09/11/2021
বাংলাদেশের প্রথম পর্যটন গ্রাম
(জয়রামপুর এগ্র ট্যুরিজম ভিলেজ)
পর্যটন গ্রামের রূপরেখা বা ধারণাঃ
২০ নভেম্বর ২০২০ এর পূর্বে বাংলাদেশে কোন পর্যটন গ্রাম ছিলনা। করোনাকালীন প্রভাবে পৃথিবীর বাকী অংশের মতো বাংলাদেশের পর্যটন তথা সার্বিক আর্থ-সামাজিক কাঠামো যেভাবে পাল্টে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে, তাতে করে অবিলম্বে পর্যটন গ্রাম স্থাপন করে কৃষি উৎপাদন, সংরক্ষণ, বন্টন, ঔষধি উদ্ভিদের উৎপাদনের মাধ্যমে দেশজ চিকিৎসাকে পুনঃস্থাপন ইত্যাদির মাধ্যমে পর্যটনকে নতুন রূপ দেওয়া এখন সময়ের দাবী।আমাদের নিকটবর্তী দেশ ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে পর্যটন গ্রাম আছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অরুণাচল ও সিকিমে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অনেকগুলি পর্যটন গ্রাম গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে প্রায় ৮৭ হাজার গ্রাম আছে। এদের মধ্য থেকে প্রথমে প্রতিটি জেলার একটি করে গ্রামকে মাত্র ২ (দুই) বছরের মধ্যে সঠিক পরিকল্পনা ও নিয়মতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহনের মাধ্যমে পর্যটন গ্রামে রূপান্তর করা যায়। সরকার বা বেসরকারি উদ্যোক্তা গ্রামের মানুষদেরকে সঙ্গে নিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে।
পর্যটন গ্রাম কী?
কোন গ্রামকে পর্যটনের মাধ্যমে রূপান্তর (Transformation)-এর উদ্দেশ্যে পর্যটন অনুগন্তব্য (Micro-destination) হিসেবে তৈরি করলেই তাকে পর্যটন গ্রাম বলবো। পর্যটন গ্রাম গড়ে তুলতে পারলে গ্রামে সার্বিক উৎপাদনশীলতা বাড়বে, পণ্যের বহুমুখীকরণ সম্ভব হবে এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। গ্রামের মানুষকে গ্রামে রেখে এইধরণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পর্যটনসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক সেবা ও বহুধরণের নিত্যপণ্য উৎপাদন ও বিপণনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশের প্রথম পর্যটন গ্রামের যাত্রা শুরু হলঃ
বাংলাদেশের পর্যটন ইতিহাসে স্মরণীয় একটি ঘটনা ঘটলো ২০ নভেম্বর ২০২০ তারিখ রাত ৯.৩৫ মিনিটে। এইদিন “গ্রামীণ পর্যটন মেলা ও পল্লী সাংস্কৃতিক উৎসব” আয়োজনের মধ্য দিয়ে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলাধীন জয়রামপুর গ্রামকে দেশের প্রথম এগ্রোট্যুরিজম ভিলেজ হিসেবে সূচনা পর্বের উদ্বোধন করা হলো। বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরারস এসোসিয়েশন বিটিইএ এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে দেশের প্রথম ‘Agro Tourism Village বা পর্যটন গ্রাম’। ৯ অক্টোবর ২০২০ তারিখ হতে গ্রামবাসীকে সাথে নিয়ে ‘মিরাকি এগ্রো লিমিটেড’ ও NU Trip Link নামক দুইটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে ‘জয়রামপুর কৃষি পর্যটন গ্রাম’ স্থাপনের কাজ শুরু করে। নভেম্বরের প্রথমসপ্তাহে এই কাজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ এবং তদারকীর জন্য এখানে আসেন বাংলাদেশের প্রান্তিকপর্যটন নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরারস এসোসিয়েশন বিটিইএ এর সন্মানিত চেয়ারম্যান জনাব শহিদুল ইসলাম সাগর। জনাব শহিদুল ইসলাম সাগর এই চলমান কাজের দৃশ্যগুলি সোশ্যাল মিডিয়াতে লাইভ ভিডিও এর মাধ্যমে দেশের সরকারি বেসরকারি পর্যটন বোদ্ধাগনের কাছে তুলে ধরেন এবং তাদের সাথে মত বিনিময়ের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান করেন। এভাবে ২০ নভেম্বর ২০২০ তারিখ প্রাথমিক পর্ব উদ্বোধন করার লক্ষে কাজ এগিয়ে যেতে থাকে। এরপর নির্দিষ্ট দিনেই যশোর জেলা শিল্পকলা একাডেমীর অডিটোরিয়ামে বিটিইএ এর ‘গুণীজন সংবর্ধনা ও জেলা উইমেন স্ট্যান্ডিং কমিটির অভিষেক’ অনুষ্ঠানের মঞ্চে সন্মানিত জেলা এবং জাতিয় পর্যায়ের অতিথিবৃন্দের উপস্থিতিতে দেশের প্রথম এগ্রো ট্যুরিজম ভিলেজ বা পর্যটন গ্রামের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা উপস্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশন এর সন্মানিত সভাপতি জনাব মোখলেছুর রহমান উদ্বোধন ঘোষণা করেন।যশোর জেলা পরিষদের সন্মানিত চেয়ারম্যান জনাব সাইফুজ্জামান পিকুল এই কাজের সার্বিক সহযোগিতা ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার আশ্বাস প্রদান করে আয়োজকগন কে উৎসাহ প্রদান করেন।
এটি বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে এবং এই ধারাবাহিকতায় দেশের ৬৪ জেলাতে আগামী ৩ বছরের মধ্যেই একটি করে ‘মডেল পর্যটন গ্রাম’ এর সুচনা করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এই গ্রামে নিরাপদ খাদ্য তৈরিতে কৃষির চিরায়ত ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির অনুশীলন, অভিজ্ঞতাভিত্তিক প্রাকৃতিক স্কুল ও প্রশিক্ষায়তন, কারুপল্লী, প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন ইত্যাদি অবলোকন করার জন্য পর্যটকরা কৃষি পর্যটনে আসবেন।
অবস্থান ও অবস্থাঃ ভৈরব নদ সংলগ্ন এই গ্রামের পার্শ্বেই রয়েছে একটি প্রাচীন বাওর ও রাধানগর রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ। এই গ্রাম থেকে মাত্র ২.৫ ঘন্টায় নৌপথে বা সড়কপথে ভ্রমণ করা যাবে সুন্দরবনের করমজল ও ডাংমারি। সড়কপথে মাত্র ৪৫ মিনিটে যাওয়া যাবে মাইকেল মধুসুদন দত্ত ৩০ মিনিটে এস এম সুলতানের বাড়িতে। ৩০ মিনিটের ড্রাইভে যশোর বিমান বন্দর পৌঁছে যাওয়া যাবে। মাত্র ১ ঘণ্টায় দক্ষিন এশিয়ার বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল এবং ২ ঘণ্টাতে পৌঁছান যাবে মংলা সমুদ্রবন্দরে।প্রাচীন বাংলার রাজধানী প্রতাপাদিত্যের চাচড়া, মুড়ুলী হাজী মুহাম্মদ মুহাসিন জমিদারবাড়ি, অভয়নগর এগার শিব মন্দির, ২০০০ বছর প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ভরত রাজার দেওল, অষ্টম শতাব্দীর ডালিঝরা বুদ্ধবিহার, মুঘল আমলের মির্জানগর হাম্মামখানা, গাজিকালু-চম্পাবতীর মাজার, বাংলাদেশের একমাত্র ফুলের হাট গদখালি, বীরশ্রেষ্ঠ নুর মুহাম্মদ শেখের সমাধি, দেশের ব্যাস্ততম নোওয়াপাড়া নদীবন্দর, ব্রিটিশ ভারতের সর্বপ্রাচীন কালেক্টরেট ভবন, শেরশাহ সুরী নির্মিত গ্রান্ডট্রাঙ্ক রোডের ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদি মাত্র ১৫ থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যেই দেশি-বিদেশি পর্যটকগণ অনায়াসে পৌঁছে যাবে।
হোমস্টে, গ্রামীণ বাংলো মাটির ঘর এবং ট্রি হাউজ করা হচ্ছে জয়রাপুর গ্রমে। নৌকাতে বসে খেজুরের রস খেয়ে ভৈরব নদে ভেসে বেড়ানো হবে অন্যতম পর্যটন অভিজ্ঞতা। দেশের যে কোন প্রান্ত হতেই এখানে আসা মোটামুটি সহজ।যশোর শহর হতে মাত্র ২৫/৩০ মিনিটের দূরত্বে এই গ্রামের অবস্থান। আর পদ্মা বহুমুখী সেতু চালু হলে ঢাকা হতে মাত্র ৩ (তিন) ঘণ্টায় সড়ক পথে, ২.৫০ মিনিটে রেলপথে এখানে আসা যাবে। উল্লেখ্য, পর্যটকগণ কেউ চাইলে বিমানে ঢাকা হতে মাত্র ৩০ মিনিটে যশোর পৌঁছে এখানে আসতে পারেন। এছাড়াও নৌপথে ঢাকার সদরঘাট হতে বেশ কিছু সরকারী সাধারন বা বিলাসবহুল নৌযানে করে খুলনা পৌঁছে সেখান হতে সড়ক নৌ বা রেল পথে জয়রামপুর পর্যটন গ্রামে আসতে পারেন।
দেশবিদেশের পর্যটকগনের জন্য থাকাখাওয়া দর্শনীয়স্থান ভ্রমণ সরাসরি নৌকা চালানো মাছ ধরা বা কৃষিকাজে অংশগ্রহণের সুব্যাবস্থা সহ সব ঋতুর উপযোগী করে গ্রাম্য নির্মল বিনোদনের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি চলছে ‘জয়রামপুর কৃষি পর্যটন গ্রামে।কারুপল্লি, জৈব পদ্ধতিতে ধানচাল, সবজি, দেশি-বিদেশি ফল, মাছ, দেশি হাঁসমুরগি, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ইত্যাদি উৎপাদন ও বিপণনের উপর প্রশিক্ষণ ও ব্যাবস্থাপনার কাজ শুরু করেছে ‘মিরাকি কৃষি পরিবার’ নামের একটি বেসরকারী কৃষিভিত্তিক সমবায় সমিতি। আশা করা যাচ্ছে ২০২১ সালের শেষার্ধ হতেই পর্যটকরা এই গ্রামে যাবেন পর্যটনের মাধ্যমে জীবন তৈরির উপাদান সংগ্রহ করতে।
ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম পর্যটন গ্রাম "জয়রামপুর এগ্রো ট্যুরিজম ভিলেজ" এর তরুন তরুনীদের কমিউনিটি বেজ পর্যটন, হসপিটালিটি, ট্যুর অপারেশন, ট্যুর গাইডিং এর প্রশিক্ষন প্রদান করা হয়। অতিথি ট্রেইনার হিসাবে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন জনাব এস এম আব্দুল আলিম( Conventional Trainer on Business communication)। ভাষাগত জটিলতা সমাধানে লক্ষ্যে গাইডদের জন্য মোবাইলে 'ভাষা ট্রান্সলেশন এপস' এর ব্যবহার শিখানো হয়। আজকের ১ম পর্বের আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন জয়রামপুর গ্রামের আগ্রহী ২৩ জন তরুন তরুণী।
পর্যটন গ্রামের প্রয়োজনীয়তা:
আধুনিক পর্যটনের অর্থ হলো পর্যটনকে সাশ্রয়ী ও জীবনমুখী করা। পর্যটনের উপাদানসমূহের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে জীবনের উৎকর্ষ সাধন করে মানুষের বিশ্রাম, বিনোদন ও শিক্ষার জায়গাকে নিশ্চিত করা যায়। এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হলে আমাদেরকে কৃত্রিম পর্যটন সেবা থেকে সরিয়ে এনে প্রাকৃতিক পর্যটন সেবার দিকে ধাবিত করতে হবে। পর্যটন গ্রামের প্রয়োজনীয়তা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এখন অনুভূত হচ্ছে এবং করোনা প্রভাবের জন্য অদূর ভবিষ্যতে আরো তীব্রতরভাবে অনুভূত হবে। প্রত্যেকেই নিজেদের সম্পদ ও সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে নানা আঙ্গিকে পর্যটন গ্রাম গড়ে তুলছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিচের কারণগুলির জন্য পর্যটন গ্রাম গড়ে তোলা দরকারি-
ক. পর্যটন গ্রাম হবে পরিচ্ছন্ন ও অধিকতর স্বাস্থ্যসম্মত, যা বসবাসের জন্য অধিক উপযোগী।
খ. কৃষকদেরকে সংগঠিত করে গ্রামে জৈবকৃষির সূচনা হবে, যা গণস্বাস্থ্যের নতুন ভিত্তি রচনা করবে।
গ. মানুষ ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ও কটেজ আকারের পণ্য ও সেবাশিল্প উৎপাদনে এগিয়ে আসবে।
ঘ. স্বল্পশিক্ষিত মানুষকে প্রায়োগিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উৎপাদনশীল মানুষে পরিণত করা যাবে।
ঙ. পর্যটন সেবাপণ্য উৎপাদন ও মানসম্মত সাংস্কৃতিক পণ্যায়ন গ্রামের জিডিপিতে উৎকর্ষী অবদান রাখবে।
চ. মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও শিষ্টাচার বৃদ্ধি পাবে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে।
ছ. প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সকলের মধ্য থেকে দারিদ্র্য দূর করবে।
জ. মানুষের মধ্যে শহরে গমন হ্রাস পাবে।
ঝ. গ্রামে প্রচুর পরিমাণে পরোক্ষ ও আবেশিত কর্মসৃষ্টি হবে, যা মানবিক গ্রাম সৃজনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে।
ঞ. পর্যটন গ্রামে বাইরে থেকে এবং ব্যাংকগুলি ঋণ প্রবাহ সৃষ্টি করতে চাইবে।
ট. গ্রামে আস্থা, ভালবাসা, সহযোগিতা, ত্যাগ ইত্যাদি জাতীয় সামাজিক পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
ঠ. পর্যটন গ্রামগুলি শান্তির গ্রামে (Peace Village) পরিণত হবে।
কী ধরণের পর্যটন পরিচালনা করা যায় পর্যটন গ্রামে?
পর্যটন গ্রামে অন্ততপক্ষে নিচের ১০ (দশ) ধরণের পর্যটন কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব-
ক. কৃষি পর্যটন: এই ধরণের পর্যটনের মাধ্যমে পর্যটকরা কৃষি উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ইত্যাদিসহ ও কৃষিভিত্তিক বহুমাত্রিক জ্ঞান অর্জন করেন। অভিজ্ঞতা সঞ্চয়য়ের উদ্দেশ্যে পর্যটকরা কৃষি কার্যক্রমে অংশগ্রহণও করেন ।
খ. খাদ্য পর্যটন: খাদ্যোপাদান ও রন্ধনকৌশল একেকটি এলাকার ঐহিত্য। তাই পর্যটকরা গ্রাম ভ্রমণকালে উক্ত গ্রামের স্থানীয় খাবারের স্বাদ গ্রহণ করেন বিশেষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য।
গ. আয়ুর্বেদিক পর্যটন: আয়ুর্বেদ পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাকৃতিক চিকিৎসা, যা এই ভারত উপমহাদেশে সৃষ্টি। উদ্ভিদ, প্রাণি ও খনিজ উপাদান থেকে হিতকর এই চিকিৎসা পদ্ধতি পর্যটন গ্রামে সূচনা করতে পারলে পর্যটকদেরকে তা সহজেই আকৃষ্ট করবে। অনেক মানুষ এই চিকিৎসা গ্রহণের জন্য পর্যটন গ্রামে যাবেন।
ঘ. সাংস্কৃতিক পর্যটন: লোক সঙ্গীত, লোক নৃত্যসহ নানা ধরণের লোকজ আচার ও উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হতে পর্যটন গ্রামগুলি। ময়মনসিংহের ঘাটু গান, রংপুরের ভাওয়াইয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গম্ভীরা সংগত কারণেই পর্যটকদেরকে ঐ অঞ্চলের গ্রামগুলিতে আকৃষ্ট করবে।
ঙ. জলাভূমি পর্যটন: দীঘি, বিল, ঝিল, নদী ইত্যাদি যে গ্রামে আছে সেখানে জলাভূমি পর্যটনের জন্য পর্যটকরা অবশ্যই যাবেন। এই ধরণের পর্যটনে জলক্রীড়া, নৌভ্রমণ, নৌযানে রাত্রিযাপন ইত্যাদি নানা ধরণের কর্মকান্ড গ্রামীণ পর্যটনে বিশেষ মাত্রা যোগ করতে পারে।
চ. ঐতিহ্য পর্যটন: প্রত্নসম্পদ, ঐতিহ্যবাহী খাবার কিংবা অন্য কোন ঐতিহ্য পর্যটন গ্রামে থাকলে তা ঐ গ্রামের বাড়তি আকর্ষণের উপাদান হিসেবে কাজ করবে। প্রত্নসম্পদ আছে এমন গ্রামে প্রত্নপর্যটন পরিচালনা করা যাবে।
ছ. মুক্তিযুদ্ধ পর্যটন: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন, বধ্যভূমি ইত্যাদি যে সকল গ্রামে রয়েছে সেখানে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যটনের মাধ্যমে নতুন আঙ্গিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা যায়।
জ. কমিউনিটিভিত্তিক পর্যটন: একটি পর্যটন গ্রামে সকল কমিউনিটির মানুষকে নিয়ে সার্বিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা গেলে তা পর্যটকদের জন্য অনুপম শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করবে। সকল শ্রেণির মানুষের সমন্বিত ও সম্মিলিত কার্য পরিচালনা প্রত্যক্ষ করার জন্য অবশ্যই পর্যটকরা আকৃষ্ট হবেন।
ঝ. দারিদ্র্যবান্ধব পর্যটন: যে পর্যটন থেকে দরিদ্র মানুষেরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়, তাকে দারিদ্র্যবান্ধব পর্যটন বলে। পর্যটন গ্রামে দরিদ্র মানুষদেরকে সরবরাহকারী (Supplier) হিসেবে তৈরি করে তাদেরকে পর্যটনপণ্য উৎপাদনে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত করা যায়। কর্মসৃজন ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য এই পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর।
ঞ. জীবনযাত্রা পর্যটন: পর্যটন গ্রামের মানুষেরা কীভাবে জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন অর্থাৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, কৃষি ও বাণিজ্যিক জীবনযাত্রা নির্বাহে তাদের দৃশ্যমান চিত্র কীরূপ করে তা দেখার জন্য উৎসুক পর্যটকরা যাবেন।
উপসংহার:
গ্রামগুলিকে বিনিয়োগ, উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও আয়ের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে একমাত্র উপায় হলো পর্যটন গ্রাম তৈরি করা। এতে গ্রামীণ পর্যায়ে মানসম্মত পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে মধ্যস্থতাকারীদের হস্তক্ষেপ ব্যাতিরেকে সরাসরি পর্যটকদের কাছে বিক্রয় করা সম্ভব হবে। তরুণ পর্যটকরা গ্রামের মানুষের জীবনধারা দেখে জীবন গঠনে নতুন শিক্ষা গ্রহণ করবে। নগর ও গ্রামের মধ্যে তৈরি হবে ভালবাসা ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক। গ্রামের মানুষের শহরমুখিতা কমবে এবং সর্বোপরি সামাজিক বৈষম্য দূর হবে। সবচেয়ে বড় কথা, করোনাকালে সারা পৃথিবীর যে পরিবর্তন আসছে তাতে করে প্রত্যক্ষ গ্রামোন্নয়নের মাধ্যমে পর্যটনকে ঢেলে সাজানোর কোন বিকল্প নাই মর্মে সারা পৃথিবীর পর্যটন বিশেষজ্ঞগণ একমত পোষণ করছেন।
সর্বশেষে একটি কথা বিশেষভাবে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের যে ভয়াবহ প্রভাব বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ এর সাথে আলোচিত হচ্ছে, সেই ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আংশিক ভাবে হলেও মুক্তি দিতে পারে গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক পর্যটন। কারন গ্রামীণ বা কৃষিভিত্তিক পর্যটনই পারে পাহার, নদী, জলাশয়, প্রকৃতিকে নিজের রুপে রেখে জীবনের স্বাদ উপভোগ করাতে।