06/01/2016
পাহাড়ের সুন্দরবন পাবলাখালি
জনমানুষের কোলাহল এড়িয়ে যারা একটু নীরবে আর নিভৃতে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন তাদের জন্যই চমত্কার এক স্থান হতে পারে পাবলাখালি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম জেলা রাঙামাটির প্রায় শেষপ্রান্তে অবস্থিত জীববৈচিত্র্যময় এই অভয়ারণ্যটি তার অবস্থানের কারণেই তুলনামূলক কম পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত হয়। তবে পথের সামান্য কষ্টটুকু মেনে নিয়ে যারা একটিবারের জন্য হলেও পাবলাখালির এই অভয়ারণ্যে এসেছেন তাদের কখনোই খালি হাতে ফিরতে হয়নি। বরং সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝে সবুজের সমারোহ আর ফাঁকে ফাঁকে বয়ে চলা হরদের সবুজ পানির যুগলবন্দীতে এক অনন্য অভিজ্ঞতাই সঙ্গে করে নিয়ে ফিরেছেন তারা। রাঙামাটি শহর থেকে পাবলাখালির দূরত্ব একশ কিলোমিটারেরও বেশি। এখানে আসার জন্য দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে রাঙামাটি এসে সেখান থেকে মারিস্যাগামী লঞ্চে চড়ে নামতে হবে মাইনীমুখ। তারপর এখান থেকে ইঞ্জিন নৌকায় করে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যাবে পাবলাখালির বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে। পাবলাখালি মূলত পাহাড়ি বন এবং এই বনের ভেতর প্রায় হাজার খানেক ফুট উচ্চতার পাহাড়ও রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই এখানে বহু বন্যপ্রাণীর বসবাস থাকলেও এ সম্পর্কে লিপিবদ্ধ আকারে প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায় সেটা ১৯৫৪ সালের এক জরিপের। তখনকার হিসেব অনুযায়ী প্রায় ২,৫৪০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কাসালং সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রায় ৪৫০ বর্গকিলোমিটার নিয়ে ছিল পাবলাখালির বিস্তৃতি। কিন্তু কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে হরদের উপচানো জলে বনের বহু এলাকা নিমজ্জিত হলে এ বনের আয়তন পরবর্তী সময়ে কিছুটা সংকুচিত হয়ে পড়ে। বন্যপ্রাণী আর প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের জন্য ১৯৬২ সালের জুন মাসে এটিকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ছাড়া স্বাধীনতার পরে ১৯৮৩ সালে এটিকে পুনরায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। বর্তমানে এ অভয়ারণ্যটি রাঙামাটি জেলার কাসালং রেঞ্জের দক্ষিণ-পূর্বে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। নানা সময়ে প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপর্যয়ের কারণে পাবলাখালি অভয়ারণ্যের প্রাণীবৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হলেও এখনও এখানে দেখা মেলে বুনো হাতি, বিভিন্ন প্রজাতির বানর, উল্লুক, বুনো কুকুর, বন্য শুকর, সাম্বার হরিণ, বনরুই প্রভৃতির। এ ছাড়া এই অভয়ারণ্যে রয়েছে বহু প্রজাতির পাখি এবং আদি গর্জন, জারুল, চম্বল, সেগুন, কাঞ্চন, চাপালিশের মতো নানা প্রজাতির গাছ।
পাবলাখালি পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে রাঙামাটি শহর থেকে ১১২ কিলোমিটার দূরে কাপ্তাই হ্রদের একেবারে উত্তর প্রান্তে কাসালং নদীর পাশে অবস্থিত। নদীর দুই পাড় জুড়ে সবুজ আর সারি সারি মানুষের বসতি, পানকৌড়ি আর অচেনা পাখির ঝাঁকে ঠাসা পুরোটা পথ। বর্ষাকাল এ পথের পাহাড়গুলোর গায়ে ছোট বড় অনেক পাহাড়ি ঝর্না দেখা যায়। এ পথে শুভলং, বর্ণছড়ি, লঙ্গদু, মাইনী হয়ে পৌঁছাতে হবে পাবলাখালি।
এই বন যেন পাহাড়ের সুন্দরবন। বনে হাতির পাল, কয়েক প্রজাতির বানর, উল্লুক, বন্য শুকর, সাম্বার হরিণ, বনরুই প্রভৃতির বসবাস এই জঙ্গলে। আর প্রচুর পরিমাণে পাখির সমারোহ ৪২ হাজার ৮৭ হেক্টর আয়তনের এই বনজুড়ে। আছে সারি সারি আদি গর্জন, জারুল, চম্বল, সেগুন, কাঞ্চন, চাপালিশের মতো নানান প্রজাতির গাছ।
এতো দীর্ঘকায় প্রাচীন বৃক্ষ পাহাড় অন্য কোথাও চোখে পরে না। এখানে বন বিভাগ তৈরি করেছে গেস্ট হাউজ। তার পাশে এক অসাধারণ সুন্দর দৃশ্য- বড় বড় বানরের ঝাঁক, মানুষের এতো কাছাকাছি এমন সহজ বিচরণ বেশ আনন্দ দেয়।
পাবলাখালি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ভ্রমণে গেলে প্রথমে যেতে হবে রাঙামাটি সদরে। ঢাকার কলাবাগান, ফকিরাপুল ও কমলাপুর থেকে সরাসরি রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় ডলফিন পরিবহন, এস আলম, সৌদিয়া পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন, ইউনিক সার্ভিস ইত্যাদি। রাঙামাটি শহর থেকে পাবলাখালির দূরত্ব একশ কিলোমিটারেরও বেশি। এখানে আসার জন্য দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে রাঙামাটি এসে সেখান থেকে মারিস্যাগামী লঞ্চে চড়ে নামতে হবে মাইনীমুখ। তারপর এখান থেকে ইঞ্জিন নৌকায় করে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যাবে পাবলাখালি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে। ভাড়া জনপ্রতি ১৭০ থেকে ২০০ টাকার মতো। তবে শুষ্ক মৌসুমে রাঙামাটি-বাঘাইছড়ি নৌপথ বন্ধ থাকে। সেক্ষেত্রে সরাসরি বাঘাইছড়ি হয়ে যেতে হবে। ইঞ্জিনবোটই তখন ভরসা।
পাবলাখালি ভ্রমণে গেলে থাকতে পারবেন মাইনীমুখ বাজারে। জায়গাটিতে থাকার জন্য সাধারণ মানের কিছু আবাসিক হোটেল আছে। কক্ষ ভাড়া ২০০-৩০০ টাকা। এছাড়া বন বিভাগের একটি বাংলো আছে সেখানে। মাইনীমুখ থেকে জল পথে প্রায় ২০ মিনিট দূরত্বে অবস্থিত লংগদু উপজেলা সদরের জেলা পরিষদ বিশ্রামগারেও থাকতে পারেন।