জলের নিচে অধিক সময় শ্বাস ধরে রেখে জলের নিচ থেকে শিকারকে আক্রমণ করতে পারত।
খাদ্যাভ্যাস
টাইটানোবোয়ার খাদ্যাভ্যাস আজকের যুগের অজগর, অ্যানাকোন্ডার চেয়ে আলাদা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, ৬০ মিলিয়ন বছর পূর্বের প্রাণীকুলের সাথে আজকের যুগের প্রাণীকুলের বিস্তর ফারাক। টাইটানোবোয়ার খাদ্যতালিকায় কী কী প্রাণীর উপস্থিতি ছিল, তা বের করতে হলে তৎকালীন দক্ষিণ আমেরিকার বাস্তুসংস্থানের দিকে নজর দিতে হবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী, তাদের প্রধান খাদ্য ছিল Cerrejonisuchus, Acherontisuchus এবং Anthracosuchus গণের কুমির। যদিও প্রাগৈতিহাসিক কুমিরেরা ছিল মারাত্মক ভয়ংকর, এবং ৩৫ ফুট লম্বা ডেইনোসুকাস কুমিরেরা ডাইনোসর খেয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখত। তবুও, টাইটানোবোয়া তাদের শরীর দিয়ে আস্ত কুমিরকে পিষে মেরে ফেলতে সক্ষম ছিল। এখন যুগের অ্যানাকোন্ডা-অজগরকেও আস্ত কুমির গিলে ফেলতে দেখা যায়।
কুমির ছাড়াও প্যালিওসিন যুগে ওইখানের বাস্তুতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ ছিল ‘Carbonemys‘ and ‘Puentemys‘ গণের বৃহদাকৃতির কচ্ছপ। আকারে বেশি বড় হওয়ায় টাইটানোবোয়া তাদেরকে আস্ত গিলে ফেলতে পারত না বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান। তাদের শক্ত খোলস আরেকটা বাধা হয়ে সামনে দাঁড়াত। কচ্ছপের খোলস পিষে গুড়া করার পাশাপাশি তাদের ফুসফুস থেকে বায়ু নির্গমন প্রক্রিয়ার জন্য অনেক বেশি চাপ প্রয়োগ করতে হতো। কিন্তু কুমিরের তুলনায় তাতে মাংস পাওয়া যেত নিতান্তই অল্প। তাই, কচ্ছপের চেয়ে মাংসল কুমির ভক্ষণের দিকেই টাইটানোবোয়াদের অধিক মনোযোগ ছিল।
কুমির, কচ্ছপ ছাড়াও টাইটানোবোয়া লাংফিশ এবং ছোটখাট সাপ শিকার করে ভক্ষণ করত। তখনকার লাংফিশ একেকটা আকারে প্রায় তিন ফুটের মতো লম্বা হতো। এছাড়াও, স্ত্রী টাইটানোবোয়ারা পুরুষের চেয়ে আকারে বড় হওয়ায় তারা পুরুষ টাইটানোবোয়াকে শিকারে পরিণত করত বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
উপরে বর্ণিত খাদ্যতালিকাটি তৎকালীন সেরেহন অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে কল্পিত। জলজ প্রাণী, সরীসৃপ ছাড়াও তখনকার পরিবেশে বিভিন্ন পক্ষীকুল কিংবা স্তন্যপায়ী বাস করলেও করতে পারে। তবে, এসবের জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে এই ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কোনো তথ্য দেওয়া দুষ্কর।
বিলুপ্তির কারণ
টাইটানোবোয়ার বিলুপ্তির কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা দুটি তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন। প্রথমটি হলো বৈশ্বিক তাপমাত্রার পরিবর্তন। তাপমাত্রার উপর যে সরীসৃপের আকার নির্ভরশীল, তা বিজ্ঞানমহলে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। পরিবেশের তাপমাত্রা যত বেশি হবে, যেখানে তাপমাত্রার তারতম্য থাকবে খুবই কম, সেখানে সরীসৃপ আকারে হবে তত বৃহৎ। বিষুবরেখার যত কাছাকাছি যাওয়া যায়, গড় তাপমাত্রা তত বেশি বৃদ্ধি পায়, ঋতুভিত্তিক তারতম্য তত বেশি হ্রাস পায়। যেহেতু বিষুবরেখায় তাপমাত্রার স্থিতিশীলতা অধিকতর বেশি, তাই ওই স্থানের আবহাওয়া সরীসৃপদের বসবাসদের জন্য অধিক উপযুক্ত। কারণ, এই তাপমাত্রায় বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়া, যেমন- হজম, রক্ত সঞ্চালন, এবং শ্বসন অনেক ভালোভাবে সম্পাদিত হয়। ফলে, অধিক পরিমাণ শক্তি শারীরিক বৃদ্ধির কাজে ব্যয় হবার সুযোগ পায়।
টাইটানোবোয়া দৈর্ঘ্যে এত লম্বা হওয়া এটাই ইঙ্গিত করে, সিলানডিয়ান অধিযুগে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ছিল আজকের থেকে অনেক বেশি। পৃথিবী সিলানডিয়ান অধিযুগ থেকে মায়োসিন অধিযুগে প্রবেশ করলে ক্রমশ নামতে থাকে পৃথিবীর তাপমাত্রা। পৃথিবীর তাপমাত্রা হঠাৎ দ্রুত নেমে যাওয়ায় টাইটানোবোয়ার বিপাক ক্রিয়ায় দেখা দেয় সমস্যা। তারা বাস্তুতন্ত্রের সাথে তখন সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। তখন পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে অধিকতর ছোট আকৃতির সাপের, যারা কম তাপমাত্রায় তাদের বিপাক ক্রিয়া সুন্দরভাবে চালিয়ে নিতে পারত। এভাবেই তাপমাত্রার পতনে বিলুপ্তি ঘটে বিশালাকার এই দানবের।
আবার অনেকে মনে করেন, বিশালাকার এবং মাংসাশী হবার ফলে তীব্র খাদ্য সংকটে এরা পৃথিবীর প্রাকৃতিক প্রতিযোগিতা থেকে মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। বর্তমানে পরিবেশের গড় তাপমাত্রা অধিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া অনেক বিজ্ঞানী ধারণা করছেন, বিশাল দেহের প্রাণীগুলো আবার হয়তো পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে।