07/09/2021
ভারত ভ্রমণ, প্রথম পর্ব/ শাহেদ কায়েস
কন্যা কুমারীর দেশে ১
শুধুই ভারতবর্ষ না, ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণের দিকে একেবারে শেষ প্রান্ত কন্যা কুমারী। এর পরে আর স্থল নেই, অথৈ জলরাশি। কন্যা কুমারীর দক্ষিণে সাগর তীরে দাঁড়িয়ে নাক-বরাবর তাকালে ভারত মহাসাগর, পূর্বদিকে বাংলাদেশ ছুঁয়ে আসা বঙ্গোপসাগর আর পশ্চিমে আরব সাগর। নয়ের দশকের মাঝামাঝি যখন আমি দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজে (চেন্নাই) পড়তে গিয়েছিলাম, তখন একবার গিয়েছিলাম কন্যাকুমারী। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ভোরে বঙ্গোপসাগরে দেখেছিলাম সূর্যোদয়, আর সেই একই স্থানে দাঁড়িয়ে পশ্চিমের আরব সাগরে দেখেছিলাম সূর্যাস্ত।
কন্যাকুমারী পৃথিবীর একমাত্র স্থান যেখানে সাগর আর মহাসাগরের মিলন স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুই-ই দেখা যায়।
এখানে আছে বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল, যেখানে স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগোতে বিশ্ব-সভায় যোগ দেয়ার আগে সমগ্র ভারত ভ্রমণ করে কন্যা কুমারীতে এসে সাগরের মধ্যে অবস্থিত একটি বিশাল শিলা খণ্ডে বসে ধ্যান করেছিলেন। সেই থেকে এই শিলার নাম বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল।
কন্যাকুমারী নামটি এসেছে দেবী কন্যাকুমারীর (যাঁর স্থানীয় তামিল নাম কুমারী আম্মান) নামানুসারে। এখানে একটি মন্দির আছে, নাম কন্যাকুমারী। মন্দিরটি ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের কন্যাকুমারী জেলায় পড়েছে। ইংরেজিতে এই শহরকে Cape Comorin বা কুমারী অন্তরীপ বলা হয়। আমাদের বাংলাদেশে চিকিৎসার জন্য অধিক পরিচিত 'ভ্যালোর সিএমসি' এবং 'এপোলো হাসপাতাল' এই রাজ্যে অবস্থিত। এর রাজধানী মাদ্রাজ, এখন নাম পরিবর্তন হয়ে চেন্নাই।
আনুমানিক ৩০০০ বছরের কুমারী আম্মানকে পুজো করে আসছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের ভক্তরা। সমুদ্র সৈকতের কিনারায় পাথর দিয়ে তৈরি মন্দিরে দেবী কন্যাকুমারীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মন্দিরের মূল দরোজাটি উত্তর দিকে। এই দরোজাটি বিশেষ কয়েকটি দিন ছাড়া প্রতিদিনই খোলা থাকে। এই মন্দিরে পূজো দেওয়ার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সাধারণত, দক্ষিণ ভারতের সমস্ত মন্দিরেই প্রবেশ কালে পুরুষদের গায়ের জামা খুলতে হয়। তারপরেই মন্দিরের অন্দরমহলে প্রবেশ করা যায়। কন্যাকুমারীতেও একই নিয়ম। এখানে পূজা দেওয়ার আগে নারী-পুরুষ উভয়কেই মন্ত্র পড়ে সমুদ্রে স্নান করে, ভিজে কাপড়েই প্রবেশ করতে হয়।
এখানে একটি লোকবিশ্বাস আছে। হিন্দুধর্ম মতে দেবী কুমারী হলেন পার্বতীর আরেক রূপ, যাঁর রূপে মোহিত হয়ে মহাদেব তাঁকে বিয়ে করতে চান। বিয়ের দিনই দেখা পাওয়া যায় না শিবের। কুমারী দেবীর বিয়ের দিন যা যা রান্না করা হয়েছিল তা সব ফেলে দেওয়া হয়। ভক্তরা মনে করেন, সেই সব রান্না না করা চাল, শস্য ফেলে দেওয়ায় সমুদ্রতট তৈরি হয়েছে।
এই রাজ্যের ভাষা তামিল। ভারতের সমস্ত ভাষার উৎস হচ্ছে সংস্কৃত, ব্যতিক্রম শুধু তামিল ভাষা। তামিল হচ্ছে দ্রাবিড় ভাষা। ভারতের অন্যান্য অংশে আর্য সংস্কৃতির প্রভাব বেশি হলেও তামিলনাড়ুতে দ্রাবিড় সংস্কৃতির প্রভাব বেশি। পড়াশুনার সুবাদে আমি এই রাজ্যে ৫ বছর ছিলাম। বাংলা, ইংরেজির পরেই তামিল ভাষায় আমার দখল আছে। আমার এই সামান্য লেখাটি পড়ার জন্য আপনাদের রম্ভা নানরি।
* রম্ভা নানরি (তামিল ভাষা, বাংলা অর্থ অশেষ ধন্যবাদ)।
~
গলি-চাঁদনী-ওয়ালি
সে সময় আমার ফেরারী জীবন। সোনারগাঁয়ে “মায়াদ্বীপ রক্ষা আন্দোলন” করতে গিয়ে আমি তখন আমার বিরুদ্ধে প্রভাবশালী মহলের করা অনেকগুলো মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার শিকার। পরিস্থিতি যখন চরম পর্যায়ে, তখন কিছু সময়ের জন্য আমি দেশের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। ২০১৪’র ফেব্রুয়ারিতে দেশ ছেড়েছিলাম, হংকং-এ ‘এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনে’ এক বছরের একটা ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম নিয়ে। চীনের হংকং এক বছর কাটিয়ে নেপালের কাঠমান্ডুতে তিন সপ্তাহ থেকে ২০১৫ সালের ২২ মার্চ ভারতের দিল্লী এলাম একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে। এটা ছিল The World Movement for Democracy (WMD) আয়োজিত “International Conference on Strengthening Democracy in Asia” বিষয়ের উপর দুইদিনব্যাপী একটি বৈশ্বিক সভা। এই সম্মেলনের একটা সেশনে আমি প্যানালিস্ট ছিলাম। বাংলাদেশ থেকে আরও অনেকেই যোগ দিয়েছিলেন।
তেইশ গেলো, চব্বিশ গেলো— টানা দুই দিন কনফারেন্সের চিড়ে-চ্যাপ্টা সময়তালিকা। মার্চের পঁচিশে সবাই যার যার, তার তার। প্রায় সবাই ধরল ঘর-ফেরা উড়ন-পথ, আমি ধরলাম যাযাবর ধুলো-পথ। কথা ছিল কনফারেন্সের আয়োজকদের ললিত হোটেল ছেড়ে উঠবো লোধি রোডের ‘ইন্টিগ্রেটেড সোশ্যাল ইনিশিয়েটিভ'-এর গেস্ট হাউসে। গিয়ে দেখি সব রুম ফুল, আগে থেকে আমার রিজার্ভেশন ছিল না। সিদ্ধান্ত হলো আজ অন্য কোথাও কাটিয়ে কাল চলে আসবো এখানে। এই জায়গাটা অনেক ছিমছাম, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এখান থেকে 'দিল্লী লোক-কলা মঞ্চ' ৫ মিনিটের আর 'ইন্ডিয়া হেবিটেট সেন্টার' ১০ মিনিটের হাঁটা পথ। চার বছর আগে ২০১১ সালের নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত শিক্ষা বিষয়ক একটি বিশ্ব-সভা, '5th International Entertainment Education Conference (EE), 2011-তে যোগ দিতে এসেছিলাম দিল্লীতে। কনফারেন্স শেষে দিল্লী বেড়ানোর জন্য এই গেস্ট হাউসে ছিলাম সাত দিন। সেই থেকে দিল্লীর এই গেস্ট হাউসের প্রতি আমার দুর্বলতা ছিল।
ট্যাক্সি ধরে চলে এলাম পাহাড় গঞ্জের বসন্ত রোডের একটা গেস্ট হাউস ‘নর্দার্ন প্যালেস’-এ। লাগেজ রেখে বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে আমার ভালো লাগে, সুযোগ পেলেই হাঁটি… হেঁটে হেঁটে আমি কবিতা লিখি, হেঁটে হেঁটে নব-মুকুলিত নানান ভাবনা মাথায় আসে, কোনটা বা ডালপালা মেলে, কোনটা আবার বাতিল হয়, হেঁটে হেঁটে মানুষ দেখি, মানুষের মুখের দিকে তাকাই, অভিব্যক্তি লক্ষ্য করি।
নিউ দিল্লীর লোধি রোডের ওই অংশটা অনেক অভিজাত, কিন্তু পাহাড়গঞ্জের মেইন বাজারের এই অংশটা অনেকটাই এলেবেলে, আতরাফ-ঘরানার। এই যাচ্ছে যান্ত্রিক, তার পাশেই অযান্ত্রিক, সাই-সাই ছুটে যাচ্ছে বদ-মাজাজি হর্ন বাজিয়ে মটর-যান, তারপাশেই রিক্সার ক্রি-ক্রিং, হটো হটো… ময়লা, হইচই, কাপড়ের হকার, সান গ্লাসের হকার, হোটেল-গেস্ট হাউজের দালাল, হরেক ধরনের হ্যালো-পার্টি— ‘হ্যালো হ্যালো সানগ্লাস চাহিয়ে, চিপ রেট স্যার…’ ‘সস্তা মে হোটেল মিলেগি, চাহিয়ে চাহিয়ে…’ ‘রুটি-চাওয়াল খায়েঙ্গে? হ্যালো হ্যালো… ’ রাস্তায় সারাক্ষণ কিছু মানুষ এমনিভাবেই পর্যটকদের ডাকাডাকি করতে থাকে, এটাই ওদের জীবিকা। দুনিয়াতে কত ভাবেই না মানুষ বেঁচে থাকে!
দিল্লীর রাস্তায় পর্যটকের অভাব নাই— চাইনিজ, জাপানিজ, ফ্রেন্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইউরোপের অন্যান্য দেশের, মার্কিন মুল্লুকের… চারদিকে শত শত হোটেল, গেস্ট হাউজ, বার, খাবারের দোকান, রেস্তোরাঁ। হাঁটতে হাঁটতে গলি-চাঁদনী-ওয়ালিতে চোখ গেলো একটা গেস্ট হাউজে, নামটা দারুণ, 'প্রেম'!
কত শত বছর আগে এই গলিতে কেউ একজন চাঁদনীর বেসাতি করতো, সেই থেকে গলি-চাঁদনী-ওয়ালি… ‘নর্দার্ন প্যালেস’ ছেড়ে উঠে এলাম গলি-চাঁদনী-ওয়ালির ‘প্রেম ডিলাক্স গেস্ট হাউসে’, এর মধ্যে দুই-একজন পর্যটকের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো হাঁটতে-হাঁটতে, ফাস্ট ফুডের দোকানে খেতে খেতে। একদিনেই এখানে মন বসে গেলো, ভালো লাগছে এখানকার প্রাণ-চাঞ্চল্য, মানুষের সচল স্রোত, শ্রমের সৌন্দর্য। সিদ্ধান্ত নিলাম লোধি রোডের গেস্ট হাউজে যাব না এবার, দিল্লীতে যে কয়দিন আছি, এখানেই কাটিয়ে দেবো।
দিনের দিল্লীর এক রূপ, রাতের দিল্লীর আর… রাত যত গভীর হয়, বারগুলো জেগে ওঠে— গুরু বার, জেম বার, গোল্ড বার, চিয়ার্স বার… অভাব নাই, নেপালের কাঠমান্ডুর থামেলের কথা মনে পড়ে যায়। মধ্য রাতের বার-মিউজিকের সুরে ভাসতে থাকে তখন পাহাড়গঞ্জ, মেইন বাজার, গলি-চাঁদনী-ওয়ালি…
~
'এশিয়ান ইয়ুথ নেট-ওয়ার্ক’
দু’দিন বাদে কবি ও নবীন প্ল্যান্ট সায়েন্টিস্ট বন্ধু রমা ভারতী'র সঙ্গে আড্ডা হয় ইন্ডিয়া হেবিটেট সেন্টারে। এখানকার স্থাপত্য চোখে দেখার মতো, দারুণ প্রকৃতি ছোঁয়া পরিবেশ, এক্সপেরিমেন্টাল আর্ট গ্যালারিতে চলছিল শিল্পী সঞ্জয় দেওয়ানের মাল্টি মিডিয়া আর্ট-ওয়ার্কস 'ART VIVID'। সঞ্জয়ের আর্ট ওয়ার্কস দেখলাম, চমৎকার কাজ।
এরপরে নিজেদের কাজবাজ নিয়ে খুব ফলপ্রসূ আড্ডা হলো ঘণ্টা তিনেক— কখনো এম্পি-থিয়েটারের সবুজ লনে, কখনো ইউটোপিয়া ক্যাফেটেরিয়ায়... রমা দিল্লীর মেয়ে, তার একটি সংগঠন আছে বিহারের মধুবন জেলায়। ওরা কাজ করে মধুবনী আর্টিস্টদের নিয়ে। 'এশিয়ান ইয়ুথ নেট-ওয়ার্ক'-এর বিষয়ে কথা হলো।
সিদ্ধান্ত নিলাম 'এশিয়ান ইয়ুথ নেট-ওয়ার্ক' নিয়ে কাজে নামবো, তবে প্রাথমিক ভাবনার কিছু রদ-বদল হয়েছে। সিদ্ধান্ত হলো পাশ্চাত্যের কোন সংগঠন থেকে কোন সহযোগিতা নেব না। নিজেরাই গড়ে তুলবো নেটওয়ার্ক, এতে করে স্বাধীনভাবে কাজ করা যাবে।
রমার সঙ্গে কথা হলো দিল্লীর জীবন-যাপন, ভারতে নতুন কেন্দ্রীয় সরকার, দিল্লীর আম আদমি পার্টির রাজ্য সরকার, কবিতা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে।
(পরের পর্ব: আগামীকাল)
* কন্যাকুমারীর ছবিটা নেট থেকে নেওয়া।
এই লেখাগুলো সেই সময় বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকে লিখেছিলাম। লেখাগুলো একত্রিত করছি, কিছুটা পরিমার্জন করছি, সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিছু কিছু লেখা আবার পোস্ট দেবো, কোনো প্রকাশক আগ্রহী হলে আগামী বই মেলায় আমার ভারত-দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান ভ্রমণের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা বই প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে।— লেখক]
লেখক পরিচিতি:
শাহেদ কায়েস মূলত কবি। জন্ম ঢাকায়, ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭০। পৈতৃক নিবাস সোনারগাঁয়ের ললাটি গ্রামে, এখন বাস করেন খাসনগর দীঘিরপাড় গ্রামে। পড়াশুনা কম্পিউটার বিজ্ঞানে, দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই, এরপর দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে, চোন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ‘হিউম্যান রাইটস’ বিষয়ে মাস্টার্স। এখন পুরোপুরি সামাজিক প্রকৌশলী, কাজ করেন মানুষের অধিকার নিয়ে। কবিতায় হাতেখড়ি নব্বই দশকের শুরুতে। শখ ভ্রমণ, সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়ান দেশ-বিদেশ।
~
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ:
বাঁক ফেরার অভিজ্ঞতা (দোয়েল প্রকাশনী, ১৯৯৯)
চুড়ায় হারানো কণ্ঠ (মঙ্গলসন্ধ্যা, ২০০৩)
মায়াদ্বীপ (ঐতিহ্য, ২০১৫)
মঙ্গলসন্ধ্যা প্রেমের কবিতা (সম্পাদিত, ধ্রুবপদ, ২০১৭)
কৃষক ও কবির সেমিনার (অভিযান, একুশে বইমেলা, ২০২০)
শাহেদ কায়েস-এর নির্বাচিত কবিতা (ঐতিহ্য, একুশে বইমেলা, ২০২০)
অন্যান্য গ্রন্থ:
এশিয়ার বারটি দেশের মানবাধিকার বিষয়ে (মে এইটিন মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন, দক্ষিণ কোরিয়া, ২০১৫)
বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম স্মরণগ্রন্থ (ঐতিহ্য, একুশে বইমেলা, ২০২০)