02/11/2024
[আমি কাউকে ছোট-হেয় করার জন্য এই পোস্টটি করি নাই। কাউকে কামলাও বলি নাই। কারো ঘামের গন্ধ কিংবা কারো লুংগি পড়াতেও আমার আপত্তি নাই। আমি শুধুমাত্র আমার অভিজ্ঞতা সবার সাথে শেয়ার করেছি। পোস্ট পড়া শুরু করার আগে শেষ প্যারাটি পড়ার অনুরোধ থাকলো।]
আজকে দেশে ফেরার উদ্দেশ্যে সাত সকাল বেলায় যাত্রা শুরু করি বলোনিয়া, ইটালি থেকে। বলোনিয়া থেকে রোম মাত্র ২ ঘন্টায় চলে আসি হাই স্পিড ট্রেনে। সেখান থেকে সরাসরি চলে যাই রোমের FCO এয়ারপোর্টে। আমার ফ্লাইট ছিলো কাতার এয়ারওয়েজে। চেক-ইন শুরু হলে আমি আমার লাগেজ কার্গোতে দিয়ে বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করি। আমার দেশে আসা পর্যন্ত ১ টি ট্রান্সফার ছিলো। প্রথমে রোম থেকে দোহা। এরপর দোহা থেকে ঢাকা।
রোম থেকে দোহা পর্যন্ত ফ্লাইট টাইম ছিলো ৫ ঘন্টা। আমি সিট পেয়েছিলাম শুরুর দিকে। তার উপর আবার পাশের সিটে যাত্রী না থাকায়, বেশ আরামেই এই ৫ ঘন্টা যাত্রা সম্পন্ন করি।
বিপত্তি শুরু হয় পরের ফ্লাইটে এসে। পরের ফ্লাইট ছিলো কাতারের দোহা থেকে বাংলাদেশের ঢাকা পর্যন্ত। পরের ফ্লাইটে আমার সিট পড়ে বিমানের প্রায় শেষের দিকে। আমার সাথে সহযাত্রী হয় আরো প্রায় 100-150 বাংলাদেশী। ভাগ্যক্রমে এবারও আমার সিটের পাশের সিটে যাত্রী ছিলো না। সাধারনত আমি ফ্লাইটে অপরিচিত কারো সাথে কথা বলি না। আর মাঝে মধ্যে বিদেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যাত্রাপথে যাত্রীরা অকারনে শোরগোল করে না। এমনকি সামান্যতম শব্দও করে না।
তো, ফিরে আসি আবার দোহা টু ঢাকা ফ্লাইটে। ফ্লাইটের সহযাত্রীদের প্রায় সবাই ওয়ার্কার ভিসা কিংবা টুরিস্ট ভিসায় কাতারে গিয়েছিলো। এর মধ্যে প্রায় সবাই অবৈধ অভিবাসী হওয়ায় কাতার পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে দেশে পাঠাচ্ছিলো। এতকিছুর পরেও তাদের প্রতি আমার সম্মান বজায় ছিলো। কিন্তু ফ্লাইট আকাশে উঠার আগেই তারা যা শুরু করলো এতে আমার মাথাটা আস্তে আস্তে হেট হতে লাগলো।
এক ভদ্রলোক স্পঞ্জের স্যান্ডেল, লুংগি আর একটা ঘামের গন্ধযুক্ত শার্ট পড়ে আমার পাশের সারিতে বসলো। বসেই সে সিটের উপর ২ পা ভাজ করে বসে পড়লো।
সামনের দিকে দেখলাম যে, ফ্লাইট এটেন্ডেন্স কে ডাকার এবং আলো জ্বালানোর যে বাটনগুলো আছে, সেগুলো সামনের যাত্রীরা না বুঝেই টেপাটেপি শুরু করেছে। বিমানের কেবিন ক্রুরা যতবার এসে কল অফ করে, এর থেকে বেশিবার তারা বাটন টেপাটেপি করতে থাকে।
কিছুক্ষন পর বিমান আকাশে ডানা মেলে। পুরোপুরি স্ট্যাবল পজিশনে যাওয়ার আগেই অনেকে সিটবেল্ট খুলে টয়লেটের দিকে রওয়ানা দেয়। কেবিন ক্রুরা বারবার অনুরোধ করার পরেও তারা এভাবে হল্লা করতে থাকে।
আরও কিছুক্ষন সময় পার হওয়ার পর দেখি, ২০-৩০ জন নিজের সিট ছেড়ে বিভিন্ন যায়গায় গিয়ে জটলা করে আড্ডা শুরু করে। কেবিন ক্রুদের আসা-যাওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়ে তাদের আড্ডা চলতে থাকে। আর তাদের কথা আর হাসির এতো উচ্চশব্দ হয় যে, আমার মনে হচ্ছিলো পাড়ার কোন চায়ের দোকানে এসে পড়েছি।
কেবিন ক্রুরা বলতে গেলে হাতে পায়ে ধরে অনেককে সিটে বসিয়ে খাবার দেওয়া শুরু করে প্রথম দিক থেকে। এরই মধ্যে কয়েকজন অতি আগ্রহী যাত্রী সিট ছেড়ে সামনের দিকে চলে যায় খাবার সংগ্রহের জন্য। কেবিন ক্রুরা তাদের অনেক কষ্টে বুঝিয়ে শুনিয়ে সিটে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়।
খাবার দেওয়ার সাথে সাথে ড্রিংস দেয় কেবিন ক্রুরা। সেখানে বিয়ারের ক্যান আর স্কচ দেখে ১/২ জন চায়। তাদের দেখাদেখি সবার মধ্যে শুরু হয়, বিয়ার আর এলকোহলিক ড্রিংক চাওয়া। একেকজন ২/৩ ক্যান বিয়ার, ৪/৫ পেগ স্কচ/হুইস্কি খেয়ে শুরু করে মাতলামি। এর মধ্যে একজন বিমানের মধ্যে সিগারেট খাওয়ার বায়না ধরে। বহু কষ্টে সবাই মিলে অনুরোধ করে তার এই বায়না নিবৃত করা হয়।
মাতাল যাত্রীদের কেউ কেউ কেবিন ক্রুদের বিরক্ত করা শুরু করে। নাম জিজ্ঞাসা করা, বিয়েশাদি হইসে কিনা সহ এইরকম আরো নানা ফালতু প্রশ্ন করে বিব্রত করতে থাকে।
এরই মধ্যে কেউ একজন ব্লুটুথ পোর্টেবল স্পিকার ব্যাগ থেকে বের করে উচ্চশব্দে ভারতীয় বাংলা সিনেমার গান বাজানো শুরু করে।
এগুলা দেখতে দেখতে আমি একসময় কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। হটাৎ মনে হলো আমার পিছনে কেউ একটা ছালা কিংবা মোটা কাপড় ধরে লাঠি দিয়ে একটি নিয়মিত বিরতিতে খোচা দিচ্ছে। আমার ঘুম কেটে যায়। পিছন ফিরে দেখি যে, আমার পিছনের সিটের যাত্রী তার হাটু দিয়ে আমার পিঠ বরারব সিটের পেছনে ধাক্কা দিচ্ছে। তাকে অনুরোধ করলাম এমন না করতে। এরপর ধাক্কার গতি আরও বেড়ে গেলো। বাধ্য হয়ে জানালার পাশের সিটে চলে গেলাম।
দীর্ঘ সময় না ঘুমানোর কারনে আবারও আমার ঘুম আসলো। সেই ঘুম কেটে গেলো ঘামের দুর্গন্ধের কারনে। চোখ খুলে দেখি যে, আমার গায়ের উপর দিয়ে সেই লুংগি পরিধান করা ভদ্রলোক জানালা দিয়ে মেঘ দেখছেন। আমি তাকে বলি যেন এভাবে আমার গায়ের উপরে না উঠে অন্য কোন জানালা দিয়ে নিচের মেঘ দেখে। এই কথা বলাতে ভদ্রলোক আমাকে যা বললো তা শুনে আমি আর কিছু বলার ভাষা খুজে পাচ্ছিলাম না। উনার সাথে তর্কে জড়াবো না সিদ্ধান্ত নিয়ে চুপ থাকলাম।
কিছুক্ষণ পর আমি ছোট প্রাকৃতিক কাজ সারতে টয়লেটে যাই। গিয়ে আমার আসলে বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয় যে, এটা পাবলিক টয়লেট নাকি বিমানের টয়লেট! এতো নোংরা হয়েছিলো যে, সেই টয়লেট ব্যবহারের উপযোগী ছিলো না। আমার দেশের মানুষকে বিদেশীরা গালি দিবে, এজন্য সময় নিয়ে নিজে টয়লেট পরিষ্কার করে ব্যবহারের উপযোগী করলাম।
বিমানের পাইলট ঢাকায় যেতে আরো ৪০ মিনিট সময় লাগবে এমন ঘোষণা দেওয়া মাত্রই, কয়েকজন যাত্রী তাদের লাগেজ নামানো শুরু করলো। এক যাত্রী বললো যে, এতো সময় অপেক্ষা করেছেন, এখন আরেকটু অপেক্ষা করলেই তো হয়। এই কথা শুনে তার সাথে আবার ঝগড়া শুরু করলো তারা।
এভাবে দেখতে দেখতে যন্ত্রনাময় দীর্ঘ ৫ ঘন্টা পার করলাম। বিমান যখন দেশের মাটি ছুলো, এর সাথে সাথেই যাত্রীরা এমন হুড়োহুড়ি শুরু করলো, দেখে মনে হলো ১ মিনিটের মধ্যে যদি তারা বের হতে না পারে তাহলে হয়তো বিমান তাদের না নামিয়েই আবার কাতারে চলে যাবে। বিমান চালু থাকা অবস্থাতেই ব্যাগ নামানোর জন্য সবাই ঠেলাঠেলি শুরু করলো। বসে বসে দেখতে থাকলাম তাদের ঠেলাঠেলি।
এর মধ্যে একজন উঁচু গলায় অন্যদের সাথে গল্প করছিলো। গল্পের বিষয় হচ্ছে, সেই লোক কাতার পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে জেল খেটে এখন বাড়ি ফিরছে। সে জেলে থাকা অবস্থায় যেই আপেল খাওয়ার জন্য পেয়েছে, সেগুলো সে না খেয়ে ব্যাগে করে বাংলাদেশে নিয়ে যাচ্ছে। তার পরিকল্পনা হচ্ছে, সে কাতার জেলের আপেল নিজ বাসায় বসে আরাম করে খাবে এবং আপেলের বিচি তার উঠানে লাগিয়ে আপেল গাছ বানাবে।
এতোকিছুর পরেও আমি বাংলাদেশের মানুষ হয়ে আরেক বাংলাদেশীকে ঘৃনা কিভাবে করি? কিন্তু আমার সত্যিই খুব খারাপ লাগে এসব ঘটনা দেখতে। এইরকম পরিস্থিতির জন্য বিদেশীরা আমাদের দেশের লোক দেখলে পাত্তা দেয় না, অবজ্ঞা করে, নাক সিটকায়।
আমাদের এই সমস্যার জন্য আসলে দায়ী কে? কেন আমরা স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও সভ্য-উন্নত জাতি হতে পারলাম না? এই দায় কার? কে দিবে জবাব?
© লিখেছেন - Sabbir Ahmed