28/09/2023
পারশনাথ পাহাড়ে একদিন
অফিসে দিব্বি কাজ করছিলাম। ফোনটা বেজে উঠল। জবা ফোন করেছে। রিসিভ করে যেটা বুঝতে পারলাম ভদ্রমহিলা সারপ্রাইজ দিতে আমার কাছে আসছেন। স্টেশন গিয়ে ওকে নিয়ে এলাম। বেশ খুশি খুশি ভাব এখন আমাদের। সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে গল্প করছি দুজনে আর প্ল্যান করছি কাল কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়। প্রথমে ঠিক হল দেওঘর বা ত্রিকূট পাহাড়। কিন্তু একটার পর একটা প্ল্যান চেঞ্জ হতে হতে ঠিক হল
ঝাড়খণ্ডের সবথেকে উঁচু শৃঙ্গ পারশনাথ যাবো। শুধু এটুকু জানতাম যে পাহাড়ের উপরে একটা দারুণ জৈন মন্দির আছে। ২৩ তম জৈন তীর্থঙ্কর পারশনাথ এখানে নির্বাণ লাভ করেছিলেন। আশেপাশে আরও অনেক তীর্থঙ্করের মন্দিরও আছে। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য শৃঙ্গ পারশনাথ। পথে বেরিয়ে বাকী দেখা যাবে কিভাবে যাবো।
টুক করে ব্রেকফাস্ট করে আমরা রওনা দিলাম। ম্যাপে দেখাচ্ছে গিরিডি পেরিয়ে বেশ অনেকটা যাওয়ার পর আসবে পারশনাথ। সুন্দর পরিবেশ, হালকা হালকা মেঘ। ফুরফুরে হাওয়া। গল্প করতে করতে এগোচ্ছি আমাদের বাইকে। গিরিডি ঢোকার আগে ব্রিজের মুখে একটা ধাবাতে পেট ভরে পরোটা আর তরকা খেলাম। সুন্দর খাবার, সাথে ধোঁয়া ওঠা চা। আহা! আমি আগের কিছু লেখাতে বলেছি ঝাড়খণ্ড যেহেতু ছোটনাগপুর মালভূমিতে অবস্থিত তাই রাস্তা যখন তখন নিচে নেমে যায়, উপরে উঠে যায়। হটাত টার্ন আসে। একটু সাবধানে চালাতে হয়। এমন সুন্দর রাস্তায় সময় কাটছে ভালোই। এক জায়গায় এসে দেখলাম একটা বিরাট গেট, ওটাই এন্ট্রান্স। গেট পেরিয়ে বেশ কিছুটা এগোতেই বোঝা গেলো জৈন অধ্যুষিত এলাকায় ঢুকে গেছি। কারণ চারদিকে বড় বড় জৈন মন্দির। সুন্দর কারুকার্য করা বিভিন্ন জৈন নিদর্শন, বাড়ি। জায়গাটার নাম মধুবন। এটি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জনবসতি এলাকা। অনেক জৈন ধরমশলা চোখে পড়ল। এসব কিছু পেরিয়ে একটা জায়গায় দেখলাম আর রাস্তা নেই। অথচ ম্যাপে দেখাচ্ছে অজস্র আঁকাবাঁকা পথ এখনও পেরোতে হবে তবেই মন্দির। প্রথমে বুঝতে পারি নি কতটা যেতে হবে। ভাবলাম গাড়ি এখানে স্ট্যান্ড করে দি। হেঁটে চলে যায়। বাইক দাঁড় করাতেই আশপাশ থেকে অনেক লোক তাদের বাইক নিয়ে চলে এল। বলল উপর পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। বাইক প্রতি ১০০০ টাকা লাগবে। একজন করে যাবে। আমাদের ২০০০ টাকা লাগবে। দরদাম করা যায় ওদের সাথে। কিছু না বলেই নিজেরাই ৬০০ টাকা পর্যন্ত রেটে নেমে এল। কতটা যেতে হবে ভাবছি, ম্যাপে দেখাচ্ছে প্রায় ১৫ কিমি। সাইনবোর্ডে লেখা আছে প্রায় ১০ কিমি। জবা বলল "আমরা নিজেদের বাইকে যাবো।" এখানে বলে রাখি ওখানে যে বাইকগুলো আছে তারা কিন্তু আপনাকে চরম ডিমোটিভেট করবে - "আপনারা যেতে পারবেন না, অনেক খাড়া পাহাড়, অসুবিধা হবে, আসুন কম টাকায় নিয়ে যাচ্ছি, বাঁদরের উৎপাত আছে…" এরকম অজস্র কথা উড়ে আসবে। কোন কিছুকে পাত্তা দেবেন না। জবা আর আমি আলোচনা করলাম নিজেদের বাইকে যাবো। কিছুটা গিয়ে দেখি কি হয়। অসুবিধা বুঝলে নেমে যাবো। তখন ওদের বাইকে যাবো।
শুরু করলাম যাত্রা। অল্প খাড়া, চওড়া বাঁক। কোন অসুবিধা হল না। জবা নিজের মনে মোবাইল বের করল ভিডিও করবে বলে। কিন্তু যেই না দুটো বাঁক পেরিয়েছি অমনি রাস্তা হয়ে গেলো হেব্বি খাড়া আর টার্ন হয়ে গেলো খুব ছোট্ট। হটাত এমন হওয়ায় নার্ভাস হয়ে গেলাম। পিছন থেকে একটা হাত আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল- "কোনো অসুবিধা নেই, ভালোই চালাচ্ছ। আসতে আসতে চলো, ঠিক পৌঁছে যাবো"। একটু যেন সাহস পেলাম। ধীরে ধীরে ওঠা শুরু হল। বেশ কিছুটা উঠে দেখলাম নার্ভাসনেসটা একদম কেটে গেছে। জবাকে জিজ্ঞেস করলাম ভয় পেয়েছিল কিনা। বলল হ্যাঁ, চরম ভয় লেগে গেছিল। হটাত অমনি খাড়া রাস্তা হয়ে যাবে বুঝি নি। মোবাইলটা কোনো রকমে ব্যাগে ভরে নিলাম না হলে পড়ে যেত। বললাম- আমাকে সাহস দেওয়া হচ্ছিলো যে খুব। উত্তর এল- আমি তো বুঝতে পেরেছি তুমিও ভয় পেয়েছো। এখন দুজনে ঘাবড়ে গেলে আর যাওয়াই হত না। তাই সাহস দিলাম। এই কারণেই আমাদের কেমিস্ট্রিটা বেশ জমাটি।
চারদিক সবুজ, ঝকঝক করছে যেন। কিছু বুনো ফুলের গন্ধ হাওয়ায় ভাসছে। অনেক লোকজন যাচ্ছেন কেউ হেঁটে, কেউ ডুলিতে। ডুলি হল দড়ি বা ফিতে দিয়ে বানানো চেয়ার যার সাথে বাঁশ লাগানো থাকে। চারজন মানুষ কাঁধে বয়ে নিয়ে যান। ওজন হিসেবে ডুলি ভাড়া হয়। মিনিমাম ৩৫০০ থেকে স্টার্ট। এসব দেখছি, জবা নানা ফটো তুলছে। একটা জায়গায় এসে দেখলাম পাকা রাস্তা সোজা চলে গেছে আর তার ডান দিকে আর একটা কাঁচা রাস্তা। কি মনে হল একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন- পাকা রাস্তা দিয়ে গেলে খানিক যাওয়ার পর আর রাস্তা নেই, সিঁড়ি আছে। হেঁটে হেঁটে যেতে হবে বাইক রেখে। আর যদি কাঁচা রাস্তা ধরেন, খানিক ঘুরপথ হবে কিন্তু মন্দিরের কিছুটা আগে গাড়ি রাখতে পারবেন, অল্প হাঁটতে হবে। ভাগ্যিস জিগাইলাম। রাস্তা কাঁচা কিন্তু সুন্দর যাওয়া যায়। আমাদের বাইকের গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স কম হওয়ায় মাঝে মাঝে পাথর ছিটকে এসে লাগছে পায়ে।
অনেকটা উঠে আসার পর CRPF ক্যাম্পের পাশে বাইক রাখতে হল। এবার হাঁটতে হবে। হেলমেটগুলো আচ্ছা করে একটা গামছা মত ছিল ওটা দিয়ে ব্যাগের সাথে বেঁধে শুরু করলাম হাঁটা। এতক্ষণ বুনো ফুলের গন্ধ নাকে আসছিল। এবার একটা উগ্র ঝাঁজালো গন্ধ নাকে আসতে লাগলো। গন্ধটা কিন্তু খারাপ লাগছে না, খুব চেনা গন্ধ। খানিক এদিক ওদিক দেখতেই দেখা পেলাম বন্য তুলসী। অতি উগ্র গন্ধ, কিন্তু বেশ ভালো লাগছে। অল্প অল্প জল খাচ্ছি আর হাঁটছি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে এত খাড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠবো কি করে। কিন্তু সব শেষে যখন চোখের সামনে ধবধবে সাদা বড় এক মন্দির, একটু দূরের একটা পাহাড়ে হেলিপ্যাড, যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ, ছোট্ট লাগছে দূরের মধুবন শহরকে … এসব দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো। পারশনাথ আসা আমাদের সার্থক। ফুরফুরে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। আরামে মনে হচ্ছে মন্দিরের চাতালে ঘুমিয়ে যায়। কতক্ষণ ওখানে বসে ছিলাম খেয়াল নেই। আমিই জবাকে বললাম দেরি করলে নামতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। আমাদের সন্ধ্যের মধ্যে রুমে ঢুকতে হবে। চলো ধীরে ধীরে নামি। একটু নেমে একটা দোকানে পাহাড়ি ঝর্ণার জলে বানানো চা খেলাম। বাইক নিয়ে পাহাড়ে ওঠা সহজ, নামার সময় গণ্ডগোল হয়। বারবার ব্রেক করলে ব্রেক কাজ করে না অতিরিক্ত গরম হয়ে। তখন হয় তুমি বস সামলাতে না পারলে খাদে পড়বে না হলে চুপ করে বাইক বন্ধ করে বসে থাকতে হবে ব্রেক ঠাণ্ডা হতে। তাই এখানে ইঞ্জিন ব্রেকিং খুব ভালো কাজ দেয়। অল্প অল্প ব্রেক আর ইঞ্জিন ব্রেকিং করতে করতে নেমে এলাম নীচে। একরাশ আনন্দ, উচ্ছ্বাস নিয়ে শেষ হল আমাদের পারশনাথ মন্দির দর্শন।
পরবর্তী ভ্রমণ কাহিনী আসছে সামনের সপ্তাহে। আজ এ পর্যন্ত। বাই বাই। ভালো থকবেন সব্বাইকে নিয়ে।
©ঘুরু ঘুরু ডায়েরি- Ghuru Ghuru Diary