18/06/2024
চলতি বছর হজ অব্যবস্থাপনার জন্য আরাফা, মুজদালিফা ও বিশেষ করে মিনায় লক্ষাধিক হাজী চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন। মুজদালিফায় খোলা ময়দান বা জামারা থেকে দলছুট হাজীগণ ক্যাম্প চিনতে না পারার কারনে ক্লান্ত, শ্লান্ত, ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। অনেকে রাস্তায় জ্ঞান হারিয়েছেন, ইন্তেকাল করার সংখ্যাটাও কম নয়। ছায়া ও পানিহীন চরম ভাবাপন্ন পরিবেশে দলছুট হাজীরা কঠিন পরীক্ষায় পড়েছেন। জামারায় যাওয়ার রাস্তাগুলোতে পর্যাপ্ত পানি ও ছায়া থাকলে এবং প্রত্যেক পয়েন্টে বিভিন্ন ভাষাভাষী স্বেচ্ছাসেবক থাকলে এই পরিস্থিতি হয়তো অনেকটাই এড়ানো যেতো। হজ অবশ্যই আর্থিক ও শারিরীক ইবাদত, হজ সবরের জায়গা। কিন্তু মানবসৃষ্ট অব্যবস্থাপনার কস্ট মেনে নেওয়া কঠিন।
রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া সরকারী/বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা নগণ্য। আজকে বাদ মাগরিব ৭.৩০ থেকে রাত ২.০০ টা পর্যন্ত বাংলাদেশী হাজীদের এলাকা সংলগ্ন রাস্তা ৬২, ৫১১, কিং ফাহাদ রোড ৬৮, ৫৩৩, মিনা স্টেশন-১ এলাকায় অন্তত ৫০ জন হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশী, ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানী হাজিদের পথ দেখানো ও ক্যাম্পে পৌঁছে দেওয়ার চেস্টা করলাম, পথে ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানী স্বেচ্ছাসেবক পেলেও বাংলাদেশী সরকারী স্বেচ্ছাসেবক তেমন চোখে পড়েনি। হজের মত মহান ইবাদত সৌদি সরকার, বাংলাদেশ সরকার ও মুয়াল্লিমদের জন্য নিরেট অর্থনৈতিক আয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার মিনার যে ম্যাপ হজ ওয়েবসাইটে আপলোড করেছে, তাতে মারাত্বক ভুল রয়েছে। ৫৮ নং মক্তব ও ৫৯ নং মক্তবের স্থান অদল বদল হয়েছে,।এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে হজযাত্রীদের জন্য কোন কার্যকারী হেল্পলাইন নেই, সবক্ষেত্রে হাজীদের প্রতি দায়সারা ভাব। সারাবছরের বিমান বাংলাদেশের লস হজ মওসুমে পোষানো, সরকারী খরচে বিশাল বহরের হজসেবকদের থেকে সেবা পাওয়া যায় নিতান্তই।
সৌদি সরকার ও পুলিশ রাস্তা নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধ হজ যাত্রীদের ডিপোর্ট করতেই ব্যস্ত। হজে বিলবোর্ডগুলোতে শুধুমাত্র লেখা- লা হাজ্জা ইল্লা তাশরীহ, মানে অনুমোদন ছাড়া হজ নয়, অথচ আল্লাহর ঘরের মেহমানদের স্বাগত জানানো, সেবামূলক তথ্য জানানো বিলবোর্ডগুলোর মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিলো। এইবার প্রতি এন্ট্রি ও বিভিন্ন পয়েন্টে কঠোর চেকিং ছিলো। সৌদির নিজস্ব সংবাদ মতে, ৩ লক্ষ+ অনুমোদনহীন হাজিকে মক্কা থেকে ডিপোর্ট করা হয়েছে, উল্লেখযোগ্য কারান্তরীন করা হয়েছে। অনুমোদন ছাড়া ট্রাভেল বা ওমরা ভিসায় হজ করলে খরচ ৭০% কমে যায়, সৌদি সরকারের আয়ও কমে যায়।
এইবার ১৮ লক্ষ ৩৩ হাজার+ বৈধ হজযাত্রী হজ করেছেন, শুধুমাত্র হজ কেন্দ্রিক অর্থনীতির বাজার ১.৫ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। সৌদি সরকার তাদের অর্থনীতিকে ডাইভারসিভাইড করতে ভিশন ২০৩০ গ্রহণ করেছে। এতে ২০৩০ নাগাদ ৩ কোটি হজ/ওমরাযাত্রী এবং প্রায় ১৮ লক্ষ কোটি টাকা জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সৌদি সরকারের এখন হজ অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য, এলিটদের জন্য প্রচন্ড ব্যয়বহুল ও বিলাসবহুল হজ/ওমরার ব্যবস্থা করা। অথচ হাজিদের সেবা করা ছিলো আরবদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। হাজিদের সেবা যেমন পানি পান করানো, খাবার খাওয়ানো কর্পোরেট হয়ে গেছে, বিভিন্ন কোম্পানীকে সম্ভবত দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
এই যুগেও আল্লাহর ঘরের মেহমানদের সাথে এই দুরবস্থা দেখে বোঝা যায়, সত্যিকার অর্থে এখন কাবার খেদমতগার বা খাদেমুল হারামাইন নেই।
আগামীতে যারা হজ করবেন তাদের জন্য কিছু পরামর্শ -
১. সুযোগ থাকলে ভালোভাবে গুগল ম্যাপ, হজ ম্যাপ শিখে যান। লোকেশন শেয়ার করা ও ফলো করা অল্প করে বোঝার চেস্টা করুন। কোথায় কিভাবে যাচ্ছেন- কিভাবে যাচ্ছেন- ফলো করার চেস্টা করুন। যে কাফেলার এই ধরণের কারিগরি সাপোর্ট আছে, তাদের বাছাই করুন। সহযাত্রীদের সাথে অনলাইন গ্রুপ করুন।
২. খরচ হলেও সৌদি সিম, মিনিট ও ইন্টারনেট কিনবেন। তবে অযাচিতভাবে ভিডিও কলে আপনার ইবাদত আপনার পরিবার বা মানুষকে দেখাবেন না। প্রয়োজনের বাইরে মোবাইল ব্যবহার করবেন না।
২. প্রত্যেক জায়গা মোবাইলে পিন করে রাখুন। সকল ডকুমেন্ট সাথে রাখুন, প্রয়োজনীয় মোবাইল নং সেইভ রাখুন। খিমা, রাস্তা ইত্যাদি লিখে বা ছবি তুলে রাখুন।
৩. গুগল ট্রান্সলেটের ব্যবহার করা শিখুন, বেসিক কিছু আরবী শিখুন। আর কেউ আরবী শিখতে পারলে খুবই ভালো, কারন আরবী শেখা ছাড়া পরিপূর্ণভাবে কুরআনের স্বাদ আস্বাদন করা সম্ভব নয়।
৪. ৪-৫ মাস ধরে হাঁটার প্রস্তুতি নিন। প্রতিদিন ৫-১০ কিলো হাঁটুন। হজে দিনে ১৫-২০ কখনও ২৫ কিলোও হাঁটা লাগতে পারে।
৫. হজ ও ওমরার সকল দোয়াগুলো মুখস্ত ও নোট করে নিন। সকল মাসয়ালা পূর্বেই জেনে নিন। শুধুমাত্র ইবাদতে মনোনিবেশ করার নিয়্যত করুন। সহি আমল করার চেস্টা করুন।
৬. কাবার ম্যাপ বিশেষ করে গেটগুলো চিনে রাখুন। কোন গেট দিয়ে কোথায় যাওয়া যায়, কিভাবে যেতে হয় দেখে রাখুন।
৭. অল্প খাবারে, জায়গায় তুস্ট হওয়ার চেস্টা করুন। খাবার অপচয় করবেন না।
৮. কাফেলার সাথে লোকেশনসহ সকল বিষয়ে আলাপ ও লিখিত করে রাখুন।
৯. ইসলামের ঐতিহাসিক নিদর্শন ও স্থানগুলো ভ্রমণের চেস্টা করুন।
১০. দলগতভাবে থাকার চেস্টা করুন। কোথাও একা না যাওয়ার চেস্টা করুন। দলনেতাকে জানিয়ে যেকোন কার্যক্রম সম্পাদন করুন।
১১. অন্যকে সহযোগিতা করুন, যেকোন প্রয়োজনে অন্যের সহযোগিতা নিন। সাহস হারাবেন না, আল্লাহর উপর ভরসা করুন।
আল্লাহ সকলের হজ কবুল করুন। আমিন।