18/01/2016
“কেওক্রাডং এ এক ঝাঁক দুর্বার তারুণ্যের বিজয় দিবস উদযাপন”
সময়টা ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর, বিকাল ৪.৩১ মিনিট। একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের পতাকা উত্তোলন হলো, লাল সবুজের পতাকা, বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস। ইচ্ছে ছিলো এবারের বিজয় দিবসটা একটু ভিন্ন ভাবে পালন করবো। সেই চিন্তা থেকেই পাহাড়ে বিজয় দিবস পালনের বিষয়টি মাথায় এলো। ঠিক হলো বান্দরবান এর কেওক্রাডং হবে আমাদের গন্তব্য। এখনো যেটা বাংলাদেশের অফিশিয়াল সর্বচ্চো শৃঙ্গ, সেই সাথে একটা উল্লেখযোগ্য পর্যটন এরিয়াও। স্পার্ক ইভেন্টয বাংলাদেশ এর উদ্দেশ্যই ছিলো তরুণ প্রজন্মের কাছে আমাদের বিজয় দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরা, সেই সাথে তুলে ধরা আমাদের পর্যটন শিল্পকে।
এই আয়োজনটা বাস্তবায়ন করার জন্য খুব অল্প সময় ছিল। এরপরেও আবীর, সাজ্জাদ ভাই, নাদিম ভাই ও আমি মিলে একটা ছক করে ফেললাম। কখন কি হবে, কোথায় কি হবে, কিভাবে কি হবে। তারপরেই শুরু হলো আমাদের কর্মযজ্ঞ। অনেক তর্ক বিতর্কের পরে আবীরের দেওয়া নামটা চূড়ান্ত হলো......... “স্টেপ পিক”। অবশ্য এই নামটাই পরে ইভেন্ট এর বড় একটা শক্তি হয়ে গেলো। তো স্পার্ক ইভেন্টয বাংলাদেশ তার কাজ শুরু করে দিলো। কিন্তু, কাজটা অনেক কঠিন মনে হচ্ছিলো, যখন খুব বেশি মানুষের সাড়া পাওয়া যাচ্ছিলোনা। ইভেন্ট এর তারিখটাও ছিলো অনেক কাছে। তখন মনে হচ্ছিলো হয়তো ইভেন্টটা আর হবেই না। তবে শেষ মুহূর্তে আমরা ২৪ জনের একটা বড়োসড়ো দলে পরিণত হলাম।
বাস ছিলো ১৪ তারিখ রাত ১১.১৫ মিনিটে। কিন্তু, সেই বাস ছাড়লো রাত ১১.৪৫ মিনিটে। তো আমাদের যাত্রা শুরু হলো স্বর্গের মতো সুন্দর বান্দরবান এর উদ্দেশ্যে। দারুণ একটা জায়গা হল এই বান্দরবান। এক পাহাড়ের গায়ে আরেক পাহাড়ের হেলান দিয়ে থাকা, সাথে ভোরের শিশির, পাখির ডাক, ঝর্ণার রিনিঝিনি শব্দ। সব মিলিয়ে এতো নিখুঁত ভাবে সাজাতে একমাত্র প্রকৃতি ই পারে। তবে বান্দরবানের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভয়ংকর সুন্দর যে বিষয়টি, তা হলো শুভ্র মেঘ। পাহাড়ের সাথে মেঘের মিতালী। আমাদের কাছে মেঘের স্বর্গরাজ্য। ও, আমাদের বলতে......স্পার্ক ইভেন্টয বাংলাদেশ এর কথা বলছি।
আমাদের বাসটা ছুটে চলছে বান্দরবান এর উদ্দেশ্যে। যানজট, যাত্রা বিরতি, বাসের তেল শেষ হয়ে যাওয়া, সব মিলিয়ে আমরা পৌঁছলাম সকাল ৯টার একটু পরে। সবাইকে নাস্তা দিয়ে আমরা গেলাম বাসের টিকেট কাটতে বান্দরবান থেকে রুমা এবং বান্দরবান থেকে ঢাকার ফিরতি বাসের। দুইটাই হলো কিন্তু, ঢাকার ফিরতি টিকেট কাটতে গিয়ে একটু দেরি করে ফেলায় রুমার বাস ছেড়ে দিলো আমাদের কয়েকজনকে রেখেই। হা হা হা......... -+-----------
------বান্দরবানের লোকজন সময়ের বিষয়ে খুব বেশিই সচেতন। যাইহোক, তারপর অটো, সি এন জি. এসবে করে অনেক কষ্টে বাসের কাছে পৌঁছলাম। বাস তখনো চলছিলো। তাহলে বুঝুন কতটা নিয়ম মানে তারা! বাস চলছে পাহাড়ের গা ঘেঁসে ক্রমাগত উপরে উঠছি আমরা, আর চারপাশের প্রকৃতির রুপ দেখছিলাম। সেটা দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম রুমা বাসস্ট্যান্ডে। তখন দুপুর প্রায় আড়াইটা। বাস থেকে নেমে হালকা যাত্রা বিরতি দিয়ে একটা জীপ গাড়ি (স্থানিয়দের ভাষায় চান্দের গাড়ি) নিয়ে ছুটলাম রুমা বাজারে। পৌঁছেই দেখি সদা হাস্যোজ্জল সাদেক দাড়িয়ে ছিলো আমাদের জন্য। সাদেক হলো আমাদের অভিযানের গাইড, রুমা বাজারেই তার বাড়ি। অনেক ছোট বেলা থেকেই সে এই কাজ করে। বছরের বেশীরভাগ সময়েই সে পাহাড়ে থাকে অভিযাত্রীদের নিয়ে। তো, সে আমাদের দেখেই জড়িয়ে ধরল। অনেক ভালো লাগে এই ছেলেটাকে। আমরা বান্দারবান গেলেই সাদেক আমাদের সাথেই থাকবে, বিষয়টা কিছুটা এমনই হয়ে গেছে। তাকে আমরা নিজেদের একজনই ভাবি। আমাদের হাতে সময় কম, তাই আর্মি ক্যাম্পে নাম নিবন্ধন করে যার যার প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে নিলাম। পাহাড়ে চড়ার জন্য স্যান্ডেল, রোদ থেকে বাঁচার জন্য গামছা, এছাড়াও যার যা দরকার। তারপর দুপুরের খাবারটা সেরে নিলাম বাজারেই। অবশ্য এই খাবারের সাথে সাজ্জাদ ভাইের ঝাড়িও ছিল, হা হা হা। ওহ বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, রুমা বাজারে পৌঁছতেই বৃষ্টি আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। যদিও অল্প কিছুক্ষণের জন্য, তারপর আবার রোদের তাপে সবাই পুরছিলো। যাইহোক, খাওয়া শেষে আমাদের জন্য নির্ধারিত ২টি চান্দের গাড়িতে করে আমরা এলাম পুলিশ ফাঁড়িতে। তবে অবশ্যই কোনকিছু কেনা বা ভাড়া নেওয়ার আগে ভালোভাবে দরদাম করে নেওয়াই ভালো। এবার পুলিশ ফাঁড়িতে নাম নিবন্ধনের আনুষ্ঠানিকতা সেরে যার যার জায়গায় গিয়ে বসলাম। তারপর আমাদের বহনকারী চান্দের গাড়িতে করে ছুটলাম পাহাড় চুড়ার উদ্দেশ্যে। রোলার কোস্টারকেও হার মানানোর মতো করেই ছুটে চলছিলো আমাদের গাড়ি দুটো। কখনো খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠছে, আবার কখনো সা করে নিচের দিকে। দুপাশের অপরূপ দৃশ্য তো ছিলোই, সাথে ভয় ও ছিলো। তবে শুরুতে বলেছিলাম যে স্বর্গের কথা, সেই স্বর্গের মাঝেই ছিলাম বলে হয়তো ভয়ের চাইতে আনন্দেই ছিলাম বেশী। গাড়ি এসে থামল ১১ কিলো নামক জায়গায়। নাম ১১ কিলো হলেও ১ কিলোমিটারের মত লম্বা খাড়া ঢাল। সবাই তখন এতটাই আনন্দে ছিলো যে, সেই ঢাল পেরিয়ে কখন যে নিচের পাড়ায় পৌঁছে গেছি টেরই পেলাম না। পাহাড়ে কয়েকটা ঘর নিয়ে এক একটা পাড়া বা গ্রাম। সেখানে নেমেই সাদেক সহ আমাদের কয়েকজন স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে ফুটবল খেলায় মেতে উঠলো। বাকিরা বাঁশ কেনায় ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। ভাবছেন, আবার বাঁশ কেন? ভয়ের কিছু নেই। পাহাড়ে চলার জন্যেই বাঁশ বহন করতে হয়। স্থানীয় ছাড়া সবাই বাঁশের সাহায্যেই পাহাড়ে উঠা নামা করে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই আপনার উচ্চতার সমান বাঁশ বাছাই করা উচিৎ। তো বাঁশ কেনা হলো, তারপর সবাই মিলে হাঁটা শুরু করলাম। এই অভিযানের আসল পর্ব শুরু হলো বটে। কখনো খাড়া পাহাড়, কখনো ঢালু, আবার কখনো সরু রাস্তা, কখনো জঙ্গল। এই বনে টাইগার আছে, তবে এরা ঘার মটকে দেয় না। শুধু রক্ত চুষে খায়, এর নাম টাইগার জোঁক। তবে চুপি চুপি আরেকটা কথা বলে রাখি, ঘার মটকানোর বাঘ না থাকলেও ভাল্লুক কিন্তু ঠিকই আছে। তাই দল বেধে চলাই ভালো। আমরাও চলছি পাহাড়ি পথে। শুধু উঠেই যাচ্ছি, যাত্রা মনে হয় আর শেষ হতে চায়না। কিন্তু, তারপরেও শেষ হয়। অনেক চড়াই উত্রাই পেড়িয়ে পৌঁছলাম বগা লেক এর উপরের পাহাড় চুড়ায়। তখন প্রায় সন্ধ্যা ৭টার বেশী বাজে। উপরে আর্মি ক্যাম্প এ আবারো নাম নিবন্ধন করে বগা লেক এ পৌঁছলাম। সিয়াম দিদির কটেজ আগেই ঠিক করা ছিলো। আমরা ২৪ জনের জন্য তিনটা দল হয়ে তিনটা কটেজ নিলাম। এই কটেজ গুলা অবশ্য এক একটা বড় ঘর, কোনটায় আবার লেক ভিউ বারান্দাও আছে। বগা লেক পাড়ায় মারমা আদিবাসীদের বসবাস। তাদের থাকার জন্য বাঁশের তৈরি ঘর গুলকেই কটেজ বলা হচ্ছে। নির্ধারিত কটেজে সবাই ব্যাগ রেখে যার যার মতো ফ্রেশ হল বগা লেক এর পানিতে। এই লেকে এক ধরনের মাছ আছে যারা আপনার গায়ের মৃত বা দুষিত কোষগুলা (মৃত বা দুষিত কোষ বলতে বোঝালাম মরা চামড়া) খেয়ে ফেলে। আপনি পানিতে নামলেই সেটা টের পাবেন। প্রথমে একটু ভয় লাগলেও পরে ভালোলাগাটা বুঝতে পারবেন। আবীর আর আমার ভাষায় এইটা হলো মাছ থেরাপি। যাইহোক, মাছ থেরাপি ছিল ফ্রী, আর বাকি সব কিছুতেই টাকা খরচ করতে হবে। তারপর রাতের খাবারটা আমরা সেরে নিলাম সিয়াম দিদির ওখানেই। ভাত, আলু ভর্তা, সবজি, ডাল রাতের খাবারের মেন্যু। সাথে স্পেশাল স্থানীয় মরিচের ভর্তা। তৃপ্তি সহকারেই খেলাম।
১৫ ডিসেম্বর রাত, আমাদের মুল ইভেন্ট এর সময় হয়ে আসছে। আমরা তৈরি হচ্ছি। গানের আসর বসেছে, ফানুস উড়ানোর প্রস্তুতি চলছে, আর সাদেক ব্যাস্ত বার-বি-কিউ তৈরিতে। বলে রাখি, রুমা বাজার থেকে আপনার প্রয়োজনীয় সব বাজার সেরে নিতে হবে। কারন রুমা বাজারের পর আর কিছু কিনতে পারবেন না। আর আমাদের কেনা সেই বাজার দিয়েই এখন নিজেদের মতো আয়োজন করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে দারুন একটা সময়ের প্রস্তুতি চলছে। তো এই প্রস্তুতির মাঝেই আমি পরিচয় করিয়ে দেই স্পার্ক ইভেন্টয বাংলাদেশ এর সবার সাথে। স্পার্ক ইভেন্টয বাংলাদেশ এ সাঈদা আবীর দায়িত্ব পালন করছেন চীফ কো- অর্ডিনেটর (ইভেন্ট ও একাউন্টস) হিসেবে, সাজ্জাদ হোসেন পালন করছেন ইভেন্ট ম্যানেজার এর দায়িত্ব, খাইরুদ্দিন আহ্মেদ নাদিম পালন করছেন হস্পিটালিটি ম্যানেজার এর দায়িত্ব, আর আমি মোঃ খোরশেদ আলম পালন করছি মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশন ম্যানেজার এর দায়িত্ব। এছাড়া ভলেন্টিয়ার হিসেবে প্রভাত ও তার দলের কথা না বললেই না, ক্যামেরা হাতে সায়মন ও আপন। আর যারা সাথে গিয়েছিলেন জেরিন, নিশাত, সুপ্তি, আকাশ, ওমর, তামজিদ, তাকবির, রানা, রফিক, জোজো, তারিক, রায়ান, শিশির, মনিকা, রফিক, ফায়েজ, নুসরাত। সবাইকে ধন্যবাদ, সবার অক্লান্ত পরিশ্রমের পরই এই ইভেন্টটা হলো।
পরিচয় পর্ব শেষ করে চলেন ফানুস উড়াই। রাত ১২টা, মানে ১৬ ডিসেম্বর শুরু হয়ে গেলো। আমাদের গৌরবের বিজয়ের দিন। ৭জন বীরশ্রেষ্ঠের স্মরণে আমরা ৭টা ফানুস উড়ালাম। ভাবুনতো, পাহাড়ের উপরে একটা লেক, তার সাথে এক ঝাঁক দুর্বার তারুণ্য, যাদের স্বপ্ন স্বাধীনতার অর্জনকে রক্ষা করা, যাদের স্বপ্ন পাহাড় জয় করা। এড়াই বিজয় দিবস পালন করছে এই নির্জন পাহাড়ের উপর। তো ফানুস উড়িয়ে আমরা বার-বি-কিউ চিকেন খেয়ে আজকের মতো ঘুমাতে চলে গেলাম, কথা হবে সকালে।
সকাল বেলা সবাই ফ্রেস হয়ে তৈরি হলাম, যার যা রাখা সিয়াম দিদির এখানে রেখে নাস্তা সেরে আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম আমাদের মুল গন্তব্য কেওক্রাডং এর উদ্দেশ্যে। আবারো সেই রোমাঞ্চিত পাহাড়ি উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা পথ। সবাইকে জাতীয় পতাকা উপহার দেওয়া হল স্পার্ক ইভেন্টয বাংলাদেশ এর পক্ষ থেকে, সেই সাথে দেওয়া হলো টি-সার্ট। টি-সার্ট পরে, জাতীয় পতাকা বাঁশের আগায় বেঁধে চলা শুরু করলো। ঐ দৃশ্যটা লিখে বোঝানো যাবেনা, কতটা স্মরণীয় ছিলো আমাদের জন্য। ও সকালের নাস্তা ছিল খিচুড়ি, ডিম ভাজি, সবজি, ডাল। তো কিছুদুর যাওয়ার পর কয়েকটা ছোট ঝিরি বা ঝর্ণা পেড়িয়ে আমরা পৌঁছলাম চিংড়ি ঝর্ণায়। নামে চিংড়ি হলেও পেলাম কাঁকড়া, কোন চিংড়ি পাইনি। তবে বর্ষাতে এখানে চিংড়ি পাওয়া যায় বলেই এর নাম চিংড়ি ঝর্ণা। আমরা সেখানে আধা ঘণ্টার বিরতি নিলাম, যে যার মতো লাফালাফি করে আবার রওনা হলাম। পাহাড়ি পথে উপরের দিকে উঠার সময় খুব ছোট ছোট স্টেপ দিয়ে চলা উচিৎ। আবার নামার সময় হালকা জগিং করার মতো করে নামা উচিৎ। তবে উভয় ক্ষেত্রেই সতর্ক থাকা উচিৎ। আর শ্বাস নেওয়া ও শ্বাস ছাড়ার ক্ষেত্রে চেষ্টা করুণ মুখ ব্যাবহার না করে নাক ব্যাবহার করতে। খুব অল্প পানি পান করুণ, হাঁটার গতি একই রাখুন। যেখানেই যান না কেনো, সেখানকার মানুষজন, প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করুণ, ভালবাসুন। অবশ্যই নোংরা না করে পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখুন। আর টাইগার জোঁক হতে সাবধান। আমাকে ধরেছিল এই চিংড়ি ঝরনার পরেই। আবার চলা শুরু হলো আমাদের। কেওক্রাডং যাওয়ার আগে যাত্রী ছাউনিতেও একটু বসলাম। সেখানে হলকা পাতলা কিছু খেয়ে, একটু গলা ভিঝিয়ে আবার রওনা হলাম। খুব বেশিক্ষণ বিশ্রাম নিলে এই ধরনের অভিযানে কষ্টটা বেশী হয়। হাঁটতে হাঁটতে আর প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের সবচাইতে পরিষ্কার পাড়া “দার্জিলিং পাড়ায়”। ১৫মিনিটের বিশ্রাম, বিস্কুট ও চা পান করে আবার চলা শুরু। ৪০ মিনিটের মতো সময় লাগলো কেওক্রাডং এর নিচে পৌঁছতে। তখন সাড়ে তিনটার কিছু বেশী বাজে। প্রভাত তার দল নিয়ে কেওক্রাডং সাজাতে লেগে গেলো সাজ্জাদ ভাই এর নেতৃত্বে , নাদিম ভাই চলে গেলেন সবার থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা করতে। আবীর আর আমার কাজ ছিলো আমাদের সাথে যারা ছিলো তাদের প্রস্তুত করা। সেই সাথে আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে আর্মিদের আমন্ত্রণ জানানো আমাদের সাথে যোগ দেবার জন্য। তারা খুব খুশী হয়ে আমাদের সাথে যোগ দিলো। অবশ্য এতো কিছুর মাঝে আমাদের সবার নাম নিবন্ধনের কাজটাও সেরে ফেললাম আর্মি ক্যাম্প থেকেই। মনে রাখবেন, আপনার নিরাপত্তার স্বার্থেই এতো জায়গায় নাম নিবন্ধন করতে হবে। এই বিষয়টা মোটেও এড়িয়ে যাবেন না। ওহ আসুন সব প্রস্তুতি শেষ, সবাই অপেক্ষা করছে। আর্মি ক্যাম্পের লোকজন, আমাদের লোকজন, এছাড়াও ওখানকার বাকি পর্যটকদেরও আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। সব মিলিয়ে বিশাল একটা দল কেওক্রাডং পাহাড় চুড়ায়। আমরা একজন আর্মি সদস্যকে দিয়েই পতাকা উত্তোলন করালাম, সাথে বাকী সবাই জাতীয় সংগীত পরিবেষণ করলাম। আমার জীবনে এমন ঘটনা খুব কমই আছে। দেশের জন্য কিছু করতে পারার অনুভূতি এতটা তিব্র হয় জানা ছিলোনা। এতটা গভীরভাবে নাড়া দিয়ে গেছে এই অনুভূতি, হয়তো এটাই জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতি গুলার অন্যতম। আমরা যারা সেখানে ছিলাম, তারা প্রত্যেকই হয়তো সেটা টের পাচ্ছিলাম। সবার ভিতরেই হয়তো রক্তের একটা শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছিলো। চারদিক এতোই নিস্তব্ধ ছিলো, শুধু জাতীয় সঙ্গীত এর সুরই শোনা যাচ্ছিলো। প্রকৃতিও যেন শান্ত থেকে জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি সম্মান জানাচ্ছিলো। সেই অনুভূতি নিয়ে শেষ করলাম আমাদের মুল পর্ব। তারপর যথারীতি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে এলাম আমাদের গর্বের কেওক্রাডং থেকে। নেমে সবাই ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নিলাম লালা বমের কটেজে। কারন সেখানেই আমাদের আজকের থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। খাওয়া শেষে একটু বিশ্রাম, ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে কেওক্রাডঙ্গে। কেউ আগুনের উত্তাপ নিচ্ছে, কেউ ব্যাডমিন্টন খেলায় মত্ত। আমরা অবশ্য ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য সব ই নিয়েছিলাম। তাছাড়া দাবা আর লুডুও ছিলো। যাইহোক, রাত ৯টার দিকে আমরা কয়েকজন হেলিপ্যাড এ গেলাম তাবুতে থাকবো বলে, সাথে বাকি ফানুস গুলো উড়াবো। তো আর্মি সদস্যরাও কয়েকজন এলেন আমাদের সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। কিন্তু বিধিবাম, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসে সেখানে দাঁড়ানো যাচ্ছিলো না। একটা ফানুসও উড়ানো গেলনা। শেষ পর্যন্ত ফিরে এলাম কটেজেই। আর্মিদেরও কয়েকটা ফানুস দিলাম যেন তাঁরাও উড়ায়। অবশ্য তাঁরা উড়িয়েছিলেন তাঁদের মতো করেই। আমরাও আরও গভীর রাতে বাকি ফানুস গুলোও উড়িয়ে দিলাম শহীদদের কথা স্মরণ করে। এর মাঝে অবশ্য লুডু খেলার ধুম পরে গেলো। মনে হচ্ছিলো কোন টুর্নামেন্ট হচ্ছিলো। রাত ১২টার দিকে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরেরদিন ভোরে একদল ছুট দিলো বগা লেকের উদ্দেশ্যে, কারন বগা লেকের পানিতে গোসল করবে, আরেকদল ঘণ্টা খানেক পরে রওনা দিলো। আবার ক্যাম্পে গিয়ে স্বাক্ষর করে ফেরার পথে পা বাড়ালাম। দার্জিলিং হয়ে চিংড়ি ঝর্ণা, তারপর বগালেক। সেখানে আগেই পৌঁছে যাওয়া আমাদের আগের দলটা অপেক্ষা করছিলো আমাদের জন্য, আমরা ঠিক ১০টায় পৌঁছে সকালের নাস্তা করেই উঠে গেলাম বগা লেক এর আর্মি ক্যাম্পে। সেখানে স্বাক্ষর করে ১১ কিলোর দিকে হাঁটা। এবারে বেশিরভাগ সময় নামতেই হবে। দল বেঁধে আমরা সেই কাঙ্খিত ১১ কিলোর নিচে দাঁড়ালাম। তখন প্রায় দুপুর ১.২০মিনিট। এবারে উঠা শুরু করলাম ১১ কিলোর উপরে উঠার জন্য। এতটাই খাড়া যে এই এক কিলো উঠতেই মনে হচ্ছিলো কয়েক দিন লেগে যাবে। অনেক কষ্টে উপরে উঠে সবাই অপেক্ষা গাড়ির জন্য। কারন, আমাদের নির্ধারিত চান্দের গাড়ি দুইটা আমাদের রেখে আগেই ছেড়ে গেছে। অপেক্ষার পালা শেষ করে ওখানে দাঁড়ানো আরেকটা চান্দের গাড়ি ভাড়া করে আবারো সেই রোলার কোস্টারের বাস্তুব অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা পৌঁছলাম রুমা পুলিশ ফাঁড়িতে। নাদিম ভাইকে আলাদা ভাবে ধন্যবাদ দিতে চাই, কারন পাহাড়ের এই পুরোটা পথে উনি সবার পেছনে থেকে সবাইকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছতে সাহায্য করেছেন। সেই সাথে ধন্যবাদ জানাতে চাই সাজ্জাদ ভাই ও আবীরকে, অনেক কষ্টে, অনেক ঝামেলা সহ্য করেও এই ইভেন্টটা সফল করার জন্য। নিজের কথা লিখি কি করে, থাক বাদ দেই। তো, পুলিশ ফাঁড়ির কাজ শেষ করে রুমা বাজারে এলাম। হালকা নাস্তা করে আবার আর্মি ক্যাম্পে দৌড়। সেখানে আবার আর্মি ক্যাম্পের কাজ শেষ করে রুমা বাস স্ট্যান্ড এ । বেশী টাকা খরচ করে আরেকটা বাস নামাতে হলো। কারন রুমা থেকে বান্দরবান এর শেষ বাস ৩টায় ছেড়ে যায়, আর সেটা ছেড়েও গেছে। কারন তখন ৪টা বাজে। যাইহোক আমাদের নির্ধারিত বাসে চেপে বান্দরবান শহরে এলাম, তখন ঘড়িতে ৭টার বেশী। দুপর ও রাতের খাবার এক সাথে খেয়ে যে যার মতো সময় কাটাতে থাকলো। আমাদের এই অভিযানের রেডিও পার্টনার হিসেবে ছিলো পিপলস রেডিও, ম্যাগাজিন পার্টনার হিসেবে ছিলো পর্যটন বিচিত্রা আর আইটি সহযোগিতায় স্কুইডন, তাদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ। যথারীতি ঠিক ৯টায় বান্দরবান শহর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। তো, বাস চলছে বান্দরবান থেকে ঢাকা শহরের উদ্দেশ্যে। আবারো সেই ইট, কাঠ, পাথরের শহরের দিকে ছুটে চলে আমাদের বাস। আর আমরা বাসের জানালা দিয়ে চেয়ে থাকি স্বর্গের মতো সুন্দর পাহাড়ের দিকে।