19/03/2024
পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলার স্বরূপকাঠীতে অবস্থিত শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী 'ছারছীনা দরবার শরীফ' এবং বাংলার আল আজহার খ্যাত
আধ্যাত্মিক শিক্ষাকেন্দ্র 'ছারছিনা দারুসসুন্নাত কামিল মাদ্রাসা'। আমার এলাকা ও আত্মীয়স্বজন প্রায় সবাই শর্ষীনার মুরীদ বা ভক্ত হওয়ার সুবাদে একাধিকবার ছারছীনা দরবার শরীফে যাওয়া হয়েছে। সেই যায়গা থেকে এই দরবার সম্পর্কে যা ধারণা ও জানি বা জেনেছি তাই জানাবো আজকের লেখায়।
আমাদের যারা শহরে থাকে এবং জেনারেল পড়ুয়ারা দরবারের নাম শুনলেই মনে হয় এটি একটা শিরকি কারবার এবং ভন্ডামীর যায়গা। কেননা বহিপীর, লালসালু পড়ে এবং দেওয়ানবাগ, কুতুববাগ ও গোলাপশাহ মাজার দেখে কিংবা মাইজভান্ডারি, আটরশি ইত্যাদি দরবার সম্পর্কে শুনে এমন ধারণা পোষণ করা স্বাভাবিক।
কিন্তু ছারছীনা দরবার শরিফ সম্পূর্ণ শিরক ও রাজনীতিমুক্ত থেকে আল্লাহর পবিত্র কোরআন এবং মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহ প্রচার করে ব্যক্তিজীবনে সেগুলোর অনুশীলনে মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করে আসছে। দরবারটি ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য হক্কানি দরবার হিসেবে বাংলাদেশ সহ ইসলামি বিশ্বে সুপরিচিতি অর্জন করেছে। আপনারা চাইলে প্রতিবছর ২৯,৩০ নভেম্বর ও ১ ডিসেম্বর এবং ১২,১৩ ও ১৪ ই মার্চ মাসে দরবারের মাহফিলে যেতে পারেন। এই মাহফিলে কয়েক লক্ষ মানুষের সমাগম হয়ে থাকে। মাহফিলে ইসলামি আকিদা, আমল ও সাম্প্রতিক বিষয় সম্পর্কে ওয়াজ করা হয়।
১৯১৫ সালে বিখ্যাত পীর আল্লামা শাহসূফী নেছারুদ্দীন আহমদ (রহ.) এই ছারছীনা দারুসসুন্নাত আলিয়া বা কামিল মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বাংলাদেশের প্রথম স্বীকৃত টাইটেল (কামিল) মাদরাসা। এই মাদরাসা ফলাফলের দিক থেকে সর্বদাই দেশের শীর্ষ স্থান দখল করে থাকে। এই মাদরাসা থেকে এ পর্যন্ত ৩০০ ছাত্র এর বেশি বোর্ডস্ট্যান্ড করেছে। এছাড়াও এই মাদরাসা নীতি-নৈতিকতা ও আক্বীদার উপর গুরুত্ব দেওয়ার জন্যেও সারা দেশে বিখ্যাত। ছারছীনা দরবার ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে সাড়ে চার হাজার দিনি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে।
সংক্ষেপে ছারছীনা দরবার গড়ে উঠার ইতিহাস তুলে ধরছি। আমর জানি, সমুদ্র তীরবর্তী দেশ হওয়ায় বাংলাদেশে আগমন ঘটেছে বনিক মুসলিম প্রচারকদের। আর মুসলিম শাসনের পথ বেয়ে আগমন করেছেন আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী অনেক আউলিয়ায়েকেরাম। তাঁদের পরশ ছোঁয়ায় ও আধ্যাত্মিক শক্তির কাছে নতি স্বীকার করে এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করার ফলে দেশটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে পরিণত হয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ১৭৫৭ইং সনে পলাশী প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়ায় দেশটি ইংরেজ বেনিয়াদের দখলে চলে যায়।যার ফলে বিধর্মীদের জাগরণ ও মুসলমানদের নিগৃহীত হওয়ার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা হয়ে যায়।
ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ ভাগ। বাংলার মুসলমানদের করুণ অবস্থা। মুসলমানদের জাতীয় অনুভূতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ নিভু নিভু অবস্থায় বিলীন হওয়ার পথে। সারা বাংলা বিশেষ করে এর দক্ষিণাঞ্চল ছিল অজ্ঞানতার তিমিরে আচ্ছন্ন।ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবে নিজস্ব তাহজীব -তামদ্দুন ছেড়ে দিয়ে মুসলমানরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল বিজাতীয় আচার-ব্যবহার, চাল-চলন ও পোশাক -পরিচ্ছদে। নামের আগে শ্রী ব্যবহার করা, লুঙ্গীর বদলে ধুতি পরিধান করা, টুপির বদলে মাথায় টিকি রাখা, মেয়েদের সিঁথিতে সিঁদুর ব্যবহার করা, কপালে লাল টিপ লাগানো, পূজাপার্বণে মুসলমানদের অংশগ্রহণ করা, তিথিলগ্ন, দিকশূল পালন এবং দেবদেবীর নামে মানত করার মত বহু ইসলাম গর্হিত কাজসহ শিরক ও বিদয়াত বাংলার ঘরে ঘরে সে সময় সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছিল। মুসলিম জাতীয় জীবনে নেমে এসেছিল ধর্মীয় চেতনা ও নৈতিক মূল্যবোধের এক চরম বিপর্যয়। এমনি এক সংকট সন্ধিক্ষণে বাংলার এক অজানা অচেনা নিভৃত পল্লী ছারছীনাতে বর্ষিত হল আল্লাহর রহমতের অমিয়ধারা।দীনের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে ১৮৭৩ সালে ধরায় চলে আসলেন এক পুণ্যবান তাপস, যুগশ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক, মুজাদ্দিদে জামান কুত্বুল আলম হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী নেছারুদ্দীন আহমদ (রহঃ)।
নেছারউদ্দীন আহমদ হুগলী মোহসিনীয়া মাদ্রাসায় পড়ার সময় ১৮৯৫ সালে ফুরফুরা শরীফের পীর আবুবকর সিদ্দিকীর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। বাইয়াত গ্রহণের পরে তিনি ইসলাম প্রচারে ১৯০৫ সালে নেছারুদ্দিন নিজ বাড়িতে মুসাফিরখানা হিসাবে একটি গোলপাতার দোচালা ঘর নির্মাণ করেন। তিনি বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে ইসলাম প্রচার করতেন ও সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণের চেষ্টা করতেন। তিনি জনসাধারণকে সচেতন করতেন ও নৈতিক উপদেশ দিতেন, এছাড়াও তিনি এই খানকায় তরিকার ছবক, তালিম-তরবিয়াত, ঈমান-আকিদাসহ ইসলামের মৌলিক রীতিনীতি বিষয়াদি শিক্ষা দিতেন। এভাবেই এই প্রতিষ্ঠানটি একসময় ছারছিনা মাদ্রাসা নামে পরিচিতি লাভ করে। দরবার শরীফের বর্তমান পীর মাওলানা শাহ মোহাম্মদ মোহেব্বুল্লাহ।
লেখক : Abdul Kahhar