28/08/2022
রবি ঠাকুরের খেলার পুতুল।
****************
প্রায় দুটি বছর পর শান্তি নিকেতনের উত্তরায়ন গৃহ, রবীন্দ্র মিউজিয়াম সব উন্মুক্ত হয়েছে সর্ব সাধারণের জন্য। অপেক্ষায় ছিলাম এই শুভ ক্ষণের জন্য, তাই এই শুভ সংবাদে আবার চলে এসেছি শান্তিনিকেতন। তাঁর মৃত্যু দিবস, ২২শে শ্রাবণ উপস্থিত ছিলাম শান্তিনিকেতনে। কবির শেষ জীবনের সাথী রাণী মহালনবীশ তাঁর "২২ শে শ্রাবণ" গ্রন্থে লিখেছেন, বৃদ্ধ অশক্ত কবির একান্ত ইচ্ছে ছিল যে তাঁর মৃত্যুর পর শেষকৃত্য যেন এই শান্তিনিকেতনের মাটিতে সম্পন্ন করা হয়। তাঁর এই আশা যাতে মেটে সেটা যাদের দেখার কথা ছিল, ঐ ইন্দ্র পতনের পর তাঁরা সকলেই ছিলেন নিতান্তই অসহায়, সেই ইচ্ছাকে বাস্তব রুপ দিতে। তবে তাঁর এই একান্ত ইচ্ছেকে রুপ দিতে কোনো পরিকল্পনা আগে থেকে করা হয়েছিলো কীনা, সে ব্যাপারে রবীন্দ্র গবেষকরা একেবারে নীরব থেকেছেন। শান্তিনিকেতনে কবির গুন মুগ্ধরা সেদিন নিঃশব্দে চোখের জল ফেলেছিলেন । শোকের প্রকাশ হোক নিঃশব্দে এটাই তো তিনি সারাজীবন ধরে মেনে এসেছেন। কাল হরণ করে নিয়েছে সেই শোক। আজ আর সেই শোক দুঃখের কোনো রেশ নেই শান্তিনিকেতনের মাটিতে। কবির সাথে সাথে সেদিনের আশ্রমবাসিরাও আজ ইতিহাসের পাতায় । তাঁর তিরোধান দিবস আজ এক উৎসব সারা দেশ জুড়ে, শান্তিনিকেতনেও। আমি এমনি দিনে এখানে এসেছি সেই উৎসবের শরিক হতে। হোম স্টেতে দুপুরের খাবার খেয়েই সটান মিউজিয়াম। টিকিট দেখিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছি কত যুগ পর। এই দীর্ঘ সময়ে মনের চাওয়া পাওয়ারা কতো পাল্টে গেছে । মনের মাঝে উথাল পাথাল,মন ভাবতে বসে সেই ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮( ৭ আগস্ট ১৯৪১ ) সাল, কি পরিস্থিতি ছিল এই উত্তরায়ন গৃহের। সেই রাতে কে আলো জ্বেলেছিল এই গৃহে? এর আগে ২৫শে জুলাই ১৯৪১ সাল অসুস্থ কবি, ছেলে রথীন্দ্রনাথ, কন্যা মীরা ও নাতনী নন্দিতার সাথে শেষবারের মত আশ্রম ছেড়ে চলেগেছেন জোড়াসাকোর বাড়িতে। তাঁর শেষের দিনে অসুস্থ বাবামশাইকে আগলে রাখা কন্যা সমা পুত্র বধূ প্রতিমা দেবীকে থেকে যেতে হয়েছিল এই উদয়ন গৃহে। তিনি ঐ সময়ে ধুম জরে আক্রান্ত হয়ে শান্তি নিকেতন ছেড়ে যাবার অবস্থায় ছিলেন না। শেষের সময় আসন্ন জেনে ১৯-২০ শ্রাবণ তাকে ও কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল। তাঁর শেষের দিনে কোথায় ছিল সেই আদুরে পুপে।১৯৩৯ সালে পুপের প্রথম বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল এই উদয়ন গৃহে।তাঁর সেই মহা প্রয়ানের দিনে আমার মনে সেই গৃহের কথা যে গৃহ পরিসর এই মহামানবকে দীর্ঘ কালের জন্য ধারণ করেছিল। আজ ক্ষুন্ন বিত্তির কর্ম জীবন অবসানের পর আমার কাছে উন্মোচিত নতুন এক আনন্দ ঘন কর্ম জীবন। সেই কর্ম জীবনে আজ আমার কাজ রবি ঠাকুরকে জানা পরম আনন্দের । তাঁর ছেলে বেলার কিছু কিছু কথা জেনেছিলাম আমার ছেলেবেলার পাঠ্যপুস্তকে।বাকি জীবন নিয়ে যেটুকু জানা সে যেন কিছু না জানারই সমান। আজ মনের মাঝে প্রবল আগ্রহ তাঁকে জানার। আজ এই জানার আগ্রহের মাঝেই আমি খুজে ফিরি ভালো ভাবে বেঁচে থাকার রসদ। কিছু দিন আগে এক ছোট্ট মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম কেকের উপর নাম লেখা রয়েছে, পুপে। মনের মাঝে তুফান, নাম টুকু ছাড়া কিছুই তো জানা নেই রবি ঠাকুরের বৃদ্ধ বয়সের কত খুশির উৎস সেই পুতুলের মতো নাতনীটির সমন্ধে । মনে হয় আমার মতো যে বাপের ঘরে কন্যে পুতুলেরা আছে, সেই বাপেদের মনে নাড়া দিয়ে যাবে এই পুপে নাম খানি। উত্তরায়নের প্রবেশ দ্বার দিয়ে আমি এগিয়ে যেতে চাই সেই গৃহ প্রাঙ্গনের দিকে। সিকিউরিটি গার্ড বলে আগে মিউজিয়াম দেখে আসুন। তবে তাই হোক, আমি এগিয়ে যাই মিউজিয়ামের দিকে। দ্বিতল বাড়ির একতলার বা দিকের শেষ প্রান্তে নন্দিনী পুপের ছবি, নীচে বেশ কিছু তথ্য। খাতা হাতে আমি দাঁড়িয়ে গেছি সেই ছবির সামনে। বিশ্ব ভারতীর দেওয়া তথ্য আমার হাতের খাতায়। মিউজিয়াম দেখার পর আমি চলে এসেছি উদয়ন গৃহের সামনে। শান্তিনিকেতনে কবির শেষের সময় কেটেছে এই গৃহে। আমি যে ছোট্ট পুতুল মেয়েকে খুজতে এখানে এসেছি তার সন্ধান তো আমি এই উদয়ন গৃহ, গৃহ প্রাঙ্গণেই পাব। কিন্তু আমাকে পিছিয়ে যেতে হবে সেই ১৯২২ সালের শান্তিনিকেতন আশ্রমে।
১৯২২ সালে এক রবীন্দ্র অনুরাগী গুজরাট দম্পতি শান্তিনিকেতনে এসেছেন সেখানে বসবাস করতে। ব্যাক্তিটির নাম চতুভূর্জ দামোদর,তার স্ত্রীর নামটি অজানা । এটিও অজানা কেন তারা শান্তনিকেতনে এসেছিলেন। ঐ দম্পতির সাথে এসেছিল ফুটফুটে ফুলের মতো এক কন্যা। মাটি খুবই অসুস্থ, তিনি টিবি রোগে আক্রান্ত। ছোট্ট মেয়েটির দেখাশোনার ভার অনেকটাই আশ্রমের মহিলারা নিয়ে নেন। তখন কার আশ্রম তো আশ্রম বাসিদের নিজের ঘর বাড়ির মতো। এই বাচ্চাটির খবর কবি পুত্র বধু প্রতিমা দেবির কানে পৌঁছাতে দেরি হয় না। নিঃসন্তান প্রতিমা দেবির উপরই সমস্ত ভার তাঁর বাবামশাইকে দেখার সাথে সাথে শান্তিনিকেতন আশ্রমকে। তিনি পৌঁছে যান ঐ ছোট্ট শিশুটির গৃহে। দম্পতির কাছে প্রস্তাব দিলেন আমি ছোট্ট মেয়েটিকে নিজের সন্তানের মতো করে মানুষ করতে চাই। সানন্দে সম্মতি দেন ঐ দম্পতি। তারপর বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে সটান বাবা মশাইয়ের কাছে তাঁর অনুমতির জন্য। আমি উদয়ন গৃহ প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আপ্লুত মনে সেদিনের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখছি। বাবা মশাইয়ের অনুমতি পেতে বিলম্ব হয় না।
সেই ছোট্ট শিশুর আগমনে যেন প্রাণের জোয়ারে ভাসে উদয়ন গৃহ। ঘরে নতুন প্রাণ, তার নাম করন করতে হবে না? । নাম করনের ভার নিলেন শিশু কন্যার দাদা মশাই, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ। সেই শ্রী কৃষ্ণের শতনামের মতো কতো নামের বাহার। পোষাকি নাম রাখা হলো নন্দিনী। আর আদুরে ডাকনাম, পুপে, পুষু, রুপসী, লালা---। তারপরে যখন যা খুশি নামে ডাকা যেমনটা সাধারণ পিতা তার লাডলি কে ডেকে থাকেন। পুপের সম্বন্ধে জানতে যেয়ে কিছু বই পত্তর আমি ঘাটাঘাটি করেছি। কিন্তু পুপের সম্বন্ধে যেটুকু জানতে পারি সবই দাদা মশাইয়ের সাথে পুপের নৈকট্য বোঝাতে। এক বাবা মায়ের সন্তান মানুষের মধ্যে তাদের কথা বিশেষভাবে বলবার কীই বা থাকতে পারে যখন সেই শিশুর বেড়ে ওঠা এক বিশেষ মানুষের ছত্র ছায়ায়। রথীন্দ্র আর প্রতিমার সাথে কন্যে পুপের সম্পর্ক নিয়েও গবেষকরা সম্পূর্ণ নীরব। এই যে পুপে নামটি সেটা কিন্তু ফরসী নাম। এই নামকরণও করেন এক বিশিষ্ট ফরাসি শিল্পী আঁন্দ্রে কার্পেলেস। ফরাসি ভাষায় পুপে শব্দের অর্থ পুতুল। এই পুপে নামটিই বহুল প্রচলিত।
ঘরে ছোট্ট নাতনী আসাতে শোকগ্রস্ত কবির আনন্দের আর সীমা থাকে না। ছোট পুতুল কে নিয়ে লেখা কবিতা, ছড়া গানে কবির স্নেহ ফুটে বেরোয়।
ছোট্ট নাতনীকে নিয়ে বিশ্ব কবির মানসিকতা যেন এক চিরন্তন দাদা মশাইয়ের।
১৯২৩ সাল কবি সপরিবারে গেছেন বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির কনভোকেশনে গেছেন। সেখান থেকে ফেরার পথে মোগলসরাই স্টেশনে এক ফেরিওয়ালার কাছে যত খেলনা ছিল সব পুপের জন্য কিনে নিয়েছিলেন। আশ্রম নিয়ে নানান চিন্তা কিন্তু পুপে আসার ফলে উদয়ন গৃহ যেন শান্তিনিকেতনের মধ্যে এক অন্য শান্তি নিকেতন।
পুপেকে নিয়ে কবি কতখানি তৃপ্ত সেটা বুঝতে তুলে ধরছি ১৯২৪ সালে সপরিবারে প্যরিস
ভ্রমণের সময় কবির নিজের হাতে লেখা, " একটা ছোট্ট মেয়ে কোথা থেকে এসে আমার যাত্রা পথে জুটে গেছে---আমার মন বলে একটা মস্ত পাওনা আমি পেলুম'।
আমার মনে হয় আমিও সেই ছোট্ট পুপে সম্বন্ধে অনেক কিছু তথ্য জড়ো করেছি। সেই খুশিতে আজ এই টুকুই। বাকিটা পরে একদিন। প্রণাম জানাই কবিকে, কবির পরিবারকে, তবে পুপেকে নয়, ও যেন আমারও কন্যা |
তরুন মিত্র
****' '' '' '' ''
২৮/৮/২২