03/11/2019
বিষয়ঃ হযরত মুহাম্মদ (দঃ) হলেন নূর।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা হলো- প্রিয় নবী (দঃ) নুরের তৈরী কিন্তু বশরীয়তের কভারে আবির্ভুত। তিনি নুরের সৃষ্টি হওয়ার ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসের অসংখ্য দলিল-প্রমাণ রয়েছে। আমি সবগুলোর বর্ণনা না দিয়ে শুধু সূরা মায়েদার একটি আয়াতের তাফসীর আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতেছি।
সূরা মায়েদার ১৫ নং আয়াত (قد جاءكم من الله نور و كتاب مبين) –এ আয়াতে নুর দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে তার ব্যাখ্যাঃ
১. মুফাস্সির কুল সম্রাট, বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) স্বীয় উল্লেখযোগ্য তাফ্সির “তানভীরুল মিকীয়াস ফী তাফ্সীরে ইবনে আব্বাস” কিতাবে উল্লেখ করেন- (قد جاءكم من الله نور) رسول يعني محمدا অর্থাৎ নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর এসেছে, এই নূরের মর্মার্থ রাসুল তথা মুহাম্মদ (দঃ)।
২. বিখ্যাত মুফাস্সির ও মুহাদ্দিস, মুজাদ্দেদে আলফে আওয়াল, ইমাম জালাল উদ্দীন সূয়ুতী (রঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন- قد جاءكم من الله نور هو النبي صلي الله عليه و سلم –অর্থাৎ নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর এসেছে, সেই নূর হলেন নবী করিম (দঃ)। (তফ্সিরে জালালাইনঃ ১০১ পৃষ্ঠা)
৩. আল্লামা ইমাম খাযেন (রঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন- قد جاءكم من الله نور يعني محمدا صلي الله عليه و سلم انما سماه الله نورا لانه يهتدي به كما يهتدي بالنور في الظلام –অর্থাৎ নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হতে নূর এসেছে তথা মুহাম্মদ (দঃ), শুধুমাত্র আল্লাহ তাঁকে নূর হিসেবে নামকরণ করেছেন, কারণ তার নূর দ্বারা মানুষ হেদায়তপ্রাপ্ত হয়। যেমনিভাবে নূর বা আলো দ্বারা অন্ধকারে পথ খুঁজে পাওয়া যায়। (তাফ্সিরে খাযিনঃ ২/২৪ পৃষ্ঠা, দারুল কুতুব ইসলামিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন)।
৪. ইমাম কাযী নাসির উদ্দীন বায়জাভী (রঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন- قد جاءكم من الله نور قيل يريد بالنور محمد صلي الله عليه و سلم –অর্থাৎ এটাও বলা হয়েছে যে, আয়াতে নূর মানে হযরত মুহাম্মদ (দঃ) কে বুঝানো হয়েছে। (তাফ্সিরে বায়জাভীঃ ২/৩০৭ পৃষ্ঠা, দারুল ফিকর ইসলামিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন)।
৫. বিখ্যাত উসুলবিদ আল্লামা আবুল বারকাত নাসাফী (রঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন- قد جاءكم من الله نور النور محمد عليه السلامঅর্থাৎ নূর হলো মুহাম্মদ (দঃ)। (মাদারিকুত তানযিলঃ ১/৪৩৬ পৃষ্ঠা, দারুল কালামুত তৈয়্যব, বৈরুত, লেবানন)।
৬. ইমাম সৈয়দ মুহাম্মদ আলুসী বাগদাদী (রঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন- قد جاءكم من الله نور– عظيم و هو نور الانوار و النبي المختار صلي الله عليه و سلم - অর্থাৎ নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে মহান নূর এসেছে, আর তিনি হচ্ছেন নূরুল আনোয়ার বা সকল নূরের নূর, আল্লাহর মনোনিত নবী মুহাম্মদ (দঃ)। (তাফ্সিরে রুহুল মায়ানীঃ ৩/২৬১ পৃষ্ঠা)
৭. বিশ্ব বিখ্যাত মুফাস্সির আল্লামা ইসমাইল হক্কী (রঃ) লিখেন- قد جاءكم من الله نور–قيل المراد بالاول هو الرسول صلي الله عليه و سلم – অর্থাৎ কেউ কেউ বলেছেন, প্রথমটা তথা নূর মানে রাসূল (দঃ)। (তাফ্সিরে রুহুল বায়ানঃ ২/৩৭০ পৃষ্ঠা,
৮. আল্লামা কাযী সানা উল্লাহ পানীপথী (রঃ) লিখেন- নূর মানে মুহাম্মদ (দঃ)। (তাফ্সিরে মায্হারীঃ৩/৬৮ পৃষ্ঠা)
৯. আল্লামা ইমাম সাভী আল্ মালেকী (রঃ) “তাফ্সিরে সাভী আলাল জালালাইন” নামক কিতাবে, বিশ্ব বিখ্যাত মুফাস্সির আল্লামা ইমাম ফখর উদ্দীন রাযী (রঃ) “তাফ্সীরে কবিরে”, ইমাম বগভী (রঃ) “তাফ্সিরে মা’আলিমুত তানযিল” নামক কিতাবে, ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (রঃ) “জামেউল বায়ান” নামক কিতাবে, আল্লামা ইমাম শরবীনী (রঃ) তাফ্সীরে সিরাজুম মুনীর নামক কিতাবে, আল্লামা মোল্লা মঈন কাশেফী (রঃ) “তাফ্সিরে হুসাইনী” নামক কিতাবে, আল্লামা ইমাম কাযী আয়াজ মালেকী (রঃ) “কিতাবুশ শিফা” নামক কিতাবে, বিশ্ব বিখ্যাত মুহাদ্দিস ব্যারিস্টারে আহনাফ আল্লামা মোল্লা আলী কারী (রঃ) “শরহে শিফা” নামক কিতাবে, আল্লামা ইমাম কুরতুবী (রঃ) তাফ্সিরে কুরতুবীতে আরো অনেক মুফাস্সিরে কোরআন তাদের প্রত্যেকের কিতাবে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় নূর মানে নবী করিম হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (দঃ) কে বুঝানো হয়েছে বলে মতামত পেশ করেছেন।
১০. হযরত আব্দুর রাজ্জাক স্বীয় “মুসনাদে” হযরত জাবের (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, আমি (জাবের) রাসুলে পাক (দঃ) এর নিকট আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসুল (দঃ) আমার পিতা-মাতা আপনার পদযুগলে উৎসর্গিত হোক সর্বপ্রথম আল্লাহ তায়ালা কোন বস্তু সৃষ্টি করেছেন? তিনি বললেন- হে জাবের! আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম স্বীয় নূর হতে তোমার নবীর নূরকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ঐ নূর আল্লাহর অনুমতিক্রমে যেখানে যেখানে ছিল সর্বত্র ভ্রমণ করতে থাকে। তখন লওহ ছিল না, কলমও ছিল না, বেহেস্ত ছিল না, দোজখ ছিল না, ফেরেস্তা ছিল না, আসমান ছিল না, জমিন ছিল না, চন্দ্র ছিল না, সূর্য্য ছিল না, জিন ছিল না, ইনসান ছিল না। তারপর আল্লাহ যখন অন্যান্য বস্তু সৃষ্টি করতে চান তখন ঐ নূর (নূরে মোহাম্মদী) কে চার ভাগে বিভক্ত করেছেন। এক অংশ হতে কলম, দ্বিতীয় অংশ হতে লওহে মাহফুজ, ৩য় অংশ দিয়ে হতে আরশ সৃষ্টি করেছেন, আর ৪র্থ অংশ দিয়ে বাকী মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন।
অত্র হাদিসটি অতীব দীর্ঘ। হাদিসটি ইমাম বায়হাকী “দালায়েলুন্নবুয়্যত” নামক কিতাবে বর্ণনা করেছেন। প্রখ্যাত ইমামগণ হাদিসটির সনদের উপর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। যথাঃ ইমাম আছকালানী স্বীয় “মাওয়াহেবে”, ইমাম ইবনে হাযর মক্কী “আফজালুল কুরাতে”, আল্লামা কাছীর “মাতাবেউল মুছাররাতে”, আল্লামা যুরকানী “শরহে মাওয়াহেবে”, আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী “মুদারেজুন্নবুয়্যতে”, ইমাম গাজ্জালী “দাখায়েকুল আখবারে” এবং দেওবন্দীদের হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী “নশরুত তীব” নামক কিতাবে বর্ণনা করেছেন।
সুতরাং যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে তারা কোরআন ও হাদিসের দলিলগুলো জানার পরেও না জানার ভান করে নূর নবীকে মাটির মানুষ বলে বেড়াচ্ছে শুধুমাত্র তাদের পূর্ববর্তী আলেমদের ভুল আকীদাকে জীবিত রাখার জন্য। আল্লাহ তাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুক। আমিন।