16/11/2022
দ্বীপ জেলা ভোলার তথা বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিনে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীর মোহনায় আনুমানিক ১৯১২ সালে প্রাকৃতিকভাবে চর জেগে ওঠে। তৎকালীন জার্মান যুবরাজ প্রিন্স ব্রাউন এই চরে শিকার করার জন্য জাহাজ নিয়ে আসেন। তিনি এখানে কোন মানুষের দেখা না পেলেও কিছু বিড়াল ও কুকুর দেখতে পান। এই চর কে তারা জার্মান ভাষায় বিড়াল ও কুকুরের দ্বীপ বলেন। জার্মান ভাষায় বিড়াল কে কুকুর আর কুকুর কে মুকুর বলা হয়। পরবর্তীতে জার্মান ভাষা থেকে অনুদিত হয়ে বাংলায় নাম হয়ে যায় 'চর কুকরি মুকরি'। ঢাকা থেকে ২২৫ কিলোমিটার ও ভোলা সদর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চর কুকরি মুকরি এর দৈর্ঘ্য ১০ কিলোমিটার ও প্রস্থ ৯.৫ কিলোমিটার এবং আয়তন ২৫ বর্গকিলোমিটার। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা ৮৩৩২ জন।এর মধ্যে পুরুষ ৪২৭৪ জন এবং মহিলা ৪০৮৮ জন।
এই কুকরি মুকররিতেই রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীর মোহনায় এর অবস্থানের কারণে, চারিদিকে জলরাশি দ্বারা বেষ্টিত প্রমত্ত মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ে পলি জমতে জমতে এ দ্বীপটির জন্ম। সাগরের কোল ঘেঁষে জন্ম নেওয়ায় কুকরি মুকরিকে অনেকে স্বপ্নের দ্বীপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এখানে মেঘনা নদীর উত্তাল ঢেউ এমন রূপ নেয়, যা দেখলে মনে হবে আপনি সাগরের সৈকতে নিজের মতো আছেন। ১৯৮৯ সালে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জান মাল রক্ষায়,ভোলা জেলায় কমপক্ষে ৩ লক্ষ ৬০ হাজার একর জমিতে সংরক্ষিত শ্বাসমূলীয় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বনায়ন করার জন্য, এ সময় মূলত শ্বাসমূলীয় গাছের চারা রোপন করে বনায়ন শুরু করা হলেও পরে ক্রমে ক্রমে যুক্ত হয় সুন্দরী,গেওয়া,পশুর প্রভৃতি গাছের চারা রোপন।এছাড়া গোটা এলাকা জুড়েই চোখে পড়ে বিপুল সংখ্যক কেওড়া গাছ ও হোগলা পাতা।
মূলত বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা এইসব গাছ আর আশপাশে নারিকেল,গাছ সুপারি গাছ,বাঁশ ও বেত বন মিলেই এখানে তৈরি হয়েছে আকর্ষণীয় একটি ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল। ভাঙ্গা গড়ার আবর্তে পড়ে বর্তমান 'কুকরি মুকরি' চরে বনায়নের পরিমাণ ৮৫৬৫ হেক্টর। যার মধ্যে বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম ২১৭ হেক্টর,বসতি ও কৃষি আবাদ আছে প্রায় ৪৮১০ হেক্টরে।
চরের মানুষের প্রধান পেশা মাছ ধরা,কৃষিকাজ, হাঁস পালন,গরু,মহিষ ও ছাগল পালন।
চর কুকরী-মুখরী বনে যেসব প্রাণী দেখা যায়, তার মধ্যে রয়েছে চিত্রা হরিণ, বানর, উদবিড়াল,শিয়াল,বন্য মহিষ, বন্য গরু,বন বিড়াল,বন মোরগ প্রভৃতি। আর পাখি ও বিভিন্ন প্রকার সরীসৃপ। এই বনে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বক,শঙ্খচিল,ডাহুক,মথুরা, কাঠ ময়ূর,কোয়েল,শালিক, গুইসাপ,বেজি,কচ্ছপ ও নানা ধরনের সাপ।
চর কুকরি মুকরিতে শীতকালে নানান ধরনের সুদূর সাইবেরিয়া থেকে ছুটে আসা অতিথি পাখিদের আগমনে চরাঞ্চল গুলো যেন নতুন রূপ ধারণ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে শীত মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় ৬৫০ প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। এর মধ্যে সিংহ ভাগই ভোলায় অবস্থান করে। তখন স্বপ্নের দ্বীপ কুকরি মুকরি এর চর অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়।
এছাড়া এখানকার সমুদ্র সৈকতটিও বেশ পরিছন্ন ও নিরিবিলি। দেশের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্র গুলোর তুলনায় কুকরি মুকরি এর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। মাইলের পর মাইল বৃক্ষরাজীর বিশাল ক্যানভাস।
স্বপ্নের দ্বীপ সাজিয়েছে বৃক্ষের সমারোহে যেখানে জীবিত গাছের সংখ্যা ৯ কোটিরও বেশি। চর কুকরি মুকরি এর ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে একটি খাল।খালরির নাম ভারানি খাল।
মেঘনার বিশাল বুক থেকে বয়ে গিয়ে খালটি পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। এখানকার ধুধু বালিয়াড়ির উপর দাঁড়ালে শো শো শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাবে না। একটু সামনে এগোলেই ঢালচর।যেখানে ভোলা জেলার বিখ্যাত, মহিষের বাথানে হাজারো ছোট বড় মহিষ। মহিষের খাটি টক দই সারাদেশে সমাদৃত। 'ভোলার দই' নামে ভোলাকে করেছে বিখ্যাত। যার কারনে প্রচুর পরিমাণ মহিষের দই এখান থেকে সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। এরপরই বঙ্গোপসাগর। এখানে উত্তাল ঢেউয়ের আছড়ে পড়া দেখলেই মনে পড়ে যাবে কক্সবাজার কিংবা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের কথা। স্থানীয় মানুষ এই স্হানটিকে 'বালুর ধুম' নামে ডাকে। তবে কুকরী মুকরী এর প্রধান আকর্ষণ সাগর পাড়। এখানে দাঁড়িয়ে সূর্য অস্ত কিংবা সূর্য ডোবার দৃশ্য ভ্রমণ পিপাসুদের মুগ্ধ করবে। আপনি চাইলে পাশের ঢালচর ও ঘুরে আসতে পারেন যেখানে আছে লাল কাকড়ার আরেকটি ক্ষুদ্র দ্বীপ। তারুয়া সমুদ্র সৈকত বা লাল কাকড়ার চর।।
সহজে কিভাবে যাবেনঃ
ঢাকা সদরঘাট থেকে ভোলার লালমোহন বা চরফ্যাশনের যেকোনো লঞ্চে কিংবা সড়ক পথে চরফ্যাশন যেতে হবে। চরফ্যাশন থেকে বাসে আইচা, সেখান থেকে টেম্পু,অটোরিকশা, মোটরসাইকেল কিংবা মাইক্রো বাসে সরাসরি আইচা বাজার হয়ে কচ্চপিয়া ঘাটে যেতে হবে। সর্ব সাকূল্যে বেতুয়া ঘাট থেকে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগবে।কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে স্পিডবোটে ১৮ থেকে ২০ মিনিটে এবং ট্রলারে আনুমানিক এক ঘন্টায় কুকরি মুকরি পৌঁছে যাবেন।
যারা সরাসরি লাল কাকড়ার' তারুয়া সমুদ্র সৈকত' যেতে চান তারা আলাদা ট্রলারে আনুমানিক দেড় ঘন্টায় পৌঁছে যেতে পারবেন।চরফ্যাশন থেকে টেম্পো,ট্রলার যোগে একশত পঞ্চাশ থেকে দুইশত টাকায় কুকরি মুকরি পৌঁছে যেতে পারবেন।
কোথায় থাকবেনঃ
চর কুকরি মুকরিতে থাকার নানান ব্যবস্থা রয়েছে।আধুনিক সুবিধা সমৃদ্ধ বন বিভাগের সরকারি তিন তারকা মানের রেস্ট হাউস রয়েছে। যেখানে ৬০ জন পর্যন্ত থাকার ব্যবস্থা আছে।এসি সিঙ্গেল,ডাবল,ভিআইপি রুম সহ সুইমিং পুল,টেনিস কোর্ট ও রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় রাষ্ট্রপতি জনাব আব্দুল হামিদ দুই রাত যাপন করেন।
হোম স্টেঃ
আধুনিক সুবিধা সহ গ্রামের মেজে পাকা ঘরে স্বাস্হ্য সম্মত বাথরুম সহ অল্প খরচে থাকতে পারবেন।
তাবুঃ
যারা ক্যাম্পিং করবেন তাদের জন্য আধুনিক তাবুর ব্যবস্থা রয়েছে।
হোটেলঃ
কুকরি মুকরি বাজারে দুইটি টিনের ঘর, কাঠের পাটাতনের স্বল্প খরচের হোটেল রয়েছে। সরকারি বাংলোঃ
যোগাযোগের সাপেক্ষে বন বিভাগ ও ইউনিয়ন পরিষদের আশ্রয় কেন্দ্র বা বাংলোতে থাকা যাবে।
নিরাপত্তাঃ
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা ছবির মত চর কুকরি মুকরি শান্ত ও সতেজ।সেখানে পর্যটকদের নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিন্ত করণে স্হানীয় জনগন ও জন প্রতিনিধিরা শতভাগ আন্তরিক।
খাবেন কোথায়ঃ
রেস্ট হাউস,হোম স্টে, হোটেলে আপনার চাহিদা মত তাজা ইলিশ সহ সামুদ্রিক অন্যান্য মাছ, ভোলার বিখ্যাত হাঁস, মহিষের কাঁচা টক দই,পিঠা সহ সুস্বাদু সকল খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে।এছাড়াও কোস্ট ট্রাস্ট, বন বিভাগ,ইউনিয়ন পরিষদের রেস্ট হাউসে আলোচনা সাপেক্ষে খাবার ব্যবস্হা রয়েছে। অবশ্য আগেই জানিয়ে রাখলে খাওয়া নিয়ে আর চিন্তা থাকবে না।
ভোলার বিখ্যাত খাবার-
সাগরের তাজা ইলিশঃ
বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ জেলা ভোলা এখন দেশের ইলিশের সবচেয়ে বড় উৎস।বঙ্গোপসাগরের পাদদেশে, মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীর মোহনা ইলিশের খনি নামে অভিহিত। মেঘনা নদীর নিম্ন অঞ্চলে যতো ইলিশ পাওয়া যায় তার অর্ধেকের বেশি ধরা পড়ে ভোলার জল সীমায়।
ভোলার হাঁসঃ
ভোলার নদী অববাহিকায় ছোট ছোট চরে প্রাকৃতিক খাবার,মাছ খেয়ে বড় হওয়া পুষ্টি সমৃদ্ধ ও আকারে বড় হাঁস অত্যন্ত সুস্বাদু ও রুচিকর।
যা 'ভোলার হাস' নামে সমগ্র বাংলাদেশে বিখ্যাত।
ভোলার মহিষের দইঃ
বাংলাদেশের মহিষের সবচেয়ে বড় বাতান ভোলাতে। চরে হাজার হাজার মহিষ মুক্ত ভাবে বিচরণ করে।দ্বীপ জেলার ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত 'মহিষের দুধের কাঁচা দধি'এটা ভোলার প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য বহন করে।ভোলায় অতিথি আপ্যায়নে দই অন্যতম উপাদান।
খরচঃ
তুলনা মূলক ভাবে অত্যন্ত অল্প খরচে কুকরি-মুকরি ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য। একদিকে বঙ্গোপসাগর,দুই নদীর মোহনা,তার উপর সবুজে ঘেরা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট,হরিণ বন্য পশু ও হাজারো পাখির অভয়ারণ্য যেন সাগরের বুকে এক ক্ষুদ্র সুন্দরবন।।
কুকরি মুখরি ট্যুরের আরো বিস্ময় যা থাকছে-
বেতুয়া লঞ্চঘাট ও বেতুয়া প্রশান্তি পার্কঃ
মেঘনা নদীর পাড়ে সারি সারি সি সি ব্লক,নদী রক্ষা বাঁধ ভেড়িবাধের উপর ছোট-বড় বেঞ্চ ও গোলাকার ছাউনিতে বসে মেঘনার উত্তাল ঢেউ,প্রকৃতি আর নদীর নির্মল বাতাস এবং সূর্যাস্ত নিয়ে,মেঘনা নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে চরফ্যাশনের 'বেতুয়া প্রশান্তি পার্ক'।
জ্যাকব টাওয়ারঃ
এটি বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের সবচেয়ে উচু ওয়াচ টাওয়ার।এই টাওয়ারের সর্বোচ্চ তলায় স্থাপিত দূরবীনের মাধ্যমে প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য,টাওয়ারের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর,পূর্বে মেঘনা নদী পশ্চিমে তেতুলিয়া নদী, চর কুকরি মুকরি সহ বিভিন্ন চর অবলোকন করা যায়। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু 'আইফেল টাওয়ারের' আদলে এটি তৈরি।
২১৫ মিটার উচ্চ ১৯ তলার এই টাওয়ারের প্রতি তলায় ৫০ জন দর্শনার্থী এবং ন্যূনতম ৫০০ দর্শনার্থী একই সময়ে অবস্থান নিতে পারেন।
তারুয়া দ্বীপ ঃ
চর কুককি মুকরী থেকে বিচ্ছিন্ন তাড়ুয়া দ্বীপের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে একই সঙ্গে বন ও সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে পলি জমতে জমতে প্রায় ৪৮ বছর আগে, বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে উঠেছে তারুয়া দ্বীপ।এরপর বন বিভাগ নানান ধরনের গাছপালা রোপন করলে দ্বীপটি সবুজে ভরে ওঠে। ৩১.৩১ বর্গ কিলোমিটার এর মধ্যে ২৮.২০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে সুবিশাল বনাঞ্চল। পাখিদের এক অভয়ারণ্য তারুয়া সমুদ্র সৈকত। তবে শীতকালে পাখির কলতানে মুখরিত থাকে প্রায় সব সময়। কোন হিংস্র পশুর ভয় না থাকলেও রয়েছে-লাল কাঁকড়া,শিয়াল, বন বিড়াল, হরিণ, সাপ সহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। দর্শনীয় স্থানের মধ্যে-তারুয়া সমুদ্র সৈকত, বালুকাময় মরুপথ,ম্যানগ্রোভ বন, গো-চারণ ভূমি, জেলে নৌকায় চড়ে মৎস্যাভিযান, বনের মহিষ, শেয়ালের হুক্কা হুয়া কোরাস, সাগরের উত্তাল গর্জন আর হাজারো অতিথি পাখি।।
সাগরের বুকে যেন এক ক্ষুদ্র সুন্দরবন।ভ্রমন পিপাসুদের এক স্বপ্ন রাজ্য।।
আপনাদের সহযোগিতায় আমরা আপনাদের সাথে আছি।
যোগাযোগ -
০১৯১১ ২৬১ ৮৮১
০১৭৫৯ ১১১ ২৯৮