13/06/2021
মেটিয়াবুরুজের নবাব......দ্য লাস্ট কিং ইন ইন্ডিয়া’
মেটিয়াবুরুজের ইতিহাস কলকাতা থেকেও প্রাচীন। ভাগীরথী নদীর দুই তীরে দুটি কেল্লা, একটি রাজা প্রতাপাদিত্য অন্যটি ডাচরা তৈরি করে। লর্ড ক্লাইভ এ অঞ্চল দখলের সময় কেল্লা দুটির দখল নেন। সেই সময় এ অঞ্চলে কেল্লা নির্মাণের প্রধান উপকরণ ছিল মাটি। কলকাতার পত্তনের সময় কেল্লা দুটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং পড়ে থাকে বিশাল মাটির ঢিবি বা বুরুজ। আসলে কথাটা ছিল মাটিয়া বুর্জ, অর্থাৎ মাটির কেল্লা। গঙ্গার বাঁকে এক কালে কাঁচা ইটের এই কেল্লা থেকেই পাহারা চলত।
সেই মাটিয়া বুর্জ থেকেই মেটিয়াবুরুজ নাম। শ্রীপান্থ সেই মেটিয়াবুরুজকেই আরও নরম করলেন তাঁর ‘মেটিয়াবুরুজের নবাব’ বইয়ে।
মেটিয়াবুরুজ দিয়ে এগোলে আজও জ্বলজ্বল করতে দেখা যায় তার ওস্তাগর সাম্রাজ্য। সম্ভবত ভারতের সর্ববৃহৎ দর্জিপাড়া।
নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ, অযোধ্যার শেষ বাদশা তিনি। ইংরেজদের কাছে রাজ্য খুইয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন কলকাতায়। তখনও আশা ছিল, হয়ত একদিন ফেরত পাওয়া যাবে সেই হারানো আওধ। লিখেছিলেন, ‘দর ও দিওয়ার পর হসরত সে নজর করতে হ্যায়/ খুশ রহো আহলে বতন হম তো সফর করতে হ্যায়।’
‘দরজা আর জানলার দিকে অকাতরে তাকিয়ে থাকি/ খুশি থাকো আমার দেশের লোক, আমি যে সফর করছি।’ সেই সফর শেষ হয়নি আর। এই শহরেই তাই সাধের লখনউয়ের ছোট সংস্করণ বানাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন ওয়াজিদ আলি শাহ। আর কী না বানিয়েছিলেন তাঁর সাধের মেটিয়াবুরুজে।
দিল ক্যা করে যব কিসিসে কিসিকো প্যার হো গ্যয়া - হয়ত এই রকমই কিছু মনে হয়েছিল ওয়াজিদ আলি শাহের। মা জানাব-ই-আলিয়ার জাহাজ ভেসে গেল গঙ্গার বুকে। লক্ষ্য দূর লন্ডন, সেখানে রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে সরাসরি এক রাজ্যচ্যুত সন্তানের মায়ের আবেদন জানাতে চললেন তিনি। সঙ্গে আরেক ছেলে সিকন্দর হাশমত। অথচ যার জন্য করা, সেই নবাবই রয়ে গেলেন কলকাতায়। সাল ১৮৫৬।
১৮৫৭ র সিপাহী বিদ্রোহ। ওয়াজিদ আলি শাহকে ইংরেজরা সাময়িক ভাবে বন্দী করে ফোর্ট উইলিয়ামে। জুন ১৮৫৭ থেকে জুলাই ১৮৫৯ অবধি তিনি নজরবন্দী থাকেন ফোর্ট উইলিয়ামের ভিতর, আরমহার্স্ট কুঠীতে। এদিকে লক্ষণৌতে ওয়াজিদ আলি শাহের এক বেগম হজরত মহল বিদ্রোহে যোগ দেন। এরপর আর বেগম জনাব-জানাব-ই-আলিয়ার আশা পুরণ হওয়ারও কোন সম্ভাবনা ছিল না - তাই দেশের পথে রওনা দিয়েছিলেন। পথেই মৃত্যু - প্যারিসের Père Lachaise তে সমাধি দেওয়া হয় তাকে। রাজ সম্মান জানাতে উপস্থিত ছিলেন তুর্কী আর পারস্যের সুলতানের প্রতিনিধি। দিনটা ২৪ শে জানুয়ারী, ১৯৫৮।
আসলে নবাবটি একটু অন্য ধাতের - যুদ্ধ বিগ্রহ রাজ্য শাসনের থেকে তাঁর মন বেশি গান- নাচ- কবিতা-প্রেম এই সবে। তিনি ছিলেন এক আদ্যন্ত শিল্পী। গায়ক, গজল লিখিয়ে, সুরকার, নাট্যকার, কত্থক নাচিয়ে, সাহিত্যিকও। চল্লিশটার ওপর বই লিখেছিলেন তিনি। রেখতা, শের, গজল, ঠুমরির পাশাপাশি লিখেছিলেন ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের ইতিহাস। আর তারই সঙ্গে নিজের আত্মজীবনী, পঞ্জিকা, নাটক। যদুভট্ট বা সৌরিন্দ্রমোহন ঠাকুরের মতো সঙ্গীতবেত্তারা ছিলেন তাঁর বন্ধু। পণ্ডিত বিরজু মহারাজের পূর্বপুরুষ পণ্ডিত দুর্গাপ্রসাদ ও ঠাকুরপ্রসাদের কাছে কত্থক নাচের তালিম নিয়েছিলেন তিনিই।
নজরবন্দী থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে নবাবের ঠিকানা হল মেটিয়াবুরুজের পরীখানায় - বেগম, তওয়ায়েফদের সৌন্দর্যে সত্যিই সেখানে পরী নেমে আসত যেন। নবাব রইলেন তার পশু, পাখি, কবিতা, নাচ, গান আর হারেম সুন্দরীদের নিয়ে। বছরে বার লক্ষ টাকা পেন্সন। তারই মধ্যে সংসার চালান ৩৮৪ জন বেগম নিয়ে। লখনউ নগরীর আদলে গড়ে তুললেন ইমামবাড়া, মসজিদ, চিড়িয়াখানা। এই চিড়িয়াখানার থেকেই নাকি একবার এক বাঘ পালিয়ে গঙ্গা পেরিয়ে ওপারের শিবপুরের বোট্যানিকাল গার্ডেনে গিয়ে হানা দেয়!
ইতিহাসের বেশিটাই আর নেই, হারিয়ে গিয়েছে কালের গর্ভে। কারণ ১৮৮৭ সালে নবাবের মৃত্যুর পরে ইংরেজরা নবাবের সব সম্পত্তি দখল করে নিয়েছিল।
তাঁর উদ্যোগেই মেটিয়াবুরুজ হয়ে উঠেছিল এক অসামান্য নগরী। একদম পরিকল্পনামাফিক তৈরি করা হয়েছিল রাস্তা। সেই রাস্তা রাতের বেলা সেজে উঠত নিজস্ব গ্যাসের আলোয়। ছিল নিজস্ব বাজার, দুর্গ, মিনার।
আলিপুর চিড়িয়াখানার অনেক আগে, সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে এই শহরের প্রথম চিড়িয়াখানাও তৈরি করেছিলেন তিনিই। বাঘ, সরীসৃপ, অসংখ্য পাখি – কী না ছিল সেখানে। শোনা যায়, এশিয়াটিক সোসাইটির কুইরেটর ব্লিথের মাধ্যমে সেই চিড়িয়াখানার জন্তুজানোয়ারের খোঁজ নিতেন নাকি খোদ চালর্স ডারউইন।
এই মেটিয়াবুরুজেই বই ছাপানোর জন্য নিজস্ব ছাপাখানারও নির্মাণ করিয়েছিলেন তিনি। শিক্ষার প্রসারে তৈরি করেছিলেন ‘মাদ্রাসা সুলতান এ আওধ’। সেখানে শুধু ইসলামের শিক্ষাই দেওয়া হত না মোটেও। বরং শেখানো হত প্রতীচ্যের বিজ্ঞান। ঘোড়সওয়ারি আর শরীর তৈরির কসরতের সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হত ক্যালিগ্রাফির তালিম।
বাদশা নিজে ছিলেন শিয়া মুসলমান। ধর্ম ভীরুও। কিন্তু সেই ধর্ম কারও ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। বরং তিনি মনে করতেন ধর্মের আসল শিক্ষা হল মূল্যবোধ।
তাঁর এই ঐতিহ্য মুছে দিতে উদ্যোগ নিয়েছিল ইংরেজরা। এই দেশে তাঁদের শাসনযন্ত্র কায়েম করার জন্য ভীষণ জরুরী ছিল সেটা।
তারপর ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছে মেটিয়াবুরুজের সেই গৌরব। আজকের মেটিয়াবুরুজ শুধুই এই শহরের কোণে পড়ে থাকা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের থাকার জায়গা। গরিব দর্জিদের কাজের জায়গা। খিদিরপুর ডকের ঠিক পাশে হওয়ায় অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবেই কুখ্যাত। এই শহরের অন্য অংশের বাসিন্দারাও সেই অঞ্চলে যাওয়ার কোনও কারণ খুঁজে পান না।
আর বাদশা ওয়াজিদ আলি শাহ? তাঁকে মনে রেখেছে এই শহর শুধু আওয়াধি বিরিয়ানি আর তার অসংখ্য বেগমের জন্য।অথচ এই মেটিয়াবুরুজের ভেতরের ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ওয়াজিদ আলি শাহর নির্মিত অসংখ্য ইতিহাস।
নবাবি আমলের কোনো স্থাপত্য বা তার অবশেষ কোনো কিছুই রাস্তার দুই ধারে চোখে পড়বে না, যদিও মেটিয়াবুরুজকে বলা হতো দ্বিতীয় লখনউ । দূর থেকে ইমামবাড়ার বিশাল ফটক নজরে পড়ে। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ইরান থেকে শিল্পী আনিয়ে এই ইমামবাড়া নির্মাণ করেন নবাব। বিশাল ফটক পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই প্রথমেই খোলা চত্বর। তারপর খোলা বারান্দা পেরিয়ে ইমামবাড়ার মূল ভবন।বারান্দা পেরিয়ে মূল প্রার্থনাকক্ষে প্রবেশ করলে বাঁ দিকে গ্রিলঘেরা একটি অংশে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ চিরনিদ্রায় শায়িত। মেঝেতে কালো পাথরে তাঁর কবরের জায়গাটি চিহ্নিত, তার পাশেই একটি চেয়ার, যা সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন। এ ছাড়া নবাবের বসার স্থান এবং নবাবি প্রতীক একপাশে রাখা। ভেতরে কিছু ছোট তাজিয়া। বাইরে দেয়ালে শ্বেত পাথরে খোদাই করে নবাবদের বংশতালিকা টাঙানো। প্রতিবছর ২৪ সেপ্টেম্বর নবাবের মৃত্যু দিবসে অনুষ্ঠান হয়, তখন নবাবের বংশধররা আসেন। ইমামবাড়ার তত্ত্বাবধানও তারাই করেন। আয়রন গেটের কাছেই নবাবের ব্যক্তিগত প্রার্থনাগৃহ।
এর পরের যে গন্তব্য সেটি নবাবের এক স্ত্রীর বানান এক ইমামবাড়া। নাম বেগম মসজিদ। ভিতরের দেওয়ালটি অসাধারণ সুন্দর - কাঁচের উপর রং দিয়ে মার্বেলের উপর ইনলে কাজের এফেক্ট আনা হয়েছে। সব জায়গাতেই বড় বড় ঝাড়-লণ্ঠন ঝোলানো। আমাদের আধুনিক ইন্টিরিয়রের চোখে এতটুকু জায়গায় এত বড় ঝাড়লণ্ঠন একটু বেমানান লাগে বটে। কিন্তু হয়তো সেই প্রাক ইলেক্টিরিসিটি যুগে সেটাই দস্তুর ছিল।
১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা নবাবদের ক্ষমতাচ্যুত করে ১২ লাখ টাকা পেনশন মঞ্জুর করে। প্রথমে নবাব তা গ্রহণ করেননি। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ-পরবর্তী সময় রাজ্য ফিরে পাওয়ার আশা নাই দেখে বাধ্য হয়ে পেনশন গ্রহণ করেন। ব্রিটিশরা ওয়াজেদ আলীকে কলকাতায় নির্বাসিত করে। সুরম্য মঞ্জিল, আসাদ মঞ্জিল ও সুলতানখানা—এই তিনটি ভবন নবাবকে প্রদান করে ব্রিটিশরা। তিনি লখনউয়ের অনুকরণে আরো ২০টি মঞ্জিল নির্মাণ করেন। সব মঞ্জিল মিলে একটি প্রবেশদ্বার, যার ওপর ছিল নহবতখানা, যেখানে সারা দিন সানাই বাজত। কোথায় সেই মঞ্জিল, কোথায় সেই সানাই। এখনো রয়েছে নবাবের ব্যক্তিগত প্রার্থনাগৃহ। নবাব এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। প্রার্থনাগৃহের চারপাশের জায়গাগুলো দখল হয়ে গেছে। সরু রাস্তা পেরিয়ে মূল প্রার্থনাগৃহ। বর্তমানে একে স্থানীয় লোকজন কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করে। মূল প্রার্থনাগৃহের অর্ধেক ধসে পড়েছে। একসময় নবাব এখানে বাঘ পুষতেন। নবাবের জীবজন্তু পোষার শখ ছিল, তিনি দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে বিভিন্ন প্রাণী সংগ্রহ করেছিলেন। এখনকার বিখ্যাত কলকাতা চিড়িয়াখানার অনুপ্রেরণা তিনি।
নবাবি স্থাপনা খুঁজে না পেলেও এখানে রয়েছেল
লখনউয়ের ধাঁচের পানের দোকান, ঘুড়ির দোকান , আতরের দোকান। নবাব ঘুড়ি ওড়াতে পছন্দ করতেন। এখনো মেটিয়াবুরুজে প্রচুর ঘুড়ির কারখানা রয়েছে। কলকাতায় যে বিরিয়ানি প্রসিদ্ধ, তা নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের অবদান। নবাবের মৃত্যুর পর তাঁর বংশধররা সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা করে সব বিক্রি করে দেন। ব্রিটিশরা নবাবকে জমি, ভবন ফিরিয়ে দেন। নবাবের প্রাসাদগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, যার কিছু অবশিষ্ট আছে, তা এখন সরকারি দপ্তর হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে কলকাতার সংস্কৃতির সর্বত্র নবাবের অবদান থাকলেও ব্যক্তি নবাব কলকাতার কোথাও নেই।
নবাবের জীবনীকার রোজি লেওয়েলিন-জোন্স বলছেন, সে-মেটিয়াবুরুজ যেন শহরের মধ্যে গ্রামের এক সুন্দর নিদর্শন!কিংবা আরও তলিয়ে বুঝলে, আধুনিক বঙ্গের মধ্যে এক প্রাচীন ভারত।
১৮৭৪ সালের শরতে আমেরিকার বিখ্যাত একটি দৈনিকপত্রের এক প্রতিবেদন বলছে যে, কিছু আইনি ব্যাপার ছাড়া ব্রিটিশদের কোনও মাথা গলানো চলে না অবধের প্রাক্তন নবাবের গড়ে তোলা এই নকল রাজত্বে।
সে-রাজত্ব ছোট। কিন্তু আঁটোসাঁটো। ছ’হাজার প্রজা নিয়ে দিব্যি চলত রাজ্যপাট। মাসিক এক লক্ষ টাকার পেনশনে নবাবের খাইখরচার শেষ নেই। ফলে ধারকর্জও বেলাগাম। তাই ধার মেটানো, ভাতা বাড়ানো নিয়ে সাহেবদের সঙ্গে আকচা আকচিও অবধারিত।লখনউ ছেড়ে আসার সময় তাঁর অসংখ্য বেগমের একটা বড় অংশ নবাবের সঙ্গে কলকাতা পাড়ি দেন। পরেও চলে আসেন অনেকে (জীবনের শেষ অবধি ওঁর স্ত্রীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৩৭৫!)।সঙ্গী আমির-ওমরাহ, পাইক-বরকন্দাজ, খিদমদগার, গাইয়ে-বাজিয়ে-নর্তকীদের সংখ্যাও তাজ্জব করা।
কিন্তু এই ছোট্ট রাজত্বকে এক আরব্যরজনীর আবেশে বেঁধেছিল নবাবের নিজস্ব চিড়িয়াখানা।
সেই চিড়িয়াখানার পিছনেই ওয়াজিদ আলি শাহের মাস গেলে খরচ ন’হাজার টাকা। কারণ হাজার হাজার পাখপাখালি ছাড়াও (শুধু পায়রাই ২৪ হাজার) সেখানে পোষা হত তেইশটি বাঘ, সিংহ ও চিতা!
এর মধ্যে একটি বাঘ ও একটি বাঘিনী ফেরার হয়। তারা নদী পেরনোর তালে ছিল। বাঘটিকে গুলি করে মারা গেলেও বাঘিনী কিন্তু আধ মাইলটাক চওড়া গঙ্গা পেরিয়ে শিবপুরের বোটানিকাল গার্ডেনে হামলা করে!
মেটিয়াবুরুজ আজও কেমন জানি ইতিহাসের দু-দুটো সময়ে যাতায়াত করে। হয়তো’বা দু’দুটো সভ্যতাতেও। কারণ যা স্থানীয়দের মেটিয়াবুরুজ, তাই আবার সাহেবদের কাছে গার্ডেনরিচ।
সব দোকানের সামনেই সুবেশ ছেলেছোকরা। বড়দের জটলা। নবাববাড়ির সড়কের বাঁক থেকেও অনেক সাইনবোর্ডেই এখনও টিকে আছে গার্ডেনরিচ নামটা। যদিও এক দশক হল রাস্তার নাম বদলে হয়েছে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ সরণি।
নবাব যখন এসে উঠেছিলেন গার্ডেনরিচে তখন এই পল্লি সাহেবদের ছড়ানো বিছানো বাংলোয় বাংলোয় ‘প্রাসাদনগরী’ কলকাতার সঙ্গে টেক্কা দেয়। এখানে আসার সামান্য আগে, ১৮৫৫-য় কলকাতার চিফ জাস্টিসের পদ থেকে অবসর নিয়ে ইংল্যান্ড ফিরে গিয়েছিলেন স্যার লরেন্স পিল। তখনও তিনি গার্ডেনরিচে বসবাসের সুখে এতই বিভোর যে আইল অব ওয়াইট-এ তাঁর মনোরম বাড়িটির নামকরণ করেছিলেন ‘গার্ডেনরিচ’।
গঙ্গার দক্ষিণ কূলের দু’মাইল লম্বা পাড়া ধরে বেড়ে ওঠা সেকালের গার্ডেনরিচের শোভাই আলাদা। দুই বা তিন তলার বাংলোগুলোর পুরোভাগ হত ধনুকের মতো বাঁকানো।১৭৭০ সাল নাগাদ বাগানবাড়িগুলোর পত্তন শুরু। এর এক দশক পর জলপথে শহরে এসে শিল্পী উইলিয়াম হজেস এক সুন্দর বর্ণনা রেখেছেন গার্ডেনরিচের।—
‘‘জাহাজ যখন কলকাতা ছুঁচ্ছে নদীটা সরু হয়ে আসে। যাকে বলা হচ্ছে গার্ডেনরিচ, সেখান থেকে ধরা দেয় বাগানঘেরা সব সুদৃশ্য ইমারত। এ সব হল কলকাতার বড়লোক বাসিন্দাদের বিনোদভবন।’’
এই ‘ভিলাগুলো’র মেজাজ ও গড়ন কলকাতার চৌরঙ্গির বড়সড় বিল্ডিংগুলোর থেকে কিছু কম যেত না।
১৮৫৬-র ৪ ফেব্রুয়ারি জেমস উট্রামের হাতে তাঁর মাথার তাজ তুলে দিয়ে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ আত্মীয়স্বজন সমেত লখনউ ছেড়ে কলকাতার পথে জাহাজ নিলেন।১৩ মে পৌঁছলেন শহরে। ৩ জুন তারিখে এলেন গার্ডেনরিচে।
তখ্ত গেছে, রাজ্য থেকেও সরে এসেছেন। তবুও একুশটি তোপধ্বনিতে তাঁর কলকাতা আগমনকে সম্ভাষণ জানানো হয়েছিল।তবে এই ‘গান স্যালুট’ ছিল তাঁর জীবনের শেষ গান স্যালুট; এর পর আর কখনও তাঁকে অভিবাদন জানানো হয়সে-সময়কার ভারতশাসক আর্ল মেয়োকে এক বার নবাব প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, তাঁকে যেন সেই একুশটি গান স্যালুট থেকে বঞ্চিত করা না হয়। সে অনুরোধ কখনও রাখা হয়নি।
নবাবের ‘রানিমহল’। যার কোনও শোভা বলতে কিছু নেই আজ। শুধু তার একটা ভাড়া পান স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটি। আরেকটা হোঁচট খেতেই হয়— তল্লাট জুড়ে জিনিসপত্রের দর হাঁকাহাকিতে। অথচ নবাব কিন্তু এখানেই প্রায় বানিয়ে ফেলেছিলেন তার দ্বিতীয় লখনউ! আসল লখনউ ছাড়ার শোক কখনওই মুছতে পারেননি, তবু!
লখনউ ছেড়ে তড়িঘড়ি যখন কলকাতা এসেছিলেন নবাব, তাঁকে তোলা হয়েছিল ইতিপূর্বে উল্লেখিত চিফ জাস্টিস স্যার লরেন্স পিল-এর ছেড়ে যাওয়া বাংলোয়।সে যেন এক ছোটখাট মেটকাফ হল। নবাবের পছন্দ না হয়ে উপায় ছিল না। বড় কথা, গঙ্গাপাড়ের বাড়ির নিজস্ব একটা ঘাটও ছিল।
নবাব চাইলে তাঁর নতুন বাড়ির উত্তরের বারান্দায় বসে লখনউয়ের গোমতী নদীর চেয়ে বড় গঙ্গা-দর্শন করতে পারতেন। যা ছিল স্যার লরেন্স পিল-এর ১১নং বাংলো (সাহেবদের বাংলোর কোনও নাম থাকত না, শুধু একটা করে নম্বর), তারই নতুন নামকরণ হল সুলতানখানা, বা রাজবাড়ি।
মেটিয়াবুরুজে ঘোরাঘুরি করলে চট করে সুলতানখানা এখন চোখে পড়ার নয়। তবে সাবেকি চেহারা এখনও ধরা আছে। অবশ্য তা বহিরঙ্গের, এটা এখনও বেশ সাহেবসুবো দর্শন। শুধু সুলতানখানা নয়, তার পাশের দুটো জমি ও বাড়ি নবাব কিনে নিয়েছিলেন সাকুল্যে তিন লাখ টাকায়। ইউরোপীয় স্টাইলের বাংলোকে গড়ে নিয়েছিলেন ভারতীয় স্টাইলে। পাশে নিজের নমাজের জন্য মসজিদ।
এই তিন জমি ও বাড়িতে ঠেসেঠুসে ভরে দিয়েছিলেন তাঁর বউ-ছেলেমেয়ে, অসংখ্য সভাসদ ও কাজের লোকদের। এর মধ্যে ছিল ৫০ জন আফ্রিকার দাস, ২৪৫ জন ‘বিশেষ রক্ষী’, ১২০ সশস্ত্র রক্ষী, ২০ জন দণ্ডবাহী, ১৮ জন খোজা। এ ছাড়াও ছিল কসাই, কামার, কুমোর, রসুইকর, জমাদার, ধোপা, নাপিত, ঘণ্টাপিটাই।
নবাবের প্রধানা স্ত্রী বা খাস মহলেরও একটা ছোট দরবার ছিল। সেখানে দর্জি, ধোপানি, ধাই। চাকরানি, হুকাবরদার, পঙ্খাওয়ালি, পানওয়ালি ছাড়াও ছিল গল্প শোনানোর মেয়েরা। অন্য রানিদের বন্দোবস্ত কিছু কম যায় না। তাতেও অজস্র রানিতে খেয়োখেয়ি, ঝগড়াঝাঁটি, লাগানো-ভাঙানো, মন্দ সম্পর্কের শেষ ছিল না।
একটা সময় এল যখন চার দেওয়ালের মধ্যে হাঁসফাঁস-করা অনেক বেগমই লখনউ ফিরে যাবার উদ্যোগ করেন। অনেকে আবার পরে ফিরেও আসেন, রাজ্যচ্যূত নবাবের যে কিছু কম আকর্ষণ ছিল না বেগমের কাছে। ১৮৫৯-এর শরতে প্রথম মেটিয়াবুরুজ ছাড়েন ছোটি বেগম।
আর ওই ১৮৫৯-এর ১৬ নভেম্বর ফোর্ট উইলিয়ামের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার আহ্লাদে একই দিনে তিনটে নতুন বিয়েও করেন নবাব।
মেটিয়াবুরুজে একত্রিশ বছরে কম বিয়ে করেননি তিনি। আর এই নতুন বেগমদের অনেককেই আনা হয়েছে ওঁর প্রিয় লখনউ থেকে।
আজ মেটিয়াবুরুজের নবাবপাড়ায় হাঁটলে জেমস ফ্রেজার-এর আঁকা খিদিরপুরের রাস্তার দৃশ্যের সঙ্গে মেলানো কঠিন হয়ে পড়ে। এক সেই শাহি ইমামবাড়া ছাড়া যুগের ছবি ধরে রাখার মতো কিছু পাওয়া ভার।সেই প্রাসাদকেও হেরিটেজ বিল্ডিং ঘোষণা করেও সরকারি টাকার জোগান থমকে আছে।
ম্যানেজার আখতার মির্জা বললেন, ‘‘যে এক লাখ টাকার মতো ভাড়া ওঠে তাই দিয়ে সামলেসুমলে চলছি। মেরামতিতেই বিশ-ত্রিশ হাজার লেগে যাচ্ছে। গোটা ইমামবাড়া করতে কয়েক কোটি। কোত্থেকে আসবে?’’
ইমামবাড়ার লাগোয়া একটা অংশে জেনানা-মহল ছিল। সে-অংশও এখন ভাড়ায় আছে ।ইমামবাড়ার গেটও এখন হকারদের দখলে। তাদের বলে কয়েই প্রায় ভেতরে ঢুকতে হয়। কিন্তু একবার ভেতরে ঢুকলে অবিচল প্রশান্তি। একেবারে অন্য এক সময়।
সেখানে নবাবের মসনদ, কোট অফ আর্মজ, তরোয়াল, সংগ্রহের পিকদানি, বাতিদানি, ঝাড়বাতি, পা-দানি, সাইডটেবল, বৃদ্ধবয়েসের ছবি, পুত্র বির্জিস কাদেরের কবর, মৌলবীদের তখ্ত হারানো দিনের দরবারি কানাড়ার মূর্ছনা ধরে রেখেছে।
নবাবের বৃদ্ধ বয়েসের একটি ছবিও সেখানে টাঙানো। গোঁফ, দাড়ি সব বেবাক সাদা। চাউনির মধ্যে কিন্তু একটা সাঙ্ঘাতিক রাজকীয় ভাব। শরীরটা বহরে প্রায় তেমনই আছে। কিন্তু কলকাতা নির্বাসনের ৩০টা বছরের ক্ষয়ক্ষতি মুখের ওপর ধরা।
মেটিয়াবুরুজের ইমামবাড়ায় তাঁর শতেক বেগমের মধ্যে কেবল একজনেরই প্রতিকৃতি শোভা পায়। ম্যানেজারের ঘরের দেওয়ালে। বেগম হজরত মহল।তাঁর প্রধান তিন বেগমের একজন। যিনি নবাব কলকাতা এলে তার সঙ্গী হননি, কারণ তত দিনে নবাব ওঁকে তালাক দিয়েছেন। নবাবকে সরিয়ে ব্রিটিশরা মহাবিদ্রোহ সামাল দিতে ব্যস্ত হতেই প্রস্তাব আসে নবাবের তখতে— নতুন কাউকে বসানোর। তাতে বেগম হজরত মহল তাঁর গর্ভজাত নবাবের বারো বছরের পুত্র বির্জিস কাদেরকে বসিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার তোড়জোড় শুরু করেন।
১৮৫৮-র ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ বাহিনী লখনউয়ের ওপর চড়াও হলে দু’সপ্তাহ ধরে মরণপণ যুদ্ধ চলে লখনউয়ের বুকে।শেষে শহরটা ইংরেজদের ফের কব্জায় আসতে হজরত মহল, বালক পুত্রকে সঙ্গে করে কাঠমাণ্ডু পালিয়ে যান। এবং সেখানেই বাকি জীবন কাটে।এই সেদিন নেপালের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে কাঠমাণ্ডুর অজস্র স্থাপত্যের সঙ্গে হজরত মহলের সমাধিটিও ধূলিসাৎ হয়।
পুত্র বির্জিস এক সময় চলে আসেন মেটিয়াবুরুজে এবং এখানেই প্রয়াত হয়ে পিতার সঙ্গে কবরস্থ আছেন এক ছাদের তলায়। অর্থাৎ গার্ডেনরিচের সিবতৈনাবাদ ইমামবাড়ায়।
ইমামবাড়ার প্রধান হল-এর বাঁ হাতের কাচ আর লোহার শিকে ঘেরা ঘরটায় কবরস্থ আছেন শেষ নবাব। যাঁকে তাঁর বইয়ে রোজি লেওয়েলিন জোন্স বলেছেন ‘দ্য লাস্ট কিং ইন ইন্ডিয়া’। হঠাৎ এক প্রদেশের শেষ নবাবকে ‘ভারতের শেষ রাজা’ বলা কেন? লেখিকার উত্তর, ‘‘মনে হল বইয়ের নামকরণে ওই বর্ণনাটাই বেশি মানায়।’’ আসলে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের সঙ্গে এই ‘শেষ’ কথাটা অদ্ভুত মসৃণতায় জুড়ে গেছে।
মাত্র ন’বছরের নবাবী সাঙ্গ করে রাজ্য ছাড়া হয়ে যিনি তাঁর অমরগীতি রচনা করলেন ‘যব ছোড় চলি লখনউ নগরী’, লখনউ হারিয়ে তিনিই আবার নতুন করে লখনউ গড়লেন গঙ্গার পাড়ে। ফোর্ট উইলিয়ামে দু’ বছরের কারাবাসে এক মসনবি বা দীর্ঘ কবিতায় নিজের পতন ও বেদনার বৃত্তান্ত লিখলেন। সে-রচনার নাম রাখলেন ‘হুজ্ন-ই-আখতার’ বা ‘আখতারের দুঃখ’। ভারতের শেষ বাদশাহ বাহাদুর শাহ দিল্লি থেকে বিতাড়িত হয়ে জাহাজে করে বর্মার রেঙ্গুনে আশ্রয় নিতে যাবার পথে তরী থামালেন গার্ডেনরিচে। সে-শুধু সুলতানখানার বারান্দায় দাঁড়ানো নবাবকে দূর থেকে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাবেন বলে।— এই ওয়াজিদ আলি শাহকে ‘শেষ রাজা’ বলে ডাকাটাই যেন তাঁর প্রতি সমীহের একটি ইতিহাস হয়ে আছে!
প্রেমচন্দের দুই দাবাড়ুর গল্পকে অবলম্বন করে এই শেষ রাজাকেই সেলাম জানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ ছবিতে।🆑