18/12/2021
ঋণে জর্জরিত হয়ে পিতার ব্যবসা যখন বন্ধ হয়ে গেল, চোখের সামনে ছোট্ট মারুফ শুধু অন্ধকার দেখতে পেল। কর্মহীন বাবার সংসারে তার নিচে আরো দুই ভাই আছে, তারাও পড়ালেখা করে। এসএসসিতে মোটামুটি ভাল রেজাল্ট করা মারুফের ইচ্ছে ছিল ঢাকায় অথবা রংপুরে গিয়ে ভাল একটি কলেজে পড়বে~তা আর হলো না, বিপরীতে পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম এখন।
বেকার বাবা ও গৃহিনী মায়ের চোখের দৃষ্টিতে যে অসহায়ত্ব~তা বুঝতে পারলো ছোট্ট মারুফ। জীবনে প্রথম বারের মতো সে বুঝতে পারল, Life is not always beautiful। জীবনের সৌন্দর্যে সংগ্রামটা আবশ্যক সবার আগে। কিংবা কে জানে, যুদ্ধই জীবন কিনা!
শুরু হল ছোট্ট মারুফের সংগ্রামী নতুন জীবন।
পঞ্চগড়ের বিষ্ণুপ্রসাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী মাসুদুল আলম মারুফ ভর্তি হল পঞ্চগড় মকবুলার রহমান সরকারি কলেজে। তবে এবার বিজ্ঞান বিভাগ নয়, কলায় ভর্তি হল। বিজ্ঞানে ভর্তি হলে প্রাইভেট টিউশনির দরকার আছে, টিউশনির খরচ আসবে কোথা থেকে~এ ভাবনায় বিভাগ পরিবর্তন। উপরন্তু মারুফ যা করল তা হচ্ছে, পড়াশুনার যাবতীয় খরচ চালাতে নিজেই টিউশনি করানো শুরু করল। রামেরডাঙ্গা গ্রাম থেকে সাইকেল চালিয়ে মারুফ শহরে আসে, কলেজে যায়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করায়। দিনশেষে ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত মারুফ যখন বাড়ি ফিরে, বিছানা তাকে টানে চুম্বকের মতোন, চোখজুড়ে রাজ্যের ঘুম নেমে আসে।
ঠিক এ সময় মারুফের ভিতরে কেউ একজন হয়তো বলে, 'মারুফ, ঘুমাস নে, চোখে জল দিয়ে পড়তে বস....তোকে যে অনেক দূর যেতে হবে.....'
মারুফ সকল ক্লান্তি ঝেড়ে পড়তে বসে, পড়তে থাকে এবং পড়তে পড়তে টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়ে একসময়। পাশের ঘর থেকে মা এসে মাথায় হাত রাখে আলতো করে।
'চল, ভাত খেতে চল এখন....!
তন্দ্রা থেকে জেগে ওঠে মারুফ, চোখ কচলায়, মাকে জিজ্ঞেস করে~
'এখন ক'টা বাজে, মা?'
মাকে এমন বোকা বোকা প্রশ্ন করামাত্র নিজেই নিজের হাতঘড়ি দেখে নেয় সে। রাত তখন ১২টা। আর ঠিক তখনই মনে পড়ে যায় মারুফের~ যাতায়াতের জন্য তার একমাত্র বাহন পুরোনো বাই-সাইকেলটি আজকাল বড্ড ঝামেলা করছে, বারবার চেইন পড়ে যায়, কাল সকালেই সেটি সারাতে হবে।
এই বাই-সাইকেল তার জীবনে 'ম্যালা কিছু'~ কলেজে যাওয়া, কলেজের আগে ও পরে টিউশনিতে শিক্ষার্থীদের বাসায় যাওয়া এবং মাস শেষে অর্থপ্রাপ্তি।
বন্ধুরা যখন স্মার্ট ফোন, সেলফি, ফেইসবুকের দুনিয়ায় ব্যস্ত, ছোট্ট মারুফ তখন বেঁচে থাকার সংগ্রামে যুদ্ধ করছে। ভালভাবে বেঁচে থাকার সেই যুদ্ধে হাতিয়ার হচ্ছে~ বই, খাতা, কলম ও একটি দ্বি-চক্রযান।
মারুফ নিজে পড়ে এবং অন্যকে পড়ায়~ একই সাথে সে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক।
আমাদের এই মারুফের বয়স মাত্র ১৭!
মা প্রশ্ন করে, 'এতো পড়ে কী হবে, ব্যাটা?'
~'ভার্সিটিতে ভর্তি হবো, মা। পড়ালেখা করতে হবে, অনেক দূরে যেতে হবে, ছোটভাইদের পড়াতে হবে, বাবার ঋণ শোধ করতে হবে......'
ইত্যাদি ইত্যাদি।
স্বপ্নবিভোর সন্তানের কথা শুনে একজন মা মোরশেদা খাতুনের চোখে জল চিকচিক করে, লুকিয়ে চোখের জল মোছে।
[ বি.দ্র. কোন ধরণের কোচিং না করে, কলেজ জীবনের টিউশনির কিছু টাকা বাঁচিয়ে ভার্সিটির এডমিশন টেস্ট খরচ যোগানো পঞ্চগড়ের রামেরডাঙ্গা গ্রামের মাসুদুল আলম মারুফ, একজন শংসপ্তক, বাংলাদেশের একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। কিন্তু তার ইচ্ছে, সে ঢাবিতে পড়বে তাহলে সে টিউশনি করে অনায়াসে বাকি ছাত্রজীবন শেষ করতে পারবে। সমস্যা হচ্ছে, বিভিন্ন ভার্সিটির এডমিশন টেস্ট দিতে গিয়ে তার এতোদিনের স্বল্প পরিমাণ জমানো টাকা ফুরিয়ে গেছে। ঢাবিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এখানে ভর্তি হতে লাগে এগারো থেকে পনেরো হাজার টাকা। এখন এতো টাকা সে কোথায় পাবে? চোখে সে দ্বিতীয়বারের মতোন অন্ধকার দেখতে পেল, স্বপ্ন কি তাহলে পূরণ হবে না? উচ্চ শিক্ষা কি তাহলে তার মতো গরীব ও অসহায় শিক্ষার্থীদের জন্য নয়?
আসুন, এর পরের অংশটুকু আমরা মারুফের মুখ থেকে ওর ফেইসবুক পোস্টেরর মাধ্যমে জেনে নিই।
মারুফ ওর ফেইসবুক ওয়ালে লিখেছে~
"স্বপ্ন দেখি বড় কিছু হওয়ার ও করার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে যখন ভর্তির টাকা কোথায় পাবো এ চিন্তায় দিশেহারা ঠিক সেসময় এগিয়ে এলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় জেলা প্রশাসক, পঞ্চগড় জনাব মো: জহুরুল ইসলাম স্যার ও এডিসি রেভিনিউ দীপঙ্কর রায়। আমার স্বপ্ন এখন সত্যি হওয়ার পথে~জেলা প্রশাসক, পঞ্চগড় স্যার আমার পুরো ভর্তির টাকা প্রদান করেছেন।
আমি আপনার প্রতি অনেক অনেক কৃতজ্ঞ, স্যার। দোয়া করবেন যেন বড় হয়ে আপনাদের মতো মানুষের সেবক হতে পারি।"
আহা, আমাদের মারুফ!
এই সামান্য সহযোগিতায় কী কৃতজ্ঞাবোধ, পরাণের গহীন ভিতর থেকে আবেগ-মথিত কী চমৎকার উচ্চারণ!!
এই মারুফরা আমাদের ভবিষ্যত হোক। বিজয়ের মাসে প্রতিটি সংগ্রামী মুখ স্বপ্নজয়ের আনন্দে বিজয়ের অনিন্দ্য হাসি হাসুক।
বিজয় আসুক ঘরে ঘরে।
লিখন: দীপঙ্কর রায় (অথৈ আদিত্য)
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)
পঞ্চগড়