01/08/2022
ইলিশ সম্পর্কে কিছু কথা !
সাগরে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পরছে I ইলিশ মাছের বাজারে দুইটি শব্দের খুব প্রচলন আছে- "ককসিট ইলিশ" আর "লাইনের ইলিশ"। "ককসিট ইলিশ" হচ্ছে চট্টগ্রাম কক্সবাজার টেকনাফের ইলিশ। অর্থাৎ সাগরের কিম্বা লবণ পানির ইলিশ। "লাইনের ইলিশ" হচ্ছে মিঠা পানির ইলিশ।
১) বাজারে যতো ইলিশ তার অধিকাংশ ইলিশ বরিশাল, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালি, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের ইলিশ। চট্টগ্রাম কক্সবাজারের ইলিশ সামুদ্রিক ইলিশ। চাঁদপুরের পদ্মার বিখ্যাত ইলিশ আছে, কিন্তু সেটা অল্পই। মানে আমরা পদ্মার ইলিশ, পদ্মার ইলিশ শুনি বটে, এটা আসলে সঠিক নয়।
২) বাংলাদেশে ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর জেলাকে বলা হয় কেন ? চাঁদপুর হচ্ছে পদ্মা-মেঘনার মিলনস্থল। সেখানেই সবচেয়ে বেশি উন্নত মানের ইলিশ পাওয়া যায়। তবে চাঁদপুরে মেঘনার ইলিশও আছে, পদ্মার ইলিশও। কিন্তু তুলনামূলক ভাবে মেঘনা সমুদ্রের বেশি কাছে, পদ্মা একটু দূরে। তাই মেঘনার ইলিশ স্বাদে হেরে যায় পদ্মার ইলিশের কাছে। সাগরের ইলিশ মিঠা পানির বড় নদীর ভিতরে যতই ঢুকবে, ততই ইলিশের বেশি স্বাদ। গোয়ালন্দের ইলিশ যে কারণে বেশী স্বাদের।
৩) নদীর পানিতে প্ল্যাংটন নামে জলজ উদ্ভিদ খেলে ইলিশের স্বাদ বেশি হয়। যত প্ল্যাংটন খাবে, তত বেঁটে ও মোটা হবে ইলিশ। তত চর্বি হবে। গা থেকে ঝরে যাবে সামুদ্রিক লবণ।
৪) বাংলাদেশে ইলিশ সংরক্ষণ শুরু হয়েছে ২০০৩ সালে। ইলিশ বাঁচানোর জন্যই বিশেষ দফতর। বিস্তর গবেষণা চলে বাংলাদেশ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে। ইলিশ রপ্তানি থেকেও আসে বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা।
৫) ২০২০ সালের হিসেব বলছে, বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশের ইলিশ। বাংলাদেশে জাটকা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। সব মাসে ইলিশ ধরা যায় না। কেউ তা করলে কড়া শাস্তি। নদীতে নদীতে কোস্ট গার্ড, নৌপুলিশের কড়া তৎপরতা চলে- যদিও চুরি করে নিষিদ্ধ সময়েও ইলিশ ধরা হয়। আবার জেলেদের যাতে জীবন যাপনে সমস্যা না হয়, তার জন্য চার মাস ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। কয়েক লক্ষ জেলে পান চালের সঙ্গে টাকাও।
৬) নিয়মিত চোরাচালান এবং রপ্তানির বাইরেও পূজা উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে 'উপহার হিসেবে' কোলকাতায় হাজার হাজার টন টন ইলিশ পাঠানো হয়। ফলে বাংলাদেশের বাজারে অনেক বেড়ে যায় ইলিশের দাম। আটশোর ইলিশ বিকোচ্ছে চোদ্দোশোয়। স্বাভাবিক, আমাদের দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ। আমজনতার ভাষ্যমতে ‘যারা বিপদে টিকা দেয় না, পেঁয়াজ চালান আটকে দেয়, তিস্তার পানি দেয় না, তাদের জন্য এত দরদ ভালো নয়’। যুক্তিটা ফেলে দেওয়ার নয়।
৭) বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে বরিশালের ভোলায়। ভোলার পরেই বরগুনা। তারপর থাকবে পটুয়াখালি, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার। অধিকাংশ সাগরের ইলিশ। ছয় নম্বরে চাঁদপুর- ইলিশের বাড়ি। এখান থেকেই হয়তো ভালো স্বাদের ইলিশের প্রাপ্তি শুরু। আমার কাছে সব চাইতে বেশী স্বাদের ইলিশ বরিশালের বিষ খালী, সন্ধ্যা নদী এবং ফরিদপুরের মধুমতী নদীর।
৮) বাংলাদেশে ইলিশ নিয়ে অসংখ্য রেসিপি। তবে সব চাইতে বেশী আলোচিত "ইলিশ পাতুরি"! আমার পছন্দ বরিশালের ইলিশ পোলাও। পুরনো ঢাকার মানুষের পছন্দের ইলিশ বিরিয়ানিও আমার ভালো লাগে। পহেলা বৈশাখ "পান্তা ইলিশ" একটা কর্পোরেট ফ্যাশন কিম্বা উচ্ছন্নে যাওয়া লোকের আতলামী/বখাটেপনা ছাড়া আর কিছুইনা।
৯) ইলিশ সুরক্ষা করায় বাংলাদেশ এতটাই সচেষ্ট, নানা নদীতে বেড়ে গিয়েছে ইলিশ। ১৫ বছর আগে, দেশে ২৪টি নদীতে ইলিশ মিলত। এখন সেই সংখ্যাটা দাঁড়িয়ে ৬৫। মানে ৬৫ নদীতে ইলিশ মেলে।
১০) কৈশোরে ইলিশ নিয়ে একটা ছড়া কাটতাম- "ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা/বোয়াল মাছের দাড়ি/ইয়াহিয়া খান ভিক্ষা করে/শেখ মুজিবের বাড়ি।"
এত কিছুর পরেও আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের কাছে ইলিশ অধরাই থেকে যায়। এই ইলিশ কিনে খাওয়ার দু:সাহস দেখাতে পারেনা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। অথচ এটাকে আমাদের জাতীয় মাছ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ইলিশের ভরা মরসুমে কতজন মানুষের সাধ্যে কুলোয় একটা ইলিশ ৬০০/৯০০/১০০০/২০০০ টাকায় কিনে একবেলা খেতে? এই মাছ আমাদের দেশে বুর্জোয়া, দুর্নীতিবাজ আর কালোটাকার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় মাছ কেন সাধারণ গরীব, শ্রমজীবী মানুষ কিনতে পারে না তা ভেবে দেখা উচিত।