19/03/2023
এসএম শহীদুল ইসলাম
শীতের কুহেলী কেটে বসন্তের গানের মৌবনে যখন মৌমাছির গুঞ্জন, দখিনা দুয়ারে খোলা জানালায় যখন মলয় হিল্লোলে পাখির কলতান তখন ইটপাথরের শহর ছেড়ে প্রকৃতির রঙের আবিরে মন রাঙাতে কার না ভালো লাগে! প্রতি বছরের ন্যায় এবারও তাই সাতক্ষীরা সাংবাদিক ঐক্য’র আয়োজনে আনন্দ ভ্রমণ অনুষ্ঠিত হয়। সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ আবু আহমেদ ও সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে এবারের আনন্দভ্রমণের স্থান নির্ধারণ হয় সাগরকন্যা কুয়াকাটায়। সাতক্ষীরা থেকে দৈনিক পত্রদূত অফিসে সাংবাদিক নেতাদের আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হলো ১৩ মার্চ ২০২৩, তারিখ সোমবার বিকাল ৪টায় ইটাগাছা দৈনিক পত্রদূত অফিসের সামনে থেকে আমাদের পরিবহন যাত্রা শুরু করবে। আয়োজক কমিটির সমন্বয়ক দৈনিক পত্রদূতের চীফ রিপোর্টার আব্দুস সামাদ গ্রুপ মেসেঞ্জারে আগেই বার্তা দিয়েছিলেন, বিকাল সাড়ে তিনটার মধ্যে হাজির হতে। আমরা যথাসময়ে হাজির হলাম। পরিবহন আসলো। আমাদের বহনকারী পরিবহনের নাম টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস। সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ আবু আহমেদ আমাদের শুভযাত্রা কামনা করে বিদায় জানালেন। ইতোমধ্যে এক পশলা ছবি তোলার ধুম পড়ে গেলো। যে যার মতো ছবি তুললো। তারপর আমরা বাসে উঠলাম। সমন্বয়ক আব্দুস সামাদ বেশ অভিজ্ঞতা আর দক্ষতার সাথে আমাদের আসন বন্টন করলেন। আমার আসন বরাবরের মতো সবার শেষে পড়লেও বেশ আরামে ছিলাম। বাস ছাড়লো। শো শো শব্দে এগিয়ে চলছে টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস। শুরু হলো গল্প আর আড্ডা। গ্রামীণ জনপদ, ফসলের ক্ষেত আর নদী পেরিয়ে গাড়ি পৌঁছে যায় খুলনার রূপসা সেতু। সেখানে চা পানের বিরতি শেষে বাস চললো কুয়াকাটার দিকে। রাত ১১টার মধ্যে গাড়ি পৌঁছায় কুয়াকাটায়। সেখানে আমাদের জন্য আগেই ঠিক করা ছিলো হোটেল রোজগার্ডেন। রাতে বিশ্রামের জন্য উঠলাম হোটেলে। ব্যাগ-বচকা রেখে ফ্রেশ হয়ে ছুটলাম খাদ্যান্বেষণে। ক্ষুধায় তখন পেট জ্বলছিল। ‘আল্লাহর দান’ নামের একটি রেস্টুরেন্টে আমি আর দৈনিক হৃদয় বার্তা সম্পাদক মো: মোশারফ হোসেন গেলাম খেতে। রেস্টুরেন্টের পরিবেশনকারীর প্রতারণার ফাঁদে পড়লাম। এক মাছের নাম করে আরেক মাছ দিলেন। ক্লান্ত শরীরে প্রতিবাদ জানিয়ে চলে আসলাম হোটেলে। নরম বিছানায় পিঠ ঠেকাতেই ঢলে পড়লাম নিদ্রদেবীর কোলে। ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘড়ির কাটা ৬টা ছুঁইছুঁই। সাগরে সূর্যোদয়ের অপরূপ দৃশ্য দেখার লোভ আমার অনেক আগের। তাই সেই লোভের বশে বেরিয়ে দেখি কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে প্রকৃতি। প্রকৃতির এমন বিরূপ আচরণে সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখার লোভ সংবরন করা ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। তবুও আশা ছাড়িনি। ছুটলাম সাগরের দিকে। সাগর পাড়ে গিয়ে মনে হলো-
‘আমি কখনো যাইনি জলে, কখনো ভাসিনি নীলে;
কখনো রাখিনি চোখ, ডানামেলা গাঙচিলে।
আবার যখন তুমি সমুদ্রস্নানে যাবে,
আমাকেও সাথে নিও, নেবে কি আমায়;
বলো নেবে কি আমায়।’
হ্যাঁ, সমুদ্রের নোনা জলে ঝাপিয়ে পড়ে সবাই। তাদের মিতালি এখন জলের সঙ্গে। সমুদ্রের জলে এভাবে কেটে গেলো প্রায় তিন ঘন্টা। সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, দৈনিক হৃদয় বার্তার সম্পাদক মো: মোশারফ হোসেন, সাংবাদিক রবিউল ইসলাম আহসানুর রহমান রাজিব, ফারুক রহমানসহ অনেকেই সমুদ্রস্নানে মেতে উঠলেন। ছবি তুলে, ভিডিও করে বেশ আনন্দ হলো। ফেসবুক লাইভ প্রচারও হলো। সেখানে আনন্দ অনুভূতি প্রকাশ করলেন অনেকেই। আব্দুস সামাদ কন্যা সারিকা সায়নী মেধা, শেখ তানজির আহমেদ তনা সুমাইয়া ওরফে হালুম, আহসান রাজিব পুত্র শোয়েব, এম জিল্লুর রহমানের পুত্র জিম, কৃষ্ণ ব্যানার্জি তনয়া ঋতু ও মিতু, মোশারফ হোসেন পুত্র তাহমিদসহ আমাদের সাথে আসা ছোট্ট সোনামনিরা সাগর জলে সাঁতার কেটে যে আনন্দ প্রকাশ করেছে তা সত্যিই স্মৃতিতে অম্লান থাকবে। রবিউল ইসলামের দুই পুত্র যথাক্রমে রুমন আর রুহান আমাদের ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দী করতে ব্যস্ত ছিলো। নিজেরা ভিউ দেখে দেখে ছবি তুলে গ্যালারি সমৃদ্ধ করে।
বেলা ১১টায় ফিরতে হলো রুমে। ফ্রেস হয়ে নাস্তা সেরে এবার গেলাম বৌদ্ধমন্দির ও রাখাইন পল্লি ঘুরতে। যাওয়া-আসার পথে সাধুর ব্রিজে এসে আটকে গেলাম কিছুক্ষণ। ব্রিজটি ভেঙে গেছে। সংস্কারের অভাবে অভিভাবকহীন অবস্থায় এ ব্রিজটি। ইজিবাইক-ব্যাটারি ভ্যান যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ।
যাই হোক-আঠারোশ’ শতকে আরাকান থেকে বিতাড়িত রাখাইনদের মিষ্টিপানির ‘কুয়া’ বা ‘কুপ’ ছুঁয়ে দেখে কেউ কেউ। হঠাৎ করেই ডাক পড়ে ছবি তোলার জন্য। প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার একটি বুদ্ধমূর্তি আর পাশের কুয়ার সঙ্গে ছবি তোলে সবাই। এখানে বলে রাখি, জ্ঞানের গুরু গুগুলের সৌজন্যে আমরা আগেই জেনেছিলাম কুয়াকাটার দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে। গুগুল তল্লাসী চালিয়ে আমরা জেনেছিলাম-পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের শেষপ্রান্তে অবস্থিত সাগরকন্যা কুয়াকাটা। দেশের মধ্যে ভ্রমণপিপাসু ও পর্যটকদের আনন্দ ভ্রমণের কিংবা অবসর যাপনের অন্যতম স্থান এটি। তবে কুয়াকাটার পরিচিতি এখন শুধু দেশে নয়, বিশ্বজুড়ে। কারণ, এখানেই বেলাভূমির একই জায়গায় দাঁড়িয়ে বারো ঘণ্টার ব্যবধানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। প্রাকৃতিক শোভাম-িত দৃশ্যপট অবলোকনের পাশাপাশি দেশের প্রাচীন পুরাকীর্তি বিভিন্ন বৌদ্ধবিহার, আদিবাসীদের জীবনবৈচিত্র্য দেখার সুযোগও এখানে রয়েছে।
প্রায় ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সৈকতে রয়েছে চোখ ধাঁধানো নানা সৌন্দর্যের সমাহার। আন্ধারমানিক মোহনার উল্টোদিকে রয়েছে ফাতরার বিশাল বনাঞ্চল, শুঁটকি পল্লী, লাল কাঁকড়ার চর ইত্যাদি। অদূরেই রয়েছে পর্যটনপল্লী গঙ্গামতি সৈকত। পরিচ্ছন্নতার জন্য রয়েছে কুয়াকাটার আলাদা পরিচিতি। সুন্দরের স্বকীয়তায় কুয়াকাটাকে বলা হয় সাগর কন্যা। প্রতিদিন শত শত পর্যটক-দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখরিত হয় কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। উৎসব কিংবা ছুটির সময় এ ভিড় আরো বাড়ে।
মঙ্গলবার (১৪ মার্চ ২০২৩) ছিল কুয়াকায়াটায় ছিল পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। বেলাভূমির সর্বত্র হই-হুল্লুড় চলে আগতদের। নির্মল আনন্দ আর গভীর প্রশান্তি পেতে মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্য খুঁজে পায় কুয়াকাটা সৈকতে। এখানে আগত কয়েক পর্যটক জানান, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য শুধু মুগ্ধই করে না, শরীর আর মনের ক্লান্তিও ঘুচিয়ে দেয়। পর্যটকদের ভাষায়, জীবনের আমুদে আর প্রশান্তির সময় কাটাতে এবং মুহূর্তগুলো স্মরণীয় করতে কুয়াকাটায় ভ্রমণের বিকল্প নেই।
কুয়াকাটার অবিচ্ছেদ্য অংশ এখানকার আদিবাসী রাখাইন সম্প্রদায়। এদের ভিন্ন আদলের জীবনযাত্রা অবলোকনের সুযোগ মনে এনে দেয় ভিন্ন মাত্রার অনুভূতি। রাখাইন সম্প্রদায়ের কাছ থেকে জানা যায়, প্রায় সোয়া ২শ’ বছর আগে আরাকান থেকে বিতাড়িত দেড়শ’ রাখাইন পরিবার নৌকায় ভাসতে ভাসতে সাগরপারে নোঙর করে। শ্বাপদ-শঙ্কুলের এ জনপদে গড়ে তোলে তারা প্রথম মানব বসতি। তখন এখানে খাওয়ার জন্য সুপেয় পানিও ছিল না। তাই রাখাইন পরিবারগুলো কুয়া খনন করে মিঠা ও নিরাপদ পানি সংগ্রহ করেন। সেই কুয়ার নামানুসারে আজকের কুয়াকাটার নামকরণ। এখানে এলে চোখে পড়বে এদের তাঁতসহ উল বুনন কার্যক্রম। দেখে আসতে পারেন এখানকার অন্যতম সৌন্দর্য ইন্দোচীনের আদলে রাখাইনদের শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহার। এছাড়া কুয়াকাটার অদূরে মিস্ত্রিপাড়ায় রয়েছে সীমা বৌদ্ধবিহার। এ বিহারের মধ্যে গৌতম বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন ১৩৭ মণ ওজনের অষ্টধাতু নির্মিত বিশাল আকৃতির বৌদ্ধমূর্তি শোভা পাচ্ছে। রাখাইনদের মতে, এটি এশিয়ার বৃহত্তম বুদ্ধমূর্তি। রূপসী কুয়াকাটার নৈসর্গিক রূপ অন্যান্য সৈকতের তুলনায় বহুলাংশে আকর্ষণীয়। ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালী করা জেলেদের জীবন-জীবিকার যুদ্ধও এখানে এলে উপভোগ করা যায়।
রাখাইন পল্লী ও বৌদ্ধবিহার থেকে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা চললাম ইলিশপার্ক, লেবুচর, শুটকি পল্লী ও ফাতরার বন ও ঝাউবন দেখতে। এখান থেকেই শুরু সুন্দরবনের সীমানা। ইজিবাইক ভাড়া করে আমরা চললাম ঝাউবনের দিকে। সাগরের বুকে সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য অদম্য বাসনা নিয়ে আমরা পৌছুলাম সাগরপাড়ে। কিন্তু মেঘের আড়ালে সূর্য গেল অস্তাচলে। আংশিক দৃশ্য অবলোকনে অবশেষে শান্ত হলো মন।
তবে সাগরপাড়ে রাতের সৌন্দর্য দেখে আমরা মুগ্ধ। সবমিলিয়ে কুয়াকাটায় কাটানো একটা দিনের স্মৃতি মনের ক্যানভাসে অম্লান হয়ে থাকবে। সফর শেষে রাতের মিষ্টি চাঁদকে সঙ্গী করে পথচলা বারবার আবেগাপ্লুত করে। মনের মধ্যে বার বার ধ্বণীত হতে থাকে-
‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।
দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানীÍ
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন;
মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।’
কুয়াকাটায় যে কারণে ভোগান্তিতে পর্যটকরা: আমাদে সফর সঙ্গী বাংলা নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম এর সাতক্ষীরা প্রতিনিধি শেখ তানজির আহমেদ উল্লেখ করেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত সাগরকন্যা পটুয়াখালীর কুয়াকাটা। ছয় মাস আগেও কুয়াকাটায় ভ্রমণের কথা উঠলেই প্রশ্ন উঠতো যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে। সে সময় কুয়াকাটায় পৌঁছতে ছয়টি ফেরি পার হতে হতো। ভিন্ন রুটে বরিশালের দোয়ারিকা ও শিকারপুর এবং পটুয়াখালী পায়রা, পটুয়াখালী ও মহিপুরে ফেরি পার হতে হতো। এতে ব্যয় হতো দীর্ঘ সময়, এর সঙ্গে যুক্ত হতো ভ্রমণ বিড়ম্বনাও। সেই সঙ্গে যুক্ত হতো দৌলদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটের দীর্ঘ যানজটের ভোগান্তিও। এসব এখন অতীত। মাওয়া-জাজিরা রুটে পদ্মা সেতু ও পায়রায় পায়রা সেতুসহ এ দুটি রুটের প্রতিটি নদীতে সেতু হওয়ায় ভ্রমণপথের দীর্ঘ ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেয়েছে মানুষ। এখন ইচ্ছে করলেই স্বল্প সময়ে কুয়াকাটা ভ্রমণ করতে পারছে ভ্রমণপিপাসুরা। সেই সঙ্গে বদলেছে কুয়াকাটার চিরচেনা দৃশ্যও। বেড়েছে হোটেল রেস্তোরাঁ। বেড়েছে সৌন্দর্য। বেড়েছে পর্যটন স্পট।
তবে, সারাদেশের সঙ্গে কুয়াকাটার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলেও পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার পর্যটন শহর কুয়াকাটার স্থানীয় রাস্তাঘাটে উন্নয়নের ছিটে ফোটাও লাগেনি। স্থানীয় পর্যটন স্পটগুলোতে যাতায়াত খরচও বেশ। খাবার বা আবাসিক হোটেল খরচও উল্লেখযোগ্য। কুয়াকাটার পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে রয়েছে গঙ্গামতির চর, রাখাইন পল্লী, রাখানই মার্কেট, বৌদ্ধ মন্দির, লাল কাকড়ার চর, ঝাউবন ও শুটকি পল্লী। এর মধ্যে কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে গঙ্গামতির চরের দূরত্ব ৮-৯ কিলোমিটার। এই ৯ কিলোমিটার পথ যাওয়া আসায় পর্যটকদের কাছে মোটরসাইকেলে ভাড়া চাওয়া হয় ৪০০ টাকা (দুইজন), ইজিবাইকে কিংবা ব্যাটারিচালিত ভ্যানে ৮০০ টাকা (চার থেকে পাঁচজন)। একইভাবে রাখাইন পল্লী, রাখানই মার্কেট ও বৌদ্ধ মন্দির এক জায়গায় হলেও তিনটি স্পটের কথা বলে মোটরসাইকেল কিংবা ইজিবাইকে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা ভাড়া হাকা হয়। আবার, লাল কাকড়ার চর ও ঝাউবন একই জায়গায় এবং শুটকি পল্লী যাওয়া আসার পথে পড়লেও তিনটি ভিন্ন স্পষ্ট দেখিয়ে মোটরসাইকেল কিংবা ইজিবাইকে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা ভাড়া হাকা হয়। এই খরচ টানতে গিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন পর্যটকরা। কুয়াকাটা যেহেতু আসা হয়েছে, খরচ যাই হোক সবকিছু দেখতে হবে- এমন প্রবণতা থেকে অস্বাভাবিক ভাড়া দিয়েই এসব দর্শনীয় স্থান দেখতে বাধ্য হচ্ছেন পর্যটকরা।
এরপর ভোগান্তি শুরু হয় সড়কে। কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে রাখাইন পল্লী, রাখানই মার্কেট ও বৌদ্ধ মন্দির দর্শনের দুটি রুট। একটি হলো কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে খাসপুকুর-দোখাসি পাড়া হয়ে রাখাইন পল্লী। অন্যটি হলো কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে মুসুল্লিয়াবাদ হয়ে রাখাইন পল্লী। এ সড়কের দৈর্ঘ্য ৯ কিলোমিটার।
এর মধ্যে খাসপুকুর-দোখাসি পাড়া হয়ে রাখাইন পল্লীর সড়কটি নির্মাণের পর আর কখনও সংস্কার করা হয়নি। এতে রাস্তার পিচ, খোয়া উঠে গিয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ইজিবাইকে এই ৯ কিলোমিটার যেতে ঝাঁকিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে।
আবার, কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে মুসুল্লিয়াবাদ হয়ে রাখাইন পল্লীর কুয়াকাটা পৌরসভার অংশটুকু মোটামুটি চলাচলযোগ্য হলেও বাকি অংশটুকুর অবস্থা একই। এখান থেকে দশ বছর আগেও রাখাইন পল্লী যাওয়ার এই সড়ক দুটির একই অবস্থা যা ছিল, সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। সড়কটি চলাচলের একেবারেই অযোগ্য। যা কুয়াকাটা ভ্রমণের আনন্দকে ম্লান করে দিচ্ছে। নয় কিলোমিটার রাস্তার জন্য ৫০০ টাকা দিয়ে ইজিবাইক ভাড়া করে এসে ঝাঁকিতেই প্রাণ যায় যায় অবস্থা। অনেকে বমি পর্যন্ত করে ফেলছে। পর্যটনকে ঘিরেই এখনকার বেশির ভাগ মানুষের জীবন-জীবিকা। কিন্তু রাস্তাঘাটের যেমন বেহাল দশা, তেমনি মোটর সাইকেল বা ইজিবাইক ভাড়া কিংবা খাবারের দামে মানুষকে নিঃসন্দেহে ঠকানো হচ্ছে।
স্থানীয় ইজিবাইক চালক আজিজ বলেন, আসলে রাখাইন পল্লীর রাস্তাটার অবস্থা খুবই খারাপ। এতে চলাচল করতে গিয়ে মানুষও যেমন কষ্ট পায়, প্রতিনিয়ত আমাদের ইজিবাইকের নানা যন্ত্রাংশও নষ্ট হয়ে যায়। যা আয় করি, তার বড় অংশ খরচ হয়ে যায় বাইক ঠিক করতে গিয়ে।
ঢাকা থেকে কুয়াকাটা ভ্রমণে আসা কামরুল-মেরিনা দম্পতি বলেন, এখানকার হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে খাবারের দাম অনেক বেশি। তারপরও খাবারের মান ভালো না। ১৪০ টাকা দিয়ে একপিস টেংরা মাছ কিনেও খাওয়া গেল না। এটি ছিল পচাঁ। মাছের মাথার মধ্যে দুর্গন্ধ। কতদিন আগের তার ঠিক নেই। এগুলো স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে দেখা উচিত। বেশি দামও নেবে, আবার পঁচা মাছ খাওয়াবে এটা তো হতে পারে না।
কুয়াকাটা ভ্রমণে আসা পর্যটক সাতক্ষীরার আব্দুস সামাদ বলেন, আগে কুয়াকাটা আসাটাই ছিল কষ্টের। কিন্তু এখন বর্তমান সরকারের নানামুখী উদ্যোগে সেই কষ্ট দূর হলেও স্থানীয় কিছু সমস্যা উল্লেখযোগ্য, যা পর্যটকদের ভোগান্তির কারণ হচ্ছে। প্রয়োজনীয় অর্থ খরচ করে এখানে আসার পর যদি শুধুমাত্র খাওয়া ও দর্শনীয় স্থান ভ্রমণের জন্য জনপ্রতি দুই-তিন হাজার টাকা করে খরচ হয়, তাহলে তা দুঃসাধ্যই বটে। আর হোটেল-রিসোর্ট খরচের কথা তো বাদই দিলাম। তার ওপর পদে পদে প্রতারণা। দর্শনীয় স্থান ভ্রমণের ভাড়া নিয়েও যেমন মানুষের কাছ থেকে বেশি অর্থ নেওয়া হচ্ছে, তেমনি খাবারের ক্ষেত্রে অর্থ বেশি নিয়েও অত্যন্ত নি¤œমানের বা ক্ষেত্র বিশেষ পঁচা খাবার খাওয়ানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, একটা কথা বললে বিষয়টি আরও পরিস্কার হবে-কুয়াকাটায় তরমুজ চাষ হয়। এই পাশ দিয়ে দেখলাম অনেক তরমুজ ক্ষেত। কিন্তু কিনতে গিয়ে অবাক। একটা বড় তরমুজের (৮-৯ কেজি) দাম চাইলো ৪০০ টাকা পিস। যেখানে উৎপাদন হয়, সেখানে এই দাম হাকালে, ঢাকায় তার দাম কত হবে?
বদলে যাচ্ছে কুয়াকাটার চিরচেনা রূপ: সাংবাদিক শেখ তানজির আহমেদ উল্লেখ করেন, একদিকে পদ্মাসেতু অন্যদিকে পায়রা সেতু-এ দুইয়ের কল্যাণে বদলাতে শুরু করেছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটার চিরচেনা রূপ। শুধু ছুটির দিনে নয়, এখন সপ্তাহের অন্যান্য দিনেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকের পদচারণায় মুখর থাকে কুয়াকাটা। পর্যটন মৌসুম শীত শেষ হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে কুয়াকাটাকে বেছে নিচ্ছেন ভ্রমণপিপাসুরা। মঙ্গলবার (১৪ মার্চ) ও বুধবার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতসহ পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার এ পর্যটন শহর ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। মধ্যরাত থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটকরা সরাসরি বাসে এসে নামতে শুরু করেন কুয়াকাটায়। কোনোমতে নির্ধারিত হোটেলে পৌঁছে ড্রেস চেঞ্জ করেই তারা চলে যান সমুদ্র সৈকতে। এরই মধ্যে মোটরসাইকেল, ইজিবাইক বা ভ্যানওয়ালা এসে হাজির হন পর্যটকদের কাছে। প্রস্তাব দিতে থাকেন, সূর্যোদয় দেখতে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের গঙ্গামতীর চরে যাওয়ার। কেউ কেউ মোটরসাইকেলে, কেউ বা ইজিবাইকে কিংবা ব্যাটারি চালিত ভ্যানে করে যান নয় কিলোমিটার দূরের গঙ্গামতীর চরে। সেখানে গিয়ে সূর্যোদয় দেখে সবাই ফিরে আসেন কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টে। এরপর সকালের নাস্তা শেষে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে মেতে ওঠেন জলকেলিতে।
কেউ ছবি তোলেন, কেউ দৌড়াদৌড়ি, কেউ বা সৈকতের বালুতে লিখতে শুরু করেন প্রিয়জনের নাম। যতক্ষণ সম্ভব সমুদ্রের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যান পর্যটকরা। পরে গোসল সেরে আবার বেরিয়ে পড়েন পাশের দর্শণীয় স্থানগুলো দেখতে। এর মধ্যে রাখাইন পল্লী, রাখানই মার্কেট, বৌদ্ধ মন্দির, সংরক্ষিত দুইশ বছর আগের নৌকা, লাল কাঁকড়ার চর, ঝাউবন ও শুঁটকি পল্লী অন্যতম। তবে দুপুরের আগে রাখাইন পল্লী, রাখানই মার্কেট ও বৌদ্ধ মন্দির ও সংরক্ষিত দুইশ বছর আগের নৌকা এবং বিকেলে লাল কাঁকড়ার চর, ঝাউবন ও শুঁটকি পল্লী ভ্রমণ করতেই পছন্দ করেন বেশির ভাগ পর্যটক। বিকেলে এসব দর্শনীয় স্থান দেখে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই সবাই প্রস্তুত হয়ে যান সূর্যাস্ত দেখতে।
এরপর সন্ধ্যায় কেউ ব্যস্ত থাকেন কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের মার্কেটে কেনাকাটায়। কেউ বা মেতে ওঠেন অক্টোপাস, স্কুইডসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ-প্রাণী ফ্রাই বা বারবিকিউ পার্টিতে। সেই সঙ্গে রয়েছে সমুদ্র সৈকতের মকটা চা। এভাবেই ব্যস্ততম একটি দিন কেটে যায় পর্যটকদের।
ঢাকা থেকে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত দর্শনে আসা শাহিন বিল্লাহ বলেন, সাত/আট বছর আগে একবার কুয়াকাটা এসেছিলাম। কিন্তু তখন ভ্রমণটা আনন্দের চেয়ে ভোগান্তির ছিল বেশি। সেবার পথে কয়েকটি ফেরি পার হতে গিয়ে সব গোলমাল হয়ে যায়। পদ্মা ও পায়রা সেতু হওয়ায় দীর্ঘ বিরতির পর আবার কুয়াকাটায় এসেছি। এবার ভ্রমণটা অসাধারণ স্বস্তিদায়ক ছিল। আসতে কোনো বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি, যেতেও বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না আশা করছি। খুলনা থেকে আসা তানভীর আহমেদ বলেন, কুয়াকাটায় আসাটা এখন খুবই সহজ। বাসে উঠলেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কুয়াকাটা। এজন্য স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে চলে এলাম। কুয়াকাটার হোটেল রোজ গার্ডেনের ম্যানেজার জাহিদ বলেন, এখন কুয়াকাটায় পর্যটকের চাপ বাড়ছে। আগে শুধু পর্যটন মৌসুম বা ছুটির দিনে পর্যটকরা এলেও এখন সব সময়ই পর্যটকের চাপ রয়েছে। কুয়াকাটা পৌরশহরের ইজিবাইক চালক নাইম বলেন, আগে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যটকের আনাগোনা ছিল। তখন কিছুটা আয় হতো। অন্যান্য সময় পর্যটকরা না আসায় আয় হতো না বললেই চলে। কিন্তু এখন এখানকার পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল সবার আয় বেড়েছে।
আগেই বলেছি, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত সাগরকন্যা পটুয়াখালীর কুয়াকাটা। একদিকে পদ্মাসেতু অন্যদিকে পায়রা সেতু-এ দুইয়ের কল্যাণে বদলাতে শুরু করেছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটার চিরচেনা রূপ। ঝাউবনে গিয়ে দেখা যায় গাছের ডালগুলো চুল ছেড়ার মতো ছিড়ে ফেলা হয়েছে। সাগর পাড়ের গাছগুলো মরে গেছে। আছে শুধু গোড়া। অনেক গাছ কোন রকমে শেকড়ে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। লেবুবনের সেই লেবু গাছ আর নেই। সবকিছু যেনো পরিবর্তন হচ্ছে।
এভাবে আনন্দ-উল্লাসে কেটে গেলো একটি দিন। এবার ফেরার পালা। ফেরার আগে কুয়াকাটা প্রেসক্লাবের সভাপতি নাসিরউদ্দীন বিপ্লবের হাতে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে সাংবাদিকরা তুলে দিলেন সদ্য প্রয়াত সাতক্ষীরার দুই খ্যাতিমান সাংবাদিক মো: আনিসুর রহিম ও সুভাষ চৌধুরীর স্মরণে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ ‘অনন্য আনিস’ এবং ‘সুবাসিত সুভাষ’ নামের দুটি গ্রন্থ। এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক এম জিললুর রহমান, আবুল কাশেম, মোহা: জিল্লুর রহমান, আব্দুস সামাদ, কৃষ্ণ ব্যানার্জী, মো: মোশারফ হোসেন, আহসানুর রহমান রাজিবসহ অনেকেই।
সবমিলিয়ে কুয়াকাটায় কাটানো একটা দিনের স্মৃতি মনের ক্যানভাসে অম্লান হয়ে থাকবে। সফর শেষে রাতের মিষ্টি চাঁদকে সঙ্গী করে পথচলা বারবার আবেগাপ্লুত করে। ফিরতি পথের গাড়ি ছাড়লো রাত পৌনে দশটায়। আবারো সেই একই সিটে বসে বেশ আরামে এক ঘুমে পৌছে গেলাম বরিশাল। পথের ধারে রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে আবার উঠলাম বাসে। এবার ঝালকাঠিতে নানাশ্বশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য নেমে গেলে শেখ তানজির দম্পতি। আমরা ফিরলাম রাত তিনটায়। বাস থেকে নেমেই সোজা বাড়ি। লেখক: বার্তা সম্পাদক, দেনিক পত্রদূত, সাতক্ষীরা
Patradoot satkhira