দিবর দীঘির মধ্যস্থিত জয়স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ৩টি পৃথক মত পাওয়া যায়:
এক: দ্বিতীয় মহিপাল কে পরাজিত ও হত্যা করার সাফল্য কে স্মরণীয় করে রাখতে দিব্যক এ জয় স্তম্ভ নির্মান করেন ।দীনেশ চন্দ্র সেন “বৃহতৎ বঙ্গ” গ্রন্থে লিখেছেন – “কৈবর্তরাজ ভীমের খুল্ল পিতামহ দিব্বোক দ্বিতীয় মহিপাল কে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করিয়া বিজয়োল্লাসে যে স্তম্ভ উথ্থাপিত করিয়াছিলেন তাহা এখনও রাজশাহী জেলার এক দীঘি
র উপরে মস্তক উত্তোলন করিয়া বিদ্যমান”। উল্লেখ্য পূর্বে নওগাঁ রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
দুই: দিব্যকের রাজত্ব কালে পাল যুবরাজ রামপাল বরেন্দ্র উদ্ধারের চেষ্টা করে দিব্যক এর নিকট পরাজিত হন।দিব্যক এ সাফল্যের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে দীঘি মধ্যস্থিত এ স্তম্ভ নির্মান করেন।সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতের পরিচিতি পর্বে অনুবাদক বিজয় স্তম্ভ নির্মানের করন সম্পর্কে নিম্নলিখিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন : “ পূর্ববঙ্গের ভোজ বর্মার তাম্রশাসন হইতে জানা যায় দিব্যের বীরত্ব খ্যাতি তৎকালে উপমার বিষয় ছিল। অত্যল্পকালই বরেন্দ্রী দিব্যের রক্ষণাধীন থাকে। পূর্বোদ্ধৃত মনহলি লিপির ১৪শ শ্লোক ও রামচিরতের ১/২৯ শ্লোক একত্রে পাঠ করিলে জানা যায় দিব্যের রাজত্বকালে রামপাল (১০৮২ - ১১২৪) একবার পিতৃরাজ্য উদ্ধারে সচেষ্ট হইয়া ব্যর্থকাম হন। দিনাজপুর জেলার ( বর্তমানে নওগাঁ) দিবর দীঘি নামক জলাশয় ও তন্মধ্যস্থিত শিলাস্তম্ভ আজিও তাহার স্মৃতি রক্ষা করিতেছে”।
তিন: ভীম এ স্তম্ভটি নির্মান করেন এবং পিতৃব্য স্মৃতি রক্ষার্থে স্তম্ভটি তাঁর নামে উৎসর্গ করেন। অধ্যাপক শিরিন আখতারের বিবরনে তার সমর্থন পাওয়া যায়। যে উদ্দেশ্যেই এ স্তম্ভটি নির্মিত হোক না কেন, এই দিবর দীঘি নামক জলাশয় ও তন্মধ্যস্থিত শিলাস্তম্ভটি দিব্যকের স্মৃতি অম্লান করে রেখেছে।
নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শন দিবর দীঘির দিব্যকের জয়স্তম্ভ। এই দিবর দিঘীর দিব্যকের জয়স্তম্ভকে ঘিরে গড়ে উঠেছে দীঘির চারপাশে মনোরম পরিবেশ। পাল আমলে খননকৃত ৬০ বিঘা দিঘীর মাঝখানে আশ্চর্যজনকভাবে স্থাপিত অখন্ড গ্রানাইড পাথরের স্তম্ভ সূদুর অতীতের বাঙ্গালীর শৌর্যবীর্যের সাক্ষ্য বহন করছে আজও। উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক দিবর দিঘীটি নওগাঁ জেলা সদর হতে উত্তর পশ্চিমে ৫২ কি.মি. এবং পত্নীতলা সদর হতে ১৩ কি.মি. পশ্চিমে নজিপুর- সাপাহার রাস্তার পার্শ্বে দিবর ইউনিয়নের দিবর গ্রামে অবস্থিত।[১] এই দিবর দীঘির মাঝখানের স্তম্ভটির উচ্চতা ৩১ ফুটের মধ্যে পানির উপরিভাগে ১০ ফুট, পানির নিচে ১০ ফুট ও মাটির নিচে ১১ ফুট গ্রথীত আছে বলে জানা গেছে।
*ইতিহাস*
পাথরটির ইতিহাস নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় মহিপালের আমলে ১০৭৫ সালে বাংলার কৈবর্ত্য সম্প্রদায়ের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। মহিপালের রাজসভায় এই কৈবর্ত্যরা উঁচু উঁচু পদে অধিষ্ঠিত ছিল। দ্বিতীয় মহিপাল ছিল দুর্বল ও চরিত্রহীন শাসক। দ্বিতীয় মহিপালের অযোগ্যতার কারণে বাংলায় অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। কিছু সেনাপতি ও বিপথগামী লোক এ সুযোগে দ্বিতীয় মহিপালকে হত্যা করে। দিব্যক সর্বসম্মতিক্রমে বরেন্দ্রভূমির অধিপতি নির্বাচিত হন। দিব্যকের শাসনামল ছিল ১০৭৫-১১০০ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় মহিপালের সময় তিনজন রাজা বাংলায় শাসন করেন। এরা হলেন দিব্যক, রুদ্রক ও ভীম। বৃটিশ ভারতীয় বিশিষ্ট ইতিহাস লেখক বুকারন হ্যামিলটনকে পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে ঐতিহাসিক স্থানগুলোর উপর জরিপ করে একটি তালিকা প্রণয়নের জন্য এই অঞ্চলে পাঠান। তিনি ১৭৮৯ সালে দীঘির পার্শ্বে এসে উপস্থিত হন এবং জরিপ করেন। বুকারন হ্যামিলটন ঐ দিঘীটিকে কৈবর্ত্যদের বলে উল্লেখ করেন। তার মতে জনৈক ধীবর রাজা এটি তৈরি করেন। তবে বৃটিশ প্রত্নতত্ববিদ স্যার আলেকজান্ডার ক্যানিং হামের মতো, একাংশ শতাব্দির কৈর্বত্য রাজা দিব্যকের ভ্রাতা রুদ্রকের পুত্র প্রখ্যাত নৃপতি ভীমের কীর্তি এটি। এ স্তম্ভের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মাঝে মতবিরোধ থাকলেও আজ অবধি দিব্যকের কীর্তি বলে অত্রাঞ্চলে প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে। ধারণা করা হয, এই শাসনামলে পাল বংশকে পরাজিত করে বিজয় অর্জনের স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে দীঘির মাঝখানে জয়স্তম্ভ স্থাপন করা হয়। এটি একটি অখন্ড পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে।