13/10/2024
পুরোটা পড়েন ভালো লাগবে।
এক বছরের বেশি হয়ে গেল আমার প্রবাস জীবনের – জার্মানির হামবুর্গ শহরে। হামবুর্গ আন্তর্জাতিক শহর – ১৮০ এর বেশি দেশের মানুষের এখানে বসবাস। এখানে আসার আগে মাত্র একজন বাংলাদেশিকে চিনতাম, তার ওপর হামবুর্গে বাংলাদেশির সংখ্যা হাতেগোনা হওয়ার কারণে প্রথম থেকেই বিদেশি বন্ধবান্ধব জুটে যায়, এদের সাথেই ওঠাবসা চলে।
পূর্বের চায়না থেকে পশ্চিমের আমেরিকা – সবার সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে…ইংলিশটা ভালো হওয়ার কারণে অনেক জার্মান বন্ধুও জুটেছে (হাম্বুরগের জার্মানরা তাদের ইংলিশ-এর উন্নতির বেপারে খুবই সচেতন :D)… উইকেন্ডের সারারাত জেগে জীবনভিত্তিক আড্ডাও হয়েছে।
সব মিলিয়ে আমি বলব গত একবছর আমার জীবনের সবচেয়ে শিক্ষামূলক সময় কাটিয়েছি– বেশ কিছু জিনিশ উপলব্ধি করেছি…
ছোটবেলায় আমার কাজিনের (Tamal vai) কল্যাণে হলিউড মুভি দেখা হয়েছে অনেক। মুভি দেখতাম আর আফসোস করতাম – ইশ!! কেন যে আমেরিকা-ইউরোপে জন্ম হলো না!!! কত সুন্দর বাল্যকাল কাটাতাম!!! স্কুল থেকে প্রতি বছর অন্য দেশে ট্রিপে নিয়ে যেত, সামারে বনে-বাদারে ক্যাম্পিং করতাম, শীতকালে উইন্টার স্পোর্ট করতাম, ১৩-১৪ বছর বয়স থেকে গার্লফ্রেন্ড থাকত, ১৬ বছর থেকে পার্টটাইম কাজ শুরু করে টাকা জমিয়ে ২০-২১ বছর বয়সে ওয়ার্ল্ড ট্রিপ দিতাম! What a life that would have been!
অনেক রাগ ছিল বিধাতার ওপর...গরিব দেশে জন্ম দেওয়ার কারণে। আজ আমি এক বছর প্রবাস জীবন কাটানোর পর প্রতিদিন একবার আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি, গরিব-মুসলিম দেশে জন্ম দেয়ার কারণে…একটু ব্যাখা করার চেষ্টা করি, কেন এই উপলব্ধি।
জার্মানি আসার আগে জার্মানির উপর কিছু আর্টিকেল পড়েছিলাম। এমন একটা আর্টিকেল এ ছিল লাভ ইন জার্মানি এর ওপরে। আর্টিকেলের একটা জিনিস বেশ অবাক লাগছে – জার্মানরা “আমি তোমাকে ভালবাসি” – এই কথাটা পারত পক্ষে বলে না। ২-৩ বছরের সম্পর্কের পর ও ওরা ভালবাসার কথা এড়িয়ে চলে। প্রথমে বিশ্বাস করি নাই। এখানে এসে জার্মানদের সাথে মএশার পর, বেশ কিছু জার্মান ফ্যামিলির কাছ থেকে দেখার পর ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারছি। এখানে বিয়ে ৪-৫ বছরের বেশি টেকে না। অধিকাংশ ফ্যামিলি বাচ্চা ছোটো থাকা অবস্থায় ভেঙে যায়। এর ফলে যেটা হয় যে, বাচ্চা ছোটো বয়স থেকেই দেখে যে বাবা-মা দুইজনের কাছেই কয়েক মাস পর পরই গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড আসছে… কেউই স্থায়ী হয় না। ছোটবেলা থেকেই একটা শিক্ষা ওরা নিয়ে নেয়, “মানুষ আসবে, মানুষ যাবে”। যার কারণে অটোমেটিক্যালি মানসিক আত্মরক্ষা এর কারণে ওরা কোনো মানুষের প্রতি ইমশোনাল ডেভেলপমেন্ট করতে পারে না। কারম আনকনশাসলি ওরা এটা ধরেই নেয় যে, কেউই বেশিদিন থাকবে না। তার ওপর ১৩-১৪ বয়স থেকেই ফিসিকাল রিলেশনশিপ শুরু করে দেয় - ভালোবাসার জন্য না, আসলেই ফিজিক্যাল কিউরিসিটি থেকে এবং প্রতি বছর নতুন নতুন। যার কারণে নারী-পুরুষ সম্পর্কের ভেতর ওদের কাছে কোনো কিছু বাকি থাকে না। যার ফলে ওরা পুরো নারীপুরুষ সম্পর্কের বিষয়ে ইন্সেন্সিটিভ হয়ে যায়।
একটা ইগজ্যামপল দেই, এখানে ছেলে-মেয়ে বন্ধু (শুধু বন্ধু) একসাথে ঘুমায়… কোনরকম সমস্যা ছাড়া। গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ডকে জিজ্ঞাসা করা, কার সাথে চ্যাট করতেছে, কারসাথে পার্টিতে যাচ্ছে– এগুলো রুড। রিলেশনশিপ ওদের কাছে নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া, নতুন শরীরের অনুভূতি নেয়া মাত্র… …
ভালবাসার অনুভূতি এক অবাস্তব বিষয়। বলিঊডের মুভি দেখে প্রচণ্ড অবাক হয়– সত্যিই কি ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের মানুষরা এতোটা রোমান্টিক? এত অনুভূতি ওদের আসে কোথা থেকে?
আরেকটা বিষয় হল কালেক্টিভিসম অ্যান্ড ইন্ডিভিডুয়ালিসম। গরিব দেশের সমাজ কালিক্টিভিস্টিক হয় সারভাইভাল-এর জন্য। কারণ সরকার সমাজ সবসময় ব্যাসিক নিড ফিলাপ করে না। যার কারণে আমরা ছোটবেলা থেকেই পরিবার, বন্ধু, ভালোবাসার মানুষের জন্য স্যাক্রিফাইস করা শিখি… এটাই তো ভালোবাসা, অনুভূতির জগতের ব্যাসিক।
আর একটা ইন্ডিভিডুয়ালিস্টিক সোসাইটিতে স্যাক্রিফাইস-এর কন্সেপ্টটা অচেনা…এখানকার মোটো হলো– “তোমার জীবন এটা, তাই কর, যেটা শুধু তোমার জীবনের জন্য ভালো”। যার ফলে প্রতিটা মানুষ বাঁচে শুধু নিজের জন্য— আমাদের জন্য যেটা সায়েন্স ফিকশন, কল্পনার বাইরে।
এ-কারণে পরিবার-ভালোবাসার মধ্যে এ-ধরনের প্রশ্ন খুবই কমন – “ও কি আমাকে সুখী করছে? ওকেই কি আমি চাই? আমার বাবা-মার সাথে থাকার কারণে আমার ব্যক্তিগত জীবন কি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে?”- পুরো জীবন জুড়েই এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে চলে যায়… অনুভব আর করা হয় না।
ওরা খুবই অবাক হয় শুনে, যখন আমি বলি, আমাদের প্রশ্নগুলো পুরো উল্টো– আমরা চিন্তা করি আমার আমাদের বাবা-মাকে সুখী করতে পারছি কিনা, ভালবাসার মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে পারছি কিনা… আর সবথেকে বড়ো বিষয় হলো, গডলেস সোসাইটিতে বড়ো হবার কারণে শেখে— এই জীবনটাই আসল, এরপর আর কিছু নাই, সব শেষ! সব মানুষের পক্ষে তার এই ধরনের বাস্তবতা মেনে নেয়া কঠিন। হার্টে সত্যের অপূর্ণতা থেকেই যায়।
মজার একটা বিষয় হলো ছোটবেলা থেকেই এতটা রোবোটিক যে, এখানে আপনি জার্মান কোনো বাচ্চাকে কাঁদতে দেখবেন না। রাস্তায় যদি কোনো বাচ্চার কান্না শুনেন, তাহলে চোখ বন্ধ করে বুঝে নিবেন টার্কিশ বা আরব বাচ্চা। আমি এখন পর্যন্ত একটা জার্মান বাচ্চাকে কাঁদতে দেখিনি… সত্যি!
আমার এই অভিজ্ঞতার পর ছোটবেলার ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডের প্রতি হিংসা, ওদের প্রতি করুণায় পরিণত হয়েছে। যতবারই জার্মানদের সাথে এইসব বিষয়ে কথা বলেছি, ততবারই গম্ভীর হয়ে গেছে, ২-৩ জন কেঁদেও দিয়েছে। আসলেই ওদের মনের ইমোশনাল ভেকেন্সিটা একটু ফিল করতে পারলে ভয় লাগে…কিভাবে এভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব? উত্তর হলো উইকডেতে কাজে ব্যস্ত থাকা, উইকেন্ডে মাতাল হয়ে সব ভুলে যাওয়া… মাঝে মাঝে সাইক্রিটিস্ট ভিজিট করা, অ্যান্টিডিপ্রেসসিভ ড্রাগ নেয়া… নতুন রিলেশনশিপ খোঁজা, রাস্তায় প্রথম ২-৩ মাস ওপেনে কড়া ভালোবাসা (!) বহিঃপ্রকাশ করা… তারপর আবার প্রথম থেকে শুরু করা…
আসলেই আল্লাহর কাছে অগণিত শুকরিয়া, বাংলাদেশের মত গরিব ও রক্ষণশীল মুসলিম দেশে জন্ম দেয়ার জন্য। যেখানে এমন মা পেয়েছি যে তার, ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়েছে ছেলে-মেয়েকে মানুষ করার জন্য। যেখানে বাবা পেয়েছি যে শখ করে নিজের জন্য একটা ঘড়িও কেনেনি – ছেলেমেয়েদের পেছনে খরচ করার জন্য। যেখানে পরিবার পেয়েছি যার কথা ভাবলেই সব দুঃখ-কষ্ট ম্লান হয়ে যায়। যেখানে আল্লাহ তোমাকে পেয়েছি, আখিরাতের কথা চিন্তা করার সুযোগ পেয়েছি।
সংগৃহীত