20/12/2022
জান্নাতি পাথর "হাজরে আসওয়াদ"
হাজরে আসওয়াদ - কাবা ঘরের দেয়ালে বিশেষভাবে স্থাপনকৃত একটি পাথরের নাম। আরবি ‘হাজর’ শব্দের অর্থ পাথর আর ‘আসওয়াদ’ শব্দের অর্থ কালো। অর্থাৎ কালো পাথর। ‘হাজরে আসওয়াদ’ বেহেশতের মর্যাদাপূর্ণ একটি পাথর। হজযাত্রীরা হজ করতে গিয়ে এতে সরাসরি বা ইশারার মাধ্যমে চুম্বন দিয়ে থাকেন।
হাজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে কিভাবে পৃথিবীতে এলো ?
ইব্রাহিম আঃ কর্তৃক পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ একটি স্বীকৃত বিষয় যা কুরআনে কারীম ও বিভিন্ন হাদীসে নববী দ্বারা প্রমাণিত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন - “স্মরণ করুন সে সময়ের কথা যখন ইব্রাহিম আ: ও ইসমাঈল আ: কাবা ঘর নির্মাণ করে ছিলেন আর বলে ছিলেন, হে আমাদের প্রভূ! আপনি আমাদের পক্ষ হতে উহা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা এবং সর্ব জ্ঞাতা।” [সূরা আল-বাকারা : ১২৭]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী - ‘যদি কেউ অশ্লীলতা ও পাপাচারে না জড়িয়ে হজ্জ কার্য সম্পাদন করতে পারে। তবে সে হজ্জ হতে এমনভাবে প্রত্যাবর্তন করবে। যেন সে সদ্ব্য জন্মলাভ করলো।’ [ফাতহুল বারী ৪/২৫ হা. ১৫২১]
ইব্রাহিম আঃ পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ করেছেন,যখন তিনি কাবাঘর এর একটি গঠনে দাঁড় করিয়েছেন তখন তিনি তার ছেলে ইসমাঈল আ: কে ডেকে বললেন, হে ইসমাঈল কাবাঘর নির্মাণ গিয়েছে , সকলে যে তওয়াফ করবে, এ তওয়াফ যেন সুন্দরভাবে করতে পারে সেজন্য একটি চিহ্ন দরকার, একটি পাথর নিয়ে আসো, যেটি আমি এই কাবা শরীফ এ সেঁটে দিবো। তখন ইসমাঈল আ: বললেন, হে সম্মানিত পিতা আপনি আদেশ করেছেন আমি অবশ্যই পালন করব, তবে পিতা আমি এতক্ষন আপনার সাথে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পরেছি,এই মুহূর্তে পারছিনা কিছুক্ষণ পর নিয়ে আসি, পিতা বললেন, তুমি যতই ক্লান্ত হওনা কেন যাও একটি সুন্দর পাথর নিয়ে আসো যেটি আমি এখানে সেঁটে দিব। তখন ইসমাঈল আ: তার পিতার আদেশ পালন করার উদ্দেশ্যে বের হলেন,তিনি পাথরের খোঁজে কিছুটা দূরে গেলেন,যাওয়ার পর তিনি একজন ব্যক্তি দেখতে পেলেন, উনি বুঝতে পারেন নি তিনি একজন ফেরেশতা ( জীবরাইল আ:)। তিনি হাতে একটি পাথর নিয়ে এসেছেন,এত সুন্দর পাথর যে পাথরটি দুধের থেকেও সাদা ধবধবে ছিল। পাথরটি নিয়ে ইসমাঈল আ: এর হাতে দিয়ে বললেন যাও ইসমাঈল তোমার পিতাকে দিয়ে আসো এবং বলো এই পাথরটি দুনিয়ার কোন পাথর নয়,বরং এই পাথরটি আল্লাহ তা'য়ালা জান্নাতি পাথর ভেঙ্গে একটি টুকরা তোমার এবং তোমার পিতার জন্য পাঠিয়েছেন। তখন ইসমাঈল আ:সেই পাথরটি নিয়ে তার পিতার হাতে দিলেন,ইব্রাহিম আঃ সেই পাথরটি নিয়ে কাবা শরিফ আ সেঁটে দিলেন।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ(সঃ) বলেছেন , ‘কিয়ামতের দিন এ পাথর আবু কুবাইস পাহাড় থেকে বড় আকার ধারণ করে উপস্থিত হবে। তার একটি জিহ্বা ও দুটি ঠোঁট থাকবে, (বায়তুল্লাহর জিয়ারতকারীরা) কে কোন নিয়তে তাকে চুম্বন করেছে, সে সম্পর্কে বক্তব্য দেবে। ’ (ইবনে খুজায়মা : ৪/২২১, মুসতাদরাকে হাকেম : ১/৪৫৭)।
হাজরে আসওয়াদের ঐতিহাসিক তথ্যঃ
ইসলামপূর্ব কোরাইশদের যুগে কাবা শরিফের গিলাফ যখন পুড়ে গিয়েছিল, তখন হাজরে আসওয়াদও পুড়ে গিয়েছিল। ফলে তার কৃষ্ণতা আরো বৃদ্ধি পায়।
আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.)-এর শাসনামলে হাজরে আসওয়াদ ভেঙে তিন টুকরো হয়ে গিয়েছিল। ফলে তিনি তা রুপা দিয়ে বাঁধাই করেছেন। আর তিনিই সর্বপ্রথম হাজরে আসওয়াদকে রুপা দিয়ে বাঁধানোর সৌভাগ্য অর্জনকারী।
• ১৭৯ হিজরিতে আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদ হাজরে আসওয়াদকে হীরা দিয়ে ছিদ্র করে রুপা দিয়ে ঢালাই করেন।
• ৩১৭ হিজরিতে কারামতিয়ারা হারাম শরিফে অতর্কিত আক্রমণ করে হাজরে আসওয়াদ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরে ৩৩২ হিজরিতে ফিরিয়ে এনে চুনা দিয়ে তার চারপাশ এঁটে দেওয়া হয়।
• ৪১৩ হিজরিতে এক নাস্তিক লৌহ শলাকা দ্বারা হাজরে আসওয়াদের ওপর হামলে পড়ে। ফলে তা ছিদ্র হয়ে যায়। এরপর বনি শায়বার কিছু লোক তার ভগ্নাংশগুলো একত্রিত করে কস্তুরী দ্বারা ধৌত করে তার টুকরোগুলো ফের জোড়া লাগিয়ে দেয়।
• ১৩৩১ হিজরিতে সুলতান মুহাম্মদ রাশাদ হাজরে আসওয়াদের চারপাশে রুপার একটি নতুন বেষ্টনী তৈরি করে দেন।
• ১৩৫১ হিজরির এপ্রিলের ১৮ তারিখে বাদশাহ আবদুল আজিজ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও আলেম-ওলামাসহ কাবা শরিফে উপস্থিত হন এবং হাজরে আসওয়াদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য তাতে মেশকে আম্বরের মতো মূল্যবান পাথর সংযুক্ত করেন।
• ১৪১৭ হিজরিতে পবিত্র কাবাঘরের সঙ্গে হাজরে আসওয়াদেও বিশেষ রুপার দ্বারা নতুন বেষ্টনী স্থাপিত হয়।
সাদা হাজরে আসওয়াদ কালো হলো কেন?
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'হাজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে এমন অবস্থায় অবতীর্ণ হয়েছিল; যখন এটি দুধ হতেও বেশি সাদা ছিল। কিন্তু এটিকে আদম সন্তানের গুনাহ এমন কালো করে দিয়েছে।' (তিরমিজি, ইবজে খুজায়মা, মিশকাত, তালিকুর রাগিব)
হাজরে আসওয়াদ একটি আলোকপ্রভা, উজ্জ্বল পাথর ছিল। যার আলোকে নিষ্প্রভ করে দেওয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে-
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি, 'হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহিম জান্নাতের ইয়াকুত (দীপ্তিশীল মূল্যবান মণি) থেকে দুটি ইয়াকুত। আল্লাহ্ তাআলা এই দুটির আলোকপ্রভা নিম্প্রভ করে দিয়েছেন। এ দুটির আলোকপ্রভা যদি তিনি নিস্তেজ করে না দিতেন তাহলে তা পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে যা কিছু আছে সব আলোকিত করে দিত।' (তিরমিজি, মিশকাত)
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস দ্বারা প্রমাণ হয়ে গেলো, সত্যিই হাজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে উজ্জ্বল আলো ও দুধের চেয়ে ধবধবে সাদা অবস্থায় দুনিয়াতে আসে। আর তা মানুষের গুনাহের কারণে আস্তে আস্তে কালোতে পরিণত হয়।