26/09/2023
বিস্ময় নগরী আলেকজান্দ্রিয়া
====================================
সৈয়দ আখতারুজ্জামান
কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশন
====================================
উত্তরের ইউরোপ থেকে হু হু করে বয়ে আসছে ঠান্ডা বাতাস। আকাশ গাঢ় নীল। একট টুকরো মেঘও নেই কোথাও। সামনে আদিগন্ত সাগর। যতদূর চোখ যায় নীল জলরাশি। আমরা কয়েকজন বঙ্গসন্তান হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি ভুমধ্যসাগরের পাড়ে, মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে। এখন অক্টোবর মাস। জুলাই-আগষ্টের তালপাকা-গরম শেষে বাতাসে শীতের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের সামনে অর্ধবৃত্তাকার, ঘোড়ার খুড়ের মতো, বেঁকে যাওয়া এক অভূতপূর্ব বালুকা বেলা। এখন দুপুর প্রায়। একটু পরেই বিকেল হবে, জলে সোনারঙ ছড়াবে, সূর্য অস্ত যাবে। ভূমধ্যসাগরের এই নীল জল আর সৈকতে আছড়ে পড়া ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ দেখে সকলের কাছে আর দশটা সাগর সৈকতের মতোই সাধারণ মনে হতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ জানবে যে, হাজার বছর ধরে কত কত কিংবদন্তি মানুষ এই সাগরের জল পাড়ি দিয়েই একদিন পা রেখেছিলেন এই সৈকতে, যে সৈকতের পাড়ে এই যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। একদিন ম্যাসাডোনিয়া থেকে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট, রোম থেকে জুলিয়াস সিজার, মার্ক এন্থনিরা এই সৈকতে এসে নেমেছিলেন, শাসন করেছেন মিশর। আলেকজান্দ্রিয়ার সমুদ্র সৈকত ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ হলেও এই কোস্টলাইনের মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ হাজার কিলোমিটার। স্পর্শ করেছে লিবিয়া, লেবানন, তুরস্ক, সিরিয়া, স্পেন, ইতালি, গ্রীসসহ ৩ মহাদেশের মোট ২২টি দেশ। খ্রীষ্টপূর্ব ৩৩১ সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এই শহরের গোড়াপত্তন করেন। বিস্ময়ে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছলাম এই প্রাচীন ঐতিহাসিক কত শত নজিরবিহীন ঘটনা আর আবিস্কারের সাক্ষী এই ছোট্ট শহরটিতে। আকারে ঢাকা শহরের তিন ভাগের দুই ভাগ। আজকে সকালেই আমরা ১৮ জনের এক পর্যটক দল রাজধানী কায়রো থেকে ২১৮ কিলোমিটার উত্তরে মিশরের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেকজান্দ্রিয়ায় এসে পৌঁছেছি।
যেহেতু আমাদের হাতে সময় কম। আর আলেকজান্দ্রিয়ার মতো এত ঘটনাবহুল একটি শহর যার অলিতে গলিতে মহাসড়কে কত কিছু দর্শনীয় ছড়িয়ে আছে যা এত অল্প সময়ে দেখে শেষ করা মুশকিল। তাই আমরা দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। শুরুতেই চললাম আলেকজান্দ্রিয়ার রোমান থিয়েটার দেখতে। এম্ফিথিয়েটার। শহরের কেন্দ্রে ‘কম এল দিক্কা’ এলাকায় এটি একটি পুরাতাত্ত্বিক সাইট হিসেবে সংরক্ষিত। এম্ফিথিয়েটারটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল। কেউ জানাতো না রোমান থিয়েটারটি কোথায় হারিয়ে গেল। ১৯৬০ সালে একটি বিল্ডিংএর খনন কাজ চলাকালে এক নির্মান শ্রমিকের কোদালের তলায় এর একটি পিলার ঘটাং করে আওয়াজ করে। পরে খনন করলে এম্ফিথিয়েটারটি আবিস্কার হয়। ‘কম এল দিক্কা’ আরবি শব্দ যার মানে হলো বেঞ্চির পাহাড়। যেহেতু স্টেডিয়ামের মতো ধাপে ধাপে বসার ব্যবস্থা তাই এমন নাম। একসময় এখানে মিউজিক্যাল পারফরমেন্স হতো। এটি ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার সবচেয়ে জমজমাট স্থানের একটি এবং আলেকজান্দ্রিয়ার অন্যতম আইকন। ধারণা করা হয় মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি ৭শ’ থেকে ৮শ’ আসন ক্ষমতা সম্পন্ন এই থিয়েটারটি কোন এক যুদ্ধে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।
গাইডের কাছে আবদার করি, সেরাপিউম অফ আলেকজান্দ্রিয়া দেখতে চাই। সেটা তো কাছেই হওয়ার কথা। সেরাপিউম অফ আলেকজান্দ্রিয়া ছিল তখনকার সময়ে গ্রীক কলোনির সবচেয়ে বড় গ্রীক মন্দির। প্রথম টলেমির নাতি তৃতীয় টলেমি ইউয়েরগেটস এটা বানিয়েছিল। বিশাল সেই মন্দিরের সাথে আছে এক লাইব্রেরি। গাইড বললো, সংস্কার কাজ চলায় সেরাপিউমের একটা বড় অংশ এখন বন্ধ আছে, আর লাইব্রেরির অস্তিত্ব এখন আর নেই। আর এই সেরাপিউমের উপরেই শত্রুদের সবেচয়ে বেশি আক্রমন হয়েছে। ৩৯১ সালে রোমান সৈন্যদের আক্রমণে মন্দিরটি ধ্বংস হয়। এরপর এখানে একটি মনাস্ট্রি বানানো হয়। দুইশ বছর পর সেটাও ধ্বংস হয়। তারপর একটি চার্চ বানানো হয়। চারশ বছর পর দশম শতাব্দীতে সেটিও ধ্বংস হয়। এখন এখানে পরে রয়েছ সেই ধ্বংসের স্মৃতি। আমরা যাওয়ার পথে দেখলাম চারপাশে উন্নয়ন কাজ চলছে।
এবার আমাদের গন্তব্য, কাটাকম্ব অফ কম আল শোকাফা। পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম, সারা জগত জুড়েই এই ভাঙা আর গড়ার খেলা। যুগে যুগে মানুষই মানুষের সৃষ্টিকে ধ্বংস করেছে। ক্ষমতা আর ধন সম্পদের লোভে একের পর এক সভ্যতার বিস্ময়কর নিদর্শনগুলো নিশ্চিহ্ন করেছে।
‘কম আল দিক্কা’র মতো ‘কম আল শোকাফা’ও একটি স্থানের নাম। পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর নামের বাংলা করলে দাঁড়ায় অমুক স্থানের অমুক নিদর্শন। সে হিসাবে বলতে হবে ‘কম আল শোকাফা’র কাটাকম্ব। কাটাকম্ব মূলত একটি খাড়া কবরস্থান। প্রথমে শুনে বেশ অবাক লেগেছিল। আমরা প্রথমে এন্ট্রি টিকেট কেটে সারিবদ্ধ হয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা বিশাল আকারের কুয়ার মধ্যে প্যাঁচানো সিড়ি দিয়ে নিচের দিকে নামতে থাকি। পুরনো ধূলি ধূসরিত প্রাচীন কূপের দেয়াল ঘেঁষে আতি সরু সিড়ি দিয়ে নামাতে নামতে এক সময় মনেহচ্ছিল পাতালপুরীতে নামছি। একদম নিচে নামার পর একটা হল ঘর দেখতে পাই। আর তার দেয়াল জুড়ে অনেক রোমান ও মিশরীয় নকশা, পেইন্টিং, কারুকার্য আর চারকোনা অনেকগুলো বড় আকারের গর্ত। গাইড জানালেন, এই গর্তগুলোর মধ্যেই রাখা হতো মৃত দেহ। হল ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে রোমান যুদ্ধপোষাক পরা দেবতা আনুবিস ও সোবেক। মাটির এতটা নিচে এই আলো আঁধারের ভৌতিক আবহে গা ছমছম করতে থাকে। গাইড আরো জানালেন, এটি দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শতাব্দীতে কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার হয়। তারপর কালের গর্ভে হারিয়ে যায় এই কাটাকম্ব। ১৯০০ সালে একটি গাধা হঠাত একটি ছোট গর্তের মধ্যে পড়ে গেলে তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে এই কূপ আবিস্কৃত হয় এবং পুরাতত্ত্ববিদরা খনন করে এই কবরস্থান আবিস্কার করেন। তিন স্তর বিশিষ্ট এই কবরস্থানের একটি স্তরে ছিল মৃতের স্বজনদের বসার বেঞ্চ যেখানে বসে মৃত সৎকারের কার্যক্রম দেখতেন তারা। অনুমান করি, মৃত্যুর পর প্রতাপশালী রাজা ছাড়া অন্যান্য রাজা-রানীদের কপালে পিরামিড জুটতো না। আর সাধারণ মিশরীয়দের কথা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু মৃত্যু পরবর্তী জীবনের উপর বিশ্বাস ছিল সকল মিশরীয়দেরই সমান। তাই পিরামিডের কবর না হলেও কাটাকম্বের কবরস্থানেও প্রায়ই একই রকম ব্যবস্থার নমুনা দেখা যায়। মৃতের সাথে তার প্রিয় জিনিসপত্র দিয়ে দেয়া, দেবতাদের মূর্তির উপস্থিতি ইত্যাদি।
আমাদের এর পরের গন্তব্য ভূমধ্যসাগরের পাড়ে ফারোস দ্বীপে দাঁড়িয় থাকা কাইতবে দুর্গ। তখন দ্বীপ ছিল কিন্তু এখন স্থল পথের সাথে মিশে একই ভূখন্ড হয়ে গেছে। এখানেই ছিল প্রাচীন সপ্তমাশ্চর্যের সেই বিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর। আমরা ভাবতে থাকি বাতিঘর গেলো কোথায়? জানি মূল বাতিঘরটি বহু আগেই ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু আশা করেছিলাম এত বিখ্যাত মনুমেন্টটির আদলে অন্তত কিছু একটা থাকবে। কিন্তু নি:সঙ্গ কাইতবে দুর্গ আর সাগরের বন্দর-পাড়ে কাকডাকা মাছের নৌকার ভিড় ছাড়া আর কিছু নেই। রাজা প্রথম টলেমি এই বাতিঘরের নির্মান কাজ শুরু করলেও শেষ করে যেতে পারেন নি। খ্রীষ্টপূর্ব ২৭৯ সালে এই কাজ শেষ করেন দ্বিতীয় টলেমি। এখন এই কাইতবে দুর্গ একটি মেরিটাইম মিউজিয়াম পেটের মধ্যে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বাতিঘরটি কেবলই স্মৃতি। বাতিঘরটি কেন সপ্তমাশ্চর্যের অন্যতম ছিল সেটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। কী এমন বিশেষত্ব ছিল এই বাতিঘরের। বাতিঘরটির উচ্চতা ছিল ৩৮৭ ফুট। অনুমান করার চেষ্টা করি ৩৮৭ ফুট মানে প্রায় ৪০ তলা বিল্ডিং এর সমান। তার মানে কত বিশাল ছিল এর উচ্চতা! আর গোড়ার দিকটা দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ১০০ ফিট করে। এত বড় আকারের বাতিঘরে আজকের দুনিয়াতের নজরে পড়েনা। রাজা প্রথম টলেমি দুনিয়াকে তার শক্তির মহিমা বোঝানোর জন্য এই বাতিঘর বানান, ফলে এই প্রকান্ড আকারের পেছনে কি কারণ থাকতে পারে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু অদৃষ্টের এমনই পরিনাম প্রথম টলেমি এই বাতিঘর দেখে যেতে পারলেন না। আমি শুধু কল্পনায় দেখতে পাই, যখন পৃথিবীতে সমুদ্রই হয়ে উঠেছিল বিশ্বজয়ের অন্যতম প্রধান পথ তখন এই বাতিঘর কত পথহারা নাবিককে পথ দেখিয়েছে! ভাবি, সারা বিশ্বের সবচেয়ে যা আশ্চর্যজনক তার তিন তিনটা বস্তুই এই দেশে আর দুইটা এই শহরেই! একটু আগে যে কাটাকম্ব দেখে আসলাম ওটাও কিন্তু মধ্যযুগের সপ্তমাশ্চর্যের একটি।
কাইতবে দুর্গ দেখে আমরা ছুটতে থাকি আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির দিকে। বিকেল হয়েছে। একটু পরেই সূর্য অস্ত যাবে। এই লাইব্রেরি না দেখতে পারলে আলেকজান্দ্রিয়া ভ্রমণ বৃথা। এই লাইব্রেরিতে পড়েছেন জ্যামিতির জনক ইউক্লিড। এই লাইব্রেরিতে রাখা ছিল এরিষ্টটল, প্লেটো আর পিথাগোরাসের মতো বিশ্বখ্যাত দার্শনিক আর গণিতবিদদের মূল লেখা। আরো কত কী! বলে শেষ করা যাবে না। আমরা দস্তুর মতো ছুটতে থাকি। ঘড়িতে চারটার বেশি বাজে। এই লাইব্রেরির একটি অংশে কড়া নিরাপত্তায় রাখা আছে কিছু প্রাচীন পুঁথি বা স্ক্রল। সেই অংশটা আরো আগে বন্ধ হয়ে যায়। আমরা লাইব্রেরিতে ঢুকেই একটি গাইডেড ট্যুর নিয়ে নেই। নইলে এত বিশাল লাইব্রেরি এত অল্প সময়ে ঘুরে দেখা কোনভাবেই সম্ভব না। তাছাড়া লাইব্রেবির ইতিহাসটুকুওতো জানতে চাই। শুরুতেই প্রাচীন পুঁথির অংশটা আমরা আগে দেখে নেই। ধারণা করি, কয়েকশ পুঁথি রাখা আছে এখানে, যা মূলত প্যাপিরাস কাগজের উপর লেখা। কিন্তু ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন এই লাইব্রেরিতে কয়েক লক্ষ বই ও স্ক্রল ছিল। সব বই রাখার মতো ধারণক্ষমতাও ছিল না এই লাইব্রেরির। ফলে রাজা টলেমি সেরাপিউমে আরো একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। সেরাপিউমের সেই ক্ক্ষে প্রায় ৪০ হাজার স্ক্রল ছিল বলে জানা যায়। এই লা্ইব্রেরিটি পুড়ে যাওয়া সারা বিশ্বের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। কে আগুনে পুড়িয়েছে এ নিয়েও আছে বিতর্ক। কেউ বলেন আরবরা পুড়িয়ে দিয়েছে। কেউ বলেন, এর জন্য পক্ষান্তরে জুলিয়াস সিজারই দায়ী। জুলিয়াস সিজার যখন বন্দরের নৌবহরে আগুন দেয়ার জন্য তার সৈন্যদের নির্দেশ দেন তখন সতর্কতার অভাবে আগুনের লেলিহান শিখা বন্দরের লাগোয়া লাইব্রেরিটিকেও পুড়িয়ে দেয়। কেউ বলেন, না সিজারের সেই আগুনে মূল লাইব্রেরি অক্ষতই ছিল। বিতর্কের শেষ না হলেও অমূল্য লাইব্রেরিটি শেষ রক্ষা হয়নি। জানা যায়, রাজা দ্বতীয় টলেমির ছেলে তৃতীয় টলেমি এই স্ক্রল বা বই সংগ্রহ করতে এতটাই আগ্রহী ছিলেন যে বন্দরে আসা সকল জাহাজ তল্লাশি করে যদি কোন পুঁথি বা বই পাওয়া যেত তাহলে সেটা চলে যেত আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে। সেখানে এই পুঁথির দ্রুত অনুলিপি তৈরি করার পর আসলটি রেখে দিয়ে নকলটি ফেরত দিয়ে দেয়া হতো। এভাবে সারা দুনিয়ার জ্ঞানের সংগ্রহশালা হয়ে উঠেছিল এই লাইব্ররি। মনে পড়ে খুবই উৎফুল্ল অনুভব করি, এই লাইব্রেরির চিফ লাইব্রেরিয়ান ছিলেন সেই বিখ্যাত এরাটোস্থেনিস, যিনি স্রেফ একটি কাঠির ছায়া দিয়ে পৃথিবীর পরিধি নির্ভুলভাবে মেপেছিলেন সেই হাজার বছর আগে। তখনকারদিনের গ্রীক, রোমান আর মিশরীয় মনিষীদের প্রতিভা আজো বিস্ময় জাগায়। আর আলেকজান্দ্রিয়া ছিল সেই সব জ্ঞানপিপাসুদের মিলনকেন্দ্র।
সব কিছু ঘুরে দেখার পর বোকার মতো গাইডকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কি আমাদের দেখাত পারো ইউক্লিড কোথায় বসে পড়তেন বা এরাটোস্থেনিস কোথায় বসতেন? গাইড বিমর্ষমুখে জানায় আসল আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি পুড়ে গেছে এবং পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে যার অবস্থান ছিল এই নবনির্মিত লাইব্রেরির কাছেই। আসলে আমার মনজগতে আমি সেই দুই হাজার বছর আগের লাইব্রেরিতেই ঘুরছিলাম যেন। স্কুলে পড়া চরিত্রগুলোকে যেন দেখতে পাচ্ছিলাম চোখের সামনে।
হোটেলে ফিরে এসেও ঘোর কাটলো না। ডিনার করে আবার বের হই রাতের আলেকজান্দ্রিয়া দেখতে। আবার কবে আসবো এই শহরে কে জানে! আদৌ কি আসা হবে আর! ঘোর লাগা মানুষের মতো হাঁটতে থাকি পথ ধরে। এই সেই পথ, হয়ত এই পথেই জুলিয়াস জিসার, ক্লিওপেট্রা, ইউক্লিডরা হেঁটেছেন, ঘোড়ায় চড়ে ধূলো উড়িয়ে ছুটে গেছেন। কত কত যুদ্ধ হয়েছে, কত কত মানুষের রক্তে ভেসেছে এই পথ, কত আগুনের পোড়া ছাইয়ে মেঘাচ্ছন্ন হয়েছে এই আলেকজান্দ্রিয়ার আকাশ। গভীর রাতে ভূমধ্যসাগরের পাড়ে এক কফিশপে বসে এক কাপ কফি খাই। আলেকজান্দ্রিয়ার কফির জগত জোড়া খ্যাতি। এই মধ্যরাতেও সাগর পাড়ের রাস্তা পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত। কে বলে আলেকজান্দ্রিয়া ঘুমায়। নক্ষত্রের মতো তাকে ঘিরে পৃথিবীর সব ভ্রমণ পিপাসু গ্রহেরা প্রদক্ষিণ করতেই থাকে, তবু তাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটে না।
*** সমাপ্ত ***