22/06/2020
ভ্রমণে মালেয়শিয়াঃ
যদি কোন দেশকে বৈচিত্র্যতার জন্য পুরস্কৃত করা হয় তাহলে মালয়েশিয়া হবে অন্যতম। রীতিনীতি, দ্বীপের সারি, পাহাড়-পর্বত, উর্বর উচ্চভূমি ও ট্রপিকেল রেইন ফরেস্ট এই সব বৈচিত্র্য নিয়ে মালয়েশিয়া গঠিত।
শুরুতেই কুয়ালালামপুর। মালয়েশিয়ার বাণিজ্যিক রাজধানী এবং প্রধান শহর। বাণিজ্যিক রাজধানী এই কারণে বলা কারণ মালেয়শিয়া সেই দেশ যার রাজধানী দুইটা! একটি বাণিজ্যিক, অপরটি প্রশাসনিক। প্রশাসনিক রাজধানী হল পুত্রজায়া।
কুয়ালালামপুর-
পুরাতন ঐতিহ্যের সাথে সাথে আধুনিকতার ছোঁয়া খুঁজে পাওয়া যায় এই শহরে। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ রাজত্বের অধীনে থাকা একটি জঙ্গলে একদল চিনা ভাগ্যান্বেষী অনুমতি নিয়ে বসতি স্থাপন করতে থাকে। ধীরে ধীরে গ্রাম থেকে সেটা এখন বিশ্ববাসীর এক অত্যাধিক আকর্ষনীয় কর্মবঞ্চল, ঝকঝকে আধুনিক শহর কুয়ালালামপুর।
মালেয়শিয়ার ভ্রমণ ২ দিন হলে শুধু কুয়ালালামপুর সিটি ট্যুর করতে পারেন। দেখতে পারেন ৮৮ তলা ও ১৪৮৩ ফুট উচ্চতার পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, কুয়ালালামপুরের ঔপনিবেশিক স্থাপত্বের নিদর্শন ন্যাশনাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, স্বাধীন মালেয়শিয়ার পতাকা উত্তোলনের পতাকাদণ্ড ১০০ মিটার উচ্চতার মারডেকা স্কোয়ার, সুলতান আব্দুল সামাদের প্রসাদ (বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট), অপরুপ স্থাপত্বের জামেক মসজিদ, মসজিদ নেগারা, ইসলামিক আর্ট গ্যালারী, জে ইয়া মন্দির, লেক গার্ডেন্স, বাগানের মধ্যে হৃদ তাসিক পেরদানা, বার্ড পার্ক। একসাথে কয়েকজন থাকলে নিজেরাই ট্যুর প্ল্যান করতে পারেন না হলে সিটি ট্যুরের ব্যবস্থা নেয়ার ব্যবস্থা আছেই। আর মনে রাখবেন, রাতের কুয়ালালামপুর আলো জ্বলমল সবসময়....
পুত্রজায়া-
ঘুরে আসতে পারেন ২৫ কিঃমঃ দূরের মালেয়শিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পূত্রজায়া থেকে। পুরোটাই কৃত্রিমভাবে তৈরী করা হয় ৯০ দশকে। আমেরিকাকে চ্যালেন্জ করে তৈরী করা স্যাটেলাইট সিটি এই পুত্রজায়া। ফেডারেল মালেয়শিয়ার রাজধানীতে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অফিস, বাসস্থান। সেই সাথে সকল সরকারী কাজকর্মের কেন্দ্রস্থল।
গ্যান্টিং হাইল্যান্ড-
যদি ভ্রমন হয় তিন দিনের, তাহলে যাবেন শৈল শহর গ্যান্টিং হাইল্যান্ড। ছুটি কাটানোর অসাধারণ একটি জায়গা। একটি সন্ধ্যা কাটাতে পারলে বারবার যেতে ইচ্ছে হবে। কুয়ালালামপুর থেকে বাসে এবং পরবর্তীতে স্কাইওয়েতে করে হোটেলে।
মালাক্কা-
আরেকটা দিন বাড়াতে পারলে অবশ্যই যাবেন এশিয়ার অন্যতম বন্দর শহর মালাক্কা। মিশ্র সংস্কৃতির এই শহরটি হল মালেয়শিয়ার প্রাচীন শহর। অনেকে মালয়েশিয়ার আন-অফিশিয়াল রাজধানীও বলে থাকেন মালাক্কাকে। চিনা, ভারতীয়, আরব, পুর্তুগিজ, ইংরেজ সকলের অবদানে এই শহর গড়ে উঠে। নদীর দুদিকেই মালাক্কা শহর। হেরিটেজ বিল্ডিং, স্ট্রিট মার্কেট, টাউন হল না দেখলে বিচিত্র এই মালেয়শিয়াটাই অপরিচিত থেকে যাবে আপনার কাছে। মালাক্কা সুলতানের বাড়ি, হেরিটেজ মিউজিয়াম, সেন্ট পল চার্চ, মালাক্কা ফেমোসা, মালাক্কা ডাচ স্কয়ার, মালাক্কা স্কাই টাওয়ার, স্থাপত্য মিউজিয়াম, মসজিদ ট্রানকুরাহ, মেকাও গ্যালারি, মালাক্কা ওয়ান্ডার ল্যান্ড থিম পার্ক, স্বাধীনতা চত্বর, বার্ড পার্ক আর মালাক্কা রিভার ক্রুজ প্রায় একসঙ্গেই। অবশ্যই দেখতে যাবেন ‘আফা মুসা পার্ক। ঘূর্ণায়মান পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে মালাক্কাকে দেখে নিতে পারেন মাত্র কয়েক মিনিটেই।
পেনাং-
মালেয়শিয়া ভ্রমণের জন্য যদি আরো ২ দিন বাড়ান; যাবেন পামে ছাওয়া দ্বীপ পেনাং। নীল জলরাশি, পাহাড় ও বিশাল সেতুর বন্ধনে আবদ্ধ পেনাং। বহুজাতিক, অসাম্প্রদায়িক, শান্তিপূর্ণ রাজ্য পেনাং হল মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ভূমিপুত্রা, চায়নিজ, ভারতীয়, ইউরোশিয়োদের বসবাস আছে এখানে। ভোজন প্রেমীরা পেনাংকে মালেয়শিয়ার ভোজন রাজধানীও বলে থাকেন। বৈচিত্র্যময় খাদ্যের সম্ভার আছে পেনাংয়ে। পর্যটনের আকর্ষন পেনাং সড়ক পথে গেলে এশিয়ার দীর্ঘতম ও বিশ্বের পঞ্চম ১৩.৫ কিঃমি দীর্ঘ পেনাং ব্রিজ হয়ে দ্বীপে যেতে হয়। অপরুপ সৈকতসমূহ দেখতে পেনাং না গেলে আর কোথায় যাবেন বলেন? এছাড়া ৩৮ জন হিন্দু দেব দেবীর মূর্তি নিয়ে মারিয়াম্মান মন্দির পর্যটক আকর্ষন করে। এর পাশেই কেলিং মসজিদ। মালেয়শিয়ার প্রথম দিককার মসজিদ গুলোর একটি। আর হ্যাঁ, মালয়েশিয়ার সিলিকন ভ্যালি হিসেবে পরিচিত পেনাং।
তামান নেগারা-
মালেয়শিয়া দেখা শেষ নয়। আরো থাকতে হবে মালেয়শিয়া দেখতে। সবুজ বাগিচায় ঢাকা পাহাড়ী এলাকা দেখতে তামান নেগারার আদিম অরণ্যে যাওয়া লাগবে। এখানে রয়েছে ঝরনা, জলপ্রপাত, জঙ্গলের মনোরম পরিবেশে ট্রেকিংয়ের সুব্যবস্থা। পশ্চিম মালয়েশিয়ার উত্তরাংশের তিনটি রাজ্য জুড়ে তামান নেগারা অবস্থিত যা বিশ্বের প্রাচীনতম রেইন ফরেস্ট। তামান নেগারা ইকো ট্যুরিজম ও দুঃসাহসিক গন্তব্য হিসেবে জনপ্রিয়। এই পার্কটি মালয়ান টাইগার, এশিয়ান হাতি ও সুমাত্রার গন্ডারের মত দুর্লভ প্রজাতির প্রাণী ও গাছপালায় পরিপূর্ণ। এই পার্কের আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে দীর্ঘ সাসপ্যানশন ব্রীজের উপর দিয়ে চাঁদের আলোয় হাঁটা। প্রায় গাছের উপর দিয়ে গেছে এই ব্রীজ যার ফলে পাখিদের আবাস দেখা যায় এখান থেকে। রাতের সাফারির ব্যবস্থা আছে এখানে। ফলে পেঁচা, চিতা বিড়াল ও ওয়াটার ড্রাগনের মত নিশাচর প্রাণী এবং শুধুমাত্র রাতে প্রস্ফুটিত হয় এমন উদ্ভিদ দেখারও সুযোগ আছে এখানে।
লঙ্কাউই -
একটি ইতিহাস, মাসুরীর ইতিহাস। সেটা গেলেই জানতে পারবেন, আমি নাইবা বললাম।
মালেয়শিয়া দেখবেন, লঙ্কাউই যাবেনা না সেটা মেনে নেয়া কষ্টের। যদি ২-৩ দিনের জন্যও মালেয়শিয়া যেতে চান; তাহলে লঙ্কাউই দ্বীপ যান। আলো জ্বলমলে কুয়ালালামপুর বা অন্য কোথা গিয়ে কি করবেন? আবার বলছি, সোজা যান লঙ্কাউই। এটি মালয়েশিয়ার উত্তর-পশ্চিম উপকূলে আন্দামান সাগরে অবস্থিত। ৯৯টি দ্বীপ নিয়ে লংকাউই দ্বীপপুঞ্জ গঠিত। এখানে আছে ছবির মত সুন্দর সৈকত, ম্যানগ্রোব ফরেস্ট ও পর্বতমালা। পর্যটকদের জন্য অনেক রিসোর্ট, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে যা বিশ্বের অন্যতম পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দ্বীপমালার ব্যতিক্রমি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য এখানে পর্যটকরা ভীড় করেন। ঈগল স্কোয়ার, কেবল কার, জিও ফরেস্ট পার্ক, তেলাগা তুজুহ ঝর্না, ওয়াটার ওয়ার্ল্ড, চেনাং রাতের বাজারতো আছেই।
বেশি লিখতে কার ভালো লাগে। আমারও লাগার কথা না। কিন্তু এরকম পর্যটন আর ইতিহাস সমৃদ্ধ দেশের কিছু কথা না লিখলে কি করে হয়? দেখার ইচ্ছে হলে আপনাকে জানতে তো হবেই। আর যারা দেখে এসেছেন তারা কি দেখে ফিরে এসেছেন তা জানা জরুরী।
বাংলাদেশ থেকে ভিসা নিয়ে যেতে হয় মালেয়শিয়ায়। ভিসা সমস্যা হয় না যদি ৬ মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট থাকে। এয়ারপোর্টে সমস্যা করবেনা যদি ভারত, নেপাল ভ্রমণ থাকে। না হলে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। আর সবকিছুর উর্ধ্বে হলো নিজের চলার ধরন। এয়ারপোর্ট থেকে কিছুটা দূরে কুয়ালালামপুর, কিন্তু আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে সেটা বুঝার উপায় নাই। টেক্সিতে গেলে খরচ বেশী। ট্রেনে বা বাসে যেতে পারেন।
থাকার জায়গার অভাব নেই, বুকিত বিনতাংয়ে থাকতে পারেন। টু স্টার/ থ্রী স্টার হোটেলের রুম ভাড়া অন্তত বাংলাদেশের বাজেট হোটেল থেকে কম। বাংলাদেশীদেরও দেখা পাবেন। খাবারের মান এবং দাম সবকিছুই ঠিক আছে।
পাসার মালামের রাতের বাজার, চায়না টাউনে যেতে পারেন বাজেট মার্কেটের জন্য।
মালেয়শিয়া যেতে বিমানভাড়া সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়। সময় বুঝে ইকোনমি ক্লাসের জন্য লাগবে ২১-২৫ হাজার।
সময় সুযোগ আর পকেট ঠিক থাকলে বিদেশ ভ্রমনে মালেয়শিয়া হোক গন্তব্য...