29/06/2024
কেপ ভার্দ: আফ্রিকা উপকূলে আগ্নেয়গিরির দেশ
এমন একটি দেশ যার প্রত্যেকটি দ্বীপেই রয়েছে আগ্নেয়গিরি। বলা চলে এই দেশের মানুষের প্রত্যহ চলাচল আগ্নেয়গিরিকে কেন্দ্র করেই। সবগুলোই প্রায় সুপ্তাবস্থায় আছে। বলুন তো, এমন ঘুমন্ত দৈত্যকে প্রতিবেশী বানিয়ে কি বসবাস করা সম্ভব?
বিস্তৃত নীল জলরাশির মাঝখানে ছোট ছোট এই দ্বীপগুলো সকাল হলেই বেশ কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠে। ছোট ছোট ট্রলার নিয়ে মৎস্য শিকারিরা বেরিয়ে পড়ে বিশাল নীল জলরাশির বুকে। মাথার উপর বিশাল আকাশ আর নিচে বিস্তৃত ঊর্মিমালায় ভাসতে ভাসতে এখানকার মানুষের জীবন কেটে যায়।
বলা হচ্ছে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র কেপ ভার্দের কথা। নৈসর্গিক সৌন্দর্যই যে দেশের দ্বীপগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য। কেপ ভার্দের দ্বীপগুলো ম্যাক্রোনেশিয়া বাস্তু-অঞ্চলের দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্ভুক্ত। ১৪৬০ সালের পূর্বে এখানে কোনো জনবসতি ছিল না। সর্বপ্রথম পর্তুগিজরা এখানে বসতি স্থাপন করে। তারপর থেকেই ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বাড়তে থাকে।
আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল থেকে এই দ্বীপদেশটির দূরত্ব মাত্র ৫৭০ কিলোমিটার। ২০১৮ সালের পরিখ্যান অনুযায়ী এর মোট জনসংখ্যা ৫,৪৩,৭৬৭ জন। দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর ৯৩% রোমান ক্যাথলিক ধর্মের অনুসারী। এছাড়া মুসলিম রয়েছে ১.৮ শতাংশ। এদেশের অধিকাংশ মানুষই জাতিগতভাবে ইউরোপীয়। বিশেষ করে পর্তুগিজ জনগণ সবচেয়ে বেশি। এ কারণে দেশটির রাষ্ট্রীয় ভাষাও পর্তুগিজ। তবে বর্তমানে উল্লেখযোগ্য হারে আফ্রিকান জনগোষ্ঠী চোখে পড়ছে।
এ দেশের মানুষের জীবনযাত্রা ইউরোপীয়ানদের মতো। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, বাজার, এমনকি ধর্মীয় স্থাপনাসহ সবকিছুই ইউরোপের আদলে গড়া। এ যেন উত্তর আটলান্টিকের বুকে একখন্ড ইউরোপ।
ইতিহাস
এ দ্বীপগুলো সর্বপ্রথম সমুদ্রের উপর ভেসে ওঠে প্রায় ২০ মিলিয়ন বছর আগে। সেসময় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এখনকার তুলনায় প্রায় ২০০ মিটার বেশি ছিল। যার কারণে অধিকাংশ দ্বীপ তখনও পানির তলায় ছিল। পরে ধীরে ধীরে অন্যান্য দ্বীপগুলোও ভেসে উঠতে শুরু করে।
সর্বপ্রথম ১৪৫৬ সালে, পর্তুগিজ রাজকুমার হেনরি নেভিগেটর, অ্যালভিস ক্যাডামোস্টো ও আন্তোনিওতো উসোদিমারে যৌথভাবে বেশ কয়েকটি দ্বীপ আবিষ্কার করেন। পরের দশকে, ডায়োগো গোমেস এবং আন্তোনিও ডি নোলি দ্বীপপুঞ্জের অবশিষ্ট দ্বীপগুলো আবিষ্কার করেন। তারা যে সময় দ্বীপগুলো আবিষ্কার করেন, তখন এই অঞ্চল মানুষের বসবাসের অনুপযোগী ছিল। পর্তুগিজরা ছয় বছর পরে সাও টিয়াগো দ্বীপে ফিরে এসে সিডে ভেলহা দ্বীপ খুঁজে পায়, যা ক্রান্তীয় অঞ্চলে প্রথম স্থায়ী ইউরোপীয় জনবসতির শহর।
কেপ ভার্দ আফ্রিকা উপকূলের বেশ কাছেই অবস্থিত। যাত্রাপথে পর্তুগিজ বাণিজ্যিক জাহাজগুলো এই দ্বীপে নোঙর করত। এরপর ১৪৬০ সালে তারা এই দ্বীপগুলোকে নিজেদের সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসে। এর পরবর্তী কয়েক বছরে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। তারপর থেকেই ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বাড়তে থাকে, কর্মব্যস্ত হয়ে উঠতে শুরু করে একসময়ের নির্জন দ্বীপ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজগুলো এর বন্দরগুলোতে অবস্থান করে। ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে এখানে অবস্থান করে কয়েক হাজার ব্রিটিশ সৈন্য। যুদ্ধাবস্থা এবং খারাপ পরিস্থিতিতে সেখানে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে অনেক লোক ইউরোপে চলে যায়। আবার কিছু লোক সেনেগাল এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতে চলে যায়। ১৯৪০ সালে এর বর্তমান রাজধানী প্রায়াতে একটি বিমানবন্দর নির্মিত হয়। তখন থেকেই ইউরোপ ও আফ্রিকার সাথে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালিত হত।
ভৌগলিক দিক দিয়ে আফ্রিকা উপকূলের খুব নিকটে হওয়ায় এর দ্বীপগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এজন্য পর্তুগিজরা সর্বপ্রথম একে গুরুত্বপূর্ণ পানি সরবরাহ কেন্দ্র, চিনি শিল্প এবং দাস ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে স্থানীয় জনগণের মধ্যে একধরনের বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতার দাবীতে গড়ে উঠে বেশ কিছু সংগ্রামী সংগঠন। ১৯৭৫ সালে পর্তুগালের বিরুদ্ধে দীর্ঘ এক সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে কেপ ভার্দ স্বাধীনতা লাভ করে। তার স্বাধীনতায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে ‘দ্য আফ্রিকান পার্টি ফর দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্স অভ গিনি-বিসাউ অ্যান্ড কাবু ভার্দ’ নামের একটি সংগঠন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল গিনি-বিসাউ এবং কেপ ভার্দকে একত্রিত করে একটি রাষ্ট্র গঠন করা। সে সময় তারাই এই দুই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত। এ নিয়ে পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ হয়। পরবর্তীতে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে তারা স্বাধীনতা অর্জন করে।
তাদের এই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায় ১৯৮০ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। পরবর্তীতে এই সংগঠন ভেঙে গিয়ে নতুন করে গঠিত হয় ‘আফ্রিকান পার্টি ফর দ্য ইন্ডিপেনডেন্স অফ কেপ ভার্দ’। তারা দীর্ঘদিন এই দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরে দেশ যখন গণতান্ত্রিক পথে যাত্রা শুরু করে তখন তাদের ক্ষমতা কমতে থাকে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তারা ক্ষমতা হারায়। এই নির্বাচনে ‘মুভিমেন্তো প্যারা অ্যা ডেমক্রাসিয়া’ জয়লাভ করে। ১৯৯৬ সালের আবারও দলটি জয়লাভ করে। পরবর্তী দীর্ঘ ১০ বছর পর ২০০১ সালের নির্বাচনে পুনরায় ‘আফ্রিকান পার্টি ফর দ্য ইন্ডিপেনডেন্স অফ কেপ ভার্দ’ ক্ষমতায় আসে। এর ২০০৬ সালের নির্বাচনেও তারা বিজয়ী হয়।
প্রশাসনিক অঞ্চলসমূহ
অপরূপ সৌন্দর্যের দেশ কেপ ভার্দ মোট ১৮টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে ১০টি আয়তনে বেশ বড় এবং বাকিগুলো ছোট। প্রধান দ্বীপগুলো হলো বার্লাভেন্তো, সাও ভিসেন্টে, সোতাভেন্তো, সান্টা লুজিয়া, মাইয়ো, সাও নিকোলাউ, সান্টিয়াগো, সান্টো আন্টাও, সাল, ফগো, বোয়া ভিস্তা, ব্রভা ইত্যাদি। এই ১৮টি দ্বীপের মধ্যে সান্টা লুজিয়াসহ মোট পাঁচটি দ্বীপে মানববসতি নেই। নির্জন দ্বীপগুলোকে প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। সবগুলো দ্বীপে আগ্নেয়গিরি থাকলেও শুধু মাত্র ফোগোতেই অগ্ন্যুৎপাত ঘটে।
আকার এবং জনসংখ্যা উভয় দিক দিয়েই কেপ ভার্দের বৃহত্তম দ্বীপ সান্টিয়াগো। এখানেই অবস্থিত বৃহত্তম জনবহুল শহর প্রায়া। কেপ ভার্দ দ্বীপপুঞ্জের সাল, বোয়া ভিস্তা এবং মাইও এই তিনটি দ্বীপ মোটামুটি সমতল। বেলে মাটি দ্বারা গঠিত, উর্বর এবং শুকনো। বাকিগুলো স্যাঁতস্যাঁতে, প্রচুর গাছপালা এবং কঙ্কর দিয়ে ভরা। দ্বীপগুলো আগ্নেয়গিরি দ্বারা গঠিত হওয়ার কারণে অধিকাংশ এলাকা শিলাখণ্ড দ্বারা আবৃত।
অর্থনীতি
ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে কেপ ভার্দে খুব বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। তারপরও তারা উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নতি করেছে। এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মানও বেশ উন্নত। কেপ ভার্দের উন্নয়নের একটি কারণ হলো বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর উন্নয়ন সহায়তা। বিশেষ করে পর্তুগালসহ ইউরোপীয় দেশগুলো কেপ ভার্দে ব্যাপক উন্নয়ন সহায়তা সরবরাহ করে। ২০০৭ সালের পর জাতিসংঘ একে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে দেখছে।
দশটি প্রধান দ্বীপের মধ্যে পাঁচটিই (সান্তিয়াগো, সান্টো আন্তো, সাও নিকোলাউ, ফোগো এবং ব্রাভা) উল্লেখযোগ্যভাবে কৃষিক্ষেত্রে বেশ সমৃদ্ধ, যদিও তা যথেষ্ট নয়। কেপ ভার্দের মোট খাদ্যশস্যের ৯০ শতাংশই আমদানি করা হয়। খনিজ সম্পদ বলতে কেবল মাত্র লবণ, পোজোলোনা (সিমেন্ট উৎপাদনে ব্যবহৃত আগ্নেয় শিলা) এবং চুনাপাথর রয়েছে। পর্তুগালের অধীনে থাকাকালে এখানে বেশ কিছু ওয়াইন তৈরির জন্য ঘরোয়া শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐতিহ্যগতভাবে এখনও ঘরোয়াভাবে ব্যাপক ওয়াইন উৎপাদন হয়। ইউরোপে এই ওয়াইন রপ্তানি করা হয়।
কেপ ভার্দের অর্থনীতি মূলত সেবা-ভিত্তিক। সেবা, বাণিজ্য, পরিবহন এবং সরকারি পরিষেবাগুলো মিলিয়ে মোট জিডিপির প্রায় ৭০ শতাংশ। কেপ ভের্দির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫% পল্লী অঞ্চলে বসবাস করে, যাদের মূল পেশা কৃষি ও মৎস শিকার। এখানে প্রচুর মাছ এবং শেলফিস পাওয়া যায়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে। বর্তমানে মৎস্যশিল্প কেপ ভার্দের অন্যতম অর্থনৈতিক উৎসে পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রত্যেকটি শহরেই কোল্ড স্টোরেজ, হিমায়িত সুবিধা এবং ফিশ প্রসেসিং প্ল্যান্ট রয়েছে।
কেপ ভার্দের আরেকটি অর্থনীতিক চালিকাশক্তি রেমিটেন্স, যার মূল উৎস ইউরোপ। এই রেমিটেন্সে দেশটির গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে জিডিপির প্রায় ২০% অবদান রাখে। সামান্য কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আধা-মরুভূমি ও অনুর্বর এই দেশটির জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত।
১৯৯১ সাল থেকে সরকার বিদেশমুখী বিনিয়োগকারীদের উন্মুক্ত ব্যবসায়ের সুযোগ দিয়েছে। ফলে বেসরকারি খাতের উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হয়েছে। প্রকৃতির অপার লীলাভূমি হওয়ার কারণে সারাবিশ্ব থেকে প্রতি বছর বহু পর্যটক পাড়ি জমায় এখানে। সেজন্য পর্যটন শিল্পও বেশ অবদান রাখছে তাদের অর্থনীতিতে। ২০০৭ সালে তারা ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনে যোগ দেয়।
কেপ ভার্দের প্রধান বন্দর মিনডেলো এবং প্রায়াতে অবস্থিত। তবে অন্যান্য দ্বীপগুলোতে ছোট ছোট বন্দর সুবিধা রয়েছে। স্যাল এবং রাজধানী প্রায়াতে রয়েছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এছাড়া জনবসতি থাকা সব দ্বীপেই স্থানীয় বিমানবন্দর নির্মিত হয়েছে। এই দ্বীপপুঞ্জটিতে মোট ৩,০৫০ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে, যার মধ্যে ১,০১০ কিলোমিটার পাকা, বাকিগুলো কোচলিস্টোন দ্বারা নির্মিত।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পর্যটন
বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পর্যটন শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে কেপ ভার্দের অবস্থান তালিকার প্রথমদিকে। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই দ্বীপরাষ্ট্রটি যেন সৃষ্টিকর্তা নিজে হাতে সাজিয়েছেন। প্রত্যেক দ্বীপেই আগ্নেয়গিরি থাকার কারণে এর সৌন্দর্য বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর স্বচ্ছ নীল জলরাশি এবং সবুজ দ্বীপগুলো দিন দিন পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাই আগামীর কেপ ভার্দের আয়ের প্রধান উৎস হতে যাচ্ছে পর্যটন খাত এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
কেপ ভার্দের বৃহত্তম আগ্নেয়গিরিটি বর্তমান বিশ্বের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। ফোগো দ্বীপের এই আগ্নেয়গিরিটিতে সর্বশেষ অগ্ন্যুৎপাত হয় ২০১৪ সালে। বর্তমানে এর পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা যায় এবং আগ্নেয়গিরির খুব কাছেও যাওয়া যায়।
যাবেন নাকি একবার কেপ ভার্দে?