08/09/2022
সাজেকের গল্প-৩
মামনী,
আজকে আমরা গল্প করবো সাজেক থেকে ঢাকায় ফেরা নিয়ে। এমনিতে সাজেক থেকে ঢাকায় ফেরায় কোন এ্যাডভেঞ্চার থাকার কথা নেয়। কিন্তু ঐ যে, আমার যাওয়ার সময়ই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, আমাদের এইবারের ভ্রমনে আমরা সুযোগ পেলেই একটু এ্যাডভেঞ্চার যোগ করার চেষ্টা করবো।
সাধারনত, কেউ সাজেক বেড়াতে গেলে চাঁদের গাড়ি বা অটো রিজার্ভ করে যাতায়াত করে। অর্থাৎ যাওয়ার জন্য যে গাড়িটা নেয় সেই গাড়িটা রেখে দিয়ে আবার সেই গাড়িতেই ফিরে আসে। কিন্তু আমরা আসার সময় যে গাড়িতে করে এসেছিলাম সেটা ছেড়ে দিয়েছিলাম এ্যাডভেঞ্চার করবো এই উদ্দেশ্যে মাথায় রেখে।
এমনিতে রাতে বৃষ্টি হওয়াতে সকালটা বেশ ঝকঝকে এবং স্নিগ্ধ লাগছিলো। যেহেতু আমাদেরকে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে হবে। সেই রাঙ্গামাটির শেষ প্রান্ত সাজেক থেকে বাংলাদেশের মাঝামাঝি রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত। এবং কীভাবে যাবো সেই বিষয়ে কোন ধারণা বা অভিজ্ঞতাও কোনটাই নেই। তাই সকাল সকাল কংলাক ছেড়ে রুইলুই এর উদ্দেশ্যে বের হলাম। পরিকল্পনা হচ্ছে, স্থানীয় মানুষদের যাতাযাতের জন্য যে গাড়ি ব্যবহার করে সেই গাড়িতে করে স্থানীয় মানুষদের সাথে গল্প করতে করতে খাগড়াছড়ি যাবো।
কিন্তু, সাজেক থেকে কোন লোকাল গাড়ি তো খাগড়াছড়ি যায় না। প্রথমে যেতে হবে বাঘাইছড়ি। সেখান থেকে দীঘিনালা। সেখান থেকে খাগড়াছড়ি। ভ্রমনের রুটের বিবরন শুনে প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও যা আছে কপালে বলে লোকাল গাড়িতে স্থানীয়দের সাথে ঠাসাঠাসি করে বসে পড়লাম। অবশ্য যেহেতু কংলাক থেকে নাস্তা না করে বের হয়ে ছিলাম তাই রুইলুই পাড়াতে খুব মজার একটা খিচুড়ি দিয়ে নাস্তা করলাম। খিচুড়ির সাথে ছিলো ডিম, পেঁয়াজের ভর্তা এবং আচার।
যাত্রার শুরুতেই এ্যাডভেঞ্চারের মজা বাড়ানোর জন্য প্রকৃতি তার অবদান রাখা শুরু করলো। নামলো ঝুম বৃষ্টি। তাড়াতাড়ি, ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো চাঁদের গাড়ির ছাঁদ এবং চারপাশ। যার ফলে আমাদের মনে হতে লাগলো যে, আমরা একটি সামরিক যানে গোপান কোন মিশনে চলছি সবাই মিলে। চারপাশ এবং উপরটা ঢেকে দেয়াতে ভেতরেটা বেশ অন্ধকার। কেউ কেউ কাউকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না। কেউ কেউ ফিসফিস করে করে কথা বলেছে। বাইরে এবং ত্রিপলের উপর ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। গাড়িটা ঘোঁ ঘোঁ শব্দ করতে করতে পাহাড়ি পথ চলছে। কখনো উঠছে কখনো নামছে।
বেশ কিছুক্ষণ এমন করে চলার পর বৃষ্টি থামলো। ত্রিপল সরলো। আমরা আবার চারপাশের সুন্দর বৈচিত্রপূর্ণ প্রকৃতি দেখার সুযোগ পেলাম। এখানে মজার বিষয়হলো। এক পশলা বৃষ্টির পর প্রকৃতি যেন আরো সতেজ, ঝলমলে আর সুন্দর হয়ে উঠেছে। সকাল গড়িয়ে দুপুরের দিকে যাচ্ছে। রোদের তেজ বাড়ছে। গাছের সবুজ পাতাগুলো উজ্জ্বল আলোকে ঝকমক করছে।
গাড়ির ভেতরেও আরেক মজা। গাড়িতে নানান ধরণের মানুষের মেলা। কেউ সাজেকের স্থানীয় বাঘাইহাট যাচ্ছে সবজি বিক্রি করতে। কেউ আত্মীয়ের বাড়ী এসেছিলেন সপরিবারে বেড়াতে। এখন ব্যাগ ভর্তি তরিতরকারি উপহার নিয়ে ফেরত যাচ্ছেন। স্থানীয় কেউ কেউ, বিশেষ করে পাহাড়ী কয়েকজন আধুনিক পোশাক পড়া তরুন, ঢাকায় বা চট্টগ্রাম যাবেন বলে উঠেছেন। বোধহয় সেখানে পড়ালেখা করেন। আমাদের মতো এ্যাডভেঞ্চারিস্ট কয়েকজন পর্যটকও আছেন দেখলাম। বয়স বেশ কম তাদের। এই বারো রকম মানুষের তেরো রকম গল্প গুজবে পুরো গাড়ি সরব হয়ে রইলো পুরোটা পথ।
দেখতে দেখতে বাঘাইহাট চলে আসলো। সময় হলো আমাদের গাড়ি পরিবর্তনের। অবশ্য বাঘাইহাট থেকেও ঢাকা ও চট্টগ্রামের সরাসরি গাড়ি আছে। কিন্তু, সেগুলো অনেকক্ষন পরে ছাড়বে। আর তাছাড়া আমারা আরেকটু এ্যাডভেঞ্চার করার জন্য দীঘিনালা যাওয়ার আরেকটি গাড়িতে উঠে বসলাম। এই গাড়িতেও অবশ্য একই পরিবেশ একই ধরণের গল্প। তাই নতুন করে আর কিছু তোমাকে বলছি না।
দীঘিনালায় এসে আমাদের আবার গাড়ি পবিবর্তন করতে হলো। এর মধ্যে বাঘাইহাটে এবং দীঘিনালার, বিশেষ করে দীথিনালার বিশাল এবং বৈচিত্রপূর্ণ কাঁচাবাজারটা একটু সময় নিয়ে ঘুরে দেখতে খুব লোভ লাগছিলো। কিন্তু, যেহেতু আমাদের অনেক দূর যেতে হবে এবং দুপুর প্রায় হয় হয়। তাই লোভ সামলে দীঘিনালা থেকে খাগড়াছড়ির লোকাল গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। এবার অবশ্য একটি ডিজেল চালিত অটোতে শেয়ারে উঠেছিলাম। তাই অল্প কয়েকজন সহযাত্রী থাকাতে যাত্রাপথের আর তেমন কোন বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলো না। সাদামাটা একটি যাত্রায় প্রকৃতি দেখতে দেখতে খাগড়াছড়ি এসে পৌঁছালাম।
খাগড়াছড়ি পৌঁছে প্রথমেই ঢাকার বাসের টিকিট করে বের হলাম দুপুরের খাবারের খোঁজে। শেষ পর্যন্ত পছন্দ করলাম একটি চাকমা খাবার দোকান। দোতলা রেষ্টুরেন্টটি খুব সুন্দর। বাঁশ এবং কাঠ দিয়ে ডেকোরেশন করা। খুব সুন্দর পরিবেশ। খাবারগুলোতে বেশ মজার এবং বৈচিত্রপূর্ণ। সমতলের খাবার এবং পাহাড়ীদের খাবারে আমার একটা পার্থক্য খুব চোখে লাগলো। আমরা সমতলের মানুষরা, হয়তো আমার পরিচিতদের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য, খাবার একটু বেশী সেদ্ধ করি এবং অনেক বেশী মশলা ব্যবহার করি। পাহাড়ীরা তুলনামূলক কম সেদ্ধ এবং কম মশলাদার খাবার খায়। আমাদের কাছে কিন্তু তাদের খাবারটা বেশ স্বাস্থ্যকর এবং মজার মনে হয়েছে।
যাই হোক, খাওয়া শেষ করে আমরা বাসে উঠলাম। একটা লক্কর ঝক্কর মার্কা বাস। যাবে খুলনা পর্যন্ত। মাঝে আমাদের ঢাকা নামিয়ে দেবে। ফেরার পথের বেশ খানিকটা পথ খুব খারাপ ছিলো। তবে খাগড়াছড়ি থেকে ফেনী নদী পর্যন্ত পাহাড়ী রাস্তাটা অনেক সুন্দর ছিলো। রাস্তার পাশে একটা চা বাগানও ছিলো। চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি যাওয়ার রাস্তাটা একরকম সুন্দর ছিলো। যেটা সমতল থেকে ক্রমশ পাহাড়ে উঠা। খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকায় ফেরার রাস্তাটা ছিলো অন্য রকম। এই রাস্তায় আমি আগে এসেছি এমনটা মনে পড়ে না । অন্তত: দিনের বেলায় আসিনি এটা নিশ্চিত।
এই বিষয়টা আলাদা করে বলছি এই কারণে যে, এই বার নিয়ে ৩ বার খাগড়াছড়ি গিয়ে আসলাম। প্রথমবার গেলাম বান্দরবান থেকে রাঙ্গামাটি হয়ে- কিছুটা দিনে কিছুটা সন্ধায়। ফিরলাম রেগুলার খাগড়াছড়ি ঢাকা রুটে-রাতের বেলা। দ্বিতীয়বার ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি রেগুলার রুটেই যাতায়াত করলাম- যেহেতু যাত্রার সময়টা রাত ছিলো পথের প্রকৃতি দেখার বা উপভেঅগ করার সুযোগ পাইনি। এই বার চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি গেলাম দিনের বেলা সেটা বোধহয় রেগুলার রুট ছিলো। কিন্তু ফেরার সময় যে রুটটাতে ফিরলাম সেটা যে অন্য আরেকটা পথ ছিলো সেটা নিশ্চিত। এই বিষয়টা আমি বেশ উপভোগ করেছি। একই যায়গায় যাওয়া এবং আসার জন্য ৩টা ভিন্ন ভিন্ন পথ। এটা খুবই বৈচিত্রপূর্ণ একটা অভিজ্ঞতা। কারণ, পথগুলো ভিন্ন মানে পথের পাশের প্রকৃতির চেহারাও ভিন্ন এবং সৌন্দর্য্যও অন্য রকম। একই জায়গাতে যেতে আসতে যদি তিন রকম প্রকৃতি দেখার সুযোগ পাওয়া যায় এর চেয়ে মজার আর উপভোগ্য ব্যাপার আর কি হতে পারে। অবশ্য ৩বারে যাওয়ার ভ্রমন সঙ্গীরাও মোটামুটি ভিন্ন ছিলো। এটাও একটা মাজার বিষয়।
মামনী, তোমার সাথে ইনশা আল্লাহ কমপক্ষে আরো একবার যাবো খাগড়াছড়ি, হয়তো সাজেকও। বাবা-মেয়ের ভ্রমনটা আশা করি অন্য রকম মজার এবং খুব উপভোগ্য হবে।
অনেক সময় নিয়ে আমার সাথে গল্প করার জন্য তোমাকে ানেক অনেক ধন্যবাদ।