16/04/2024
মিয়ামিতে করে ঢাকা আসছিলাম। পাশের সিটে এক ভাই বসা। ভীষণ মন খারাপ করে বাইরে তাকিয়ে আছেন।
'ভাইয়ের মনে হয় মন-টন খারাপ?'
'না, না। তেমন না।'
ভদ্রলোকের সাথে আলাপ জমলাে৷ নাম আরিফ জামান।
ঢাকায় থাকেন, পারিবারিক এক ঝামেলায় এসেছেন গ্রামের বাড়িতে৷ জাহাঙ্গীরনগর থেকে পড়াশোনা শেষ করে প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকুরি করেন। উচ্চাকাঙক্ষা নেই, তাই বেতন যা পান, কোনােমতে চলে যায়। জীবন নিয়ে তেমন দু:খ বা আক্ষেপ নেই তার, একটু অভিমান আছে বটে।
বুঝলেন ভাই, চাকুরি করে সংসারই চালানো যায়, আয়- উন্নতি সম্ভব না। বাড়তি কিছু পাওয়ার ইচ্ছে জাগলেই মনকে বোঝাতে হয়, না না থাক,এটা না হলেও চলবে৷ আসলে কোত্থেকে আসবে টাকা? জামান ভাই মনে হয় গল্প করতে ভালোবাসেন। আমি তার গল্প শুনছি৷ তিনি বলছেন--
বছরে তিন থেকে চারবার গ্রামের বাড়ি যাই। সরকারি চাকরি করি, লোকে ভাবে না জানি কত টাকা- পয়সা আমার! পরিবারের লোকেরা, সমাজের লোকেরা, ছোটরা- বড়রা নানারকম আবদার নিয়ে আসে৷ গ্রামের ছেলেরা ক্লাব খুলে বসে আছে- মাস শেষ হতেই ফোন, ' একটু যদি আমাদের দিকে তাকাতেন!' এলাকার ছোট ভাইয়েরা দূরে কোথাও
পিকনিক করবে, তাদের কিছু খরচা- পাতি দিতে হবে। উপজেলা ছাত্রকল্যাণ সমিতি থেকে ইফতারের দাওয়াত দেয়, ইনবক্সে একটা বিকাশ নম্বরও দিয়ে দেয়৷ আবার পাড়ার মসজিদ কমিটি, ঈদগাহ কমিটি - সেখানেও তো কিছু না কিছু দিতে হবে!
এরপর মা- বাবা, ভাই- বোন, ভাগনে - ভাতিজারা আছে৷ বছরে দুটা ঈদ, আছে পহেলা বৈশাখ৷ এর- ওর নতুন জামা চাই, শপিং করা চাই । বোনের বাড়ির পানির মটরটা নষ্ট হয়ে গেছে, আরেকজনের ইটের দেয়ালে জঙ ধরেছে, রং মারতে হবে, তারও টাকা চাই৷ পাশের বাড়ির কুদ্দুস চাচা খুবই গরীব লোক। ভ্যান চালিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাতেন, সেটা নষ্ট হয়ে গেছে৷ হাজার টাকা লাগবে ঠিক করতে৷ কে দেবে টাকা? সেদিন ফোন করে ভীষণ কান্না- কাটি। বললাম, চিন্তা কইরেন না, পাঠাই দেবো। আমি কি ভাই টাকার মেশিন? কীভাবে জীবন চলবে? .... জামান সাবের গল্প শেষ হয় না৷
জামান ভাই এর প্রশ্ন, যা বেতন পাই তা দিয়ে কিছু হয় ভাই? সামনের বার মা- বাবা হজ্বে যেতে চান। বারবার চাপ দিচ্ছেন। সংসার চালিয়ে তো কিচ্ছু থাকে না। কতদিন চাকরি করলে এই বেতনে ১০- ১৫ লাখ টাকা জমানো সম্ভব?
-------------------------------
আহারে মানুষের সাথে যত বেশি মেলামেশা করি, ততই নিজেকে তুলনামূলক সুখী মনে হয়। যার সবচেয়ে ভালো থাকার কথা; অভাব, হতাশা আর দুশ্চিন্তা তার পিছু ছাড়ে না।
আগে আমাদের মুরুব্বিরা সততার গল্প শোনাতেন। ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়মে না জড়াতে কাছে ডেকে নিয়ে পরামর্শ দিতেন। এখন দুনিয়া পাল্টেছে, মুরুব্বিরাও পাল্টে গেছেন৷ রাস্তায়, বাজারে, চায়ের দোকানে এখন আর সততার গল্প হয় না। বরং প্রতিযোাগিতা চলে অর্থ- বিত্তে অন্যকে ছাড়িয়ে যাবার৷ ঘরের মুরুব্বি লােকটা জানে ৩৫ হাজার টাকা বেতনে সংসার চালিয়ে ৩৫ বছরেও একটা ছাদপাকা বিল্ডিং দেওয়া সম্ভব না৷ কিন্তু তার ছেলে আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন৷
এই বেতন নিয়েই চাকরির দুই বছরে ঢাকায় ফ্লাট,প্লট কিনে ফেলেছে৷ মুরুব্বি লােকটি তার ছেলেকে প্রশ্ন করে না, বাবা এই টাকা তুমি কোথায় পেলে? উল্টো ছেলের সামনে পাশের বাড়ির নজু মিয়ার উদাহরণ দেয়- দেখো, ওর পাঁচতলা বাড়ি, গত বছর দুই একর জমি কিনেছে, গাড়িও কিনেছে৷ আর তুমি? কী লাভ হলাে তোমাকে সরকারি অফিসার বানিয়ে?
© সোহেল রানা