28/10/2023
-॥শুশুনিয়া পাহাড়॥-
প্রাগৈতিহাসিক যুগের অস্ত্রাগার।
শুশুনিয়া পাহাড় যার গাত্র মূলতঃ সাদা দানাদার কোয়ার্জাইট নামক বেলেপাথরে তৈরি। তার আশে পাশের অঞ্চলকে শুশুনিয়া পরিমণ্ডল বলা হয়। এই অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান শুরু হয় ১৯৬৫ সালে তৎকালীন প্রত্নতত্ব বিভাগের অধিকর্তা পরেশচন্দ্র দাশগুপ্তের নেতৃত্বে এখানে প্রথম আবিষ্কৃত হয় প্রস্তর যুগের একটি হাত কুঠার যেটি ছিল কোয়ার্টাজাইট পাথর নির্মিত। পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ উত্তাপ ও চাপের কারণে বেলে পাথর কোয়ার্টাজাইট পাথরে পরিণত হয়।
এই রকম প্রচুর প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাথর নির্মিত অস্ত্র শস্ত্র শুশুনিয়া অঞ্চলের এই পাহাড়কে কেন্দ্র করে খনন কার্যের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে। এই সকল পাথরের নির্মিত অস্ত্র শস্ত্র গুলি ছিল লক্ষ লক্ষ বৎসরের পুরনো প্লিস্টোসিন যুগের।
প্লিস্টোসিন যুগটি কি? এটি ছিল প্রায় চব্বিশ লক্ষ বছর আগের এক ভূতাত্ত্বিক, আবহাওয়া নির্ভর যুগ। বিবর্তন মতবাদ অনুসারে প্লায়োসিন-প্লিস্টোসিন যুগ থেকেই মানব জাতির উদ্ভব হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল এই ধরনের প্রস্তর নির্মিত অস্ত্র শস্ত্র কোন জন গোষ্ঠী এই রকম ব্যাপক হারে শুশুনিয়া অঞ্চলে তৈরি করত।
ধারনা করা হয় এই জনগোষ্ঠী ছিল ইউরোপের প্রস্তর যুগের হোমোসেপিয়ান্স গোষ্ঠীর সমতুল্য। এখানকার আদি মানবদের জীবন যাত্রা ছিল এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার প্লিস্টোসিন অথবা কোয়াটেরনারি যুগের ন্যায়। কোয়াটেরনারী যুগটি শুরু হয় আজ থেকে প্রায় ছাব্বিশ লক্ষ বছর আগে।
শুশুনিয়া পাহাড়কে কেন্দ্র করে বাঁক নিয়ে আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে দ্বারকেশ্বর এর উপনদী গন্ধশ্বরী প্রবাহিত। এই গন্ধশ্বরী নদী ও শুশুনিয়া পাহাড়কে কেন্দ্র করেই, প্লিস্টোসিন যুগের প্রায় দুই হাজার এইরকম প্রস্তর নির্মিত আয়ূধ (অস্ত্র) পাওয়া গেছে। এই অস্ত্র গুলিকে ঠুকে ঠুকে ক্রমান্বয়ে সূক্ষ্ম ফলাবিশিষ্ট হাতিয়ারে পরিণত করা হত। কতগুলিকে তার একপ্রান্তে গাছের ডাল বেঁধে কুঠারে পরিণত করা হত আর কতগুলো ছিল ডিমের ন্যায় আকৃতি বিশিষ্ট পাথর তার এক প্রান্ত হত বেশ ধারালে, এটি সাধারণত বন্যজন্তুর ছাল ও মাংস কাটতেই বেশী ব্যবহৃত হত।
শুধু তাই নয় এখানে ব্যবহৃত কুঠারগুলির ফলা গুলির আকৃতি তাদের কার্য অনুসারে বিভিন্ন রকমের হত। কোনটি ছিল ত্রিকোণাকৃতি দীর্ঘ ফলা। এগুলির দৈর্ঘ্য হত মোটামুটি একুশ সেন্টিমিটারের মতো। কোনটি ছিল বৃত্তাকার মসৃণ আবার কোনটি ছিল চতুষ্কোণ। শেষোক্ত গুলি ছিল অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট। যথাক্রমে চার সেমিঃ ও তিন দশমিক আট সেমিঃ।
আর খনন কার্যের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রচুর পরিমাণে পাষাণচক্র।(Stone Wheel)। সারাবিশ্বের কোথায় এত বেশি পরিমাণে পাষাণচক্র বা "Stone Wheel" আবিষ্কৃত হয় নি। মনে করা হয় এই পাষাণ চক্রগুলি কৃষিকার্যে ব্যবহার করা হত। কৃষিকার্যে যে দণ্ড ব্যবহার করা হত তার ওজন বৃদ্ধিতে এ গুলি কাজে লাগানো হত ফলে জমি খোঁড়ার সুবিধে হত।
প্রত্নতত্ববিদদের মত অনুযায়ী শুশুনিয়া অঞ্চল থেকে প্রাগৈতিহাসিক যুগে বাণিজ্যিক ভাবে অস্ত্র উৎপাদন হত এবং সেইসব অস্ত্র বিনিময় প্রথার মাধ্যমে দূরবর্তী অঞ্চলে বিক্রয় করা হত। যেভাবে এখন আমেরিকা রাশিয়া অস্ত্র বিক্রয় করে থাকে।
শুধু তাই নয় এই শুশুনিয়া পরিমণ্ডলে শুশুনিয়া পাহাড়কে কেন্দ্র করে এশীয় সিংহ, জিরাফ ও হায়নার ফসিল পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে। একসময় এই অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক হাতি পেলাকোলক্সোডিয়ন নেমিডিকাস বিচরণ করে বেড়াত। এই হাতিদের গজদন্ত ছিল একদম সোজা এবং এদের আকৃতি ছিল বিশাল। প্রাগৈতিহাসিক হাতি পেলাকোলক্সোডিয়ন নেমিডিকাসের চোয়ালের প্রস্তরিভূত অংশ পাওয়া গেছে শুশুনিয়া পরিমণ্ডলে অবস্হিত বাবলাডাঙা গ্রামে। যার কার্বন ডেটিং পরীক্ষা করে দেখা গেছে এটি চল্লিশ হাজার বছরের চেয়ে ও বেশি পুরাতন।
বঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীনতম শিলালিপিটি এই শুশুনিয়া পাহাড়েই এক মনরোম পরিবেশে অবস্থিত। সামান্য ট্রেকিং করলেই সেখানে পৌঁছে যাওয়া যায়। সেখান থেকে চারপাশের দৃশ্য অপূর্ব। শিলালিপিটি খ্রীষ্টিয় চতুর্থ শতাব্দীতে উৎকীর্ণ অর্থাৎ আজ থেকে ১৬০০ বছর আগে। শিলালিপিটিতে মহারাজা শ্রী চন্দ্রবর্মার নাম উল্লেখ আছে। এখানে পাহাড়ের উপর আছে তিনটি প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহা মারাংঢেরী গুহা, ভালুক গুহা আর ভরতপুর গুহা। এখানেই পাহাড়ের ঢালে হয় পর্বতারোহণের ট্রেনিং। এই ট্রেনিং নিয়ে অনেকেই হিমালয়ের দুরুহ সব শৃঙ্গ জয় করে এসেছে।
আর আছে ঝরণা। আদি ও অনন্ত কাল ধরে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। সেই জল পেটের রোগের ওষুধি হিসাবে বোতলবন্দি ক্যান বন্দী হয়ে চলে আসে। ভোলা বাবা পার করেগা, গাঁজেল বাবা পার করেগা-শিবভক্তের দল শ্রাবণ মাসে ঝাঁকে ঝাঁকে দল বেঁধে ভীড় করে আসে এই জল নেওয়ার জন্য, বাঁকে করে সেই জল ঘটবন্দী হয়ে চলে যায় বহুলাড়া, এক্তেশ্বর। ত্রিকালযোগী মহেশ্বরের মাথায় ঢালার জন্য। আর আছে বিখ্যাত বারুণী মেলা। তিন চারদিন ধরে চলে। পাশাপাশি গ্রামের ঘরে ঘরে তখন কুটুমে কুটুমে থিক থিক। মেয়েদের সাথে মায়েদের জমানো অন্তরঙ্গ কথা বৌমার আড়ালে। হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। মেলাতে ঘুরে ঘুরে দাদুর হাত ধরে নাতির আবদার। গরম গরম জিলিপি আর প্রসাধনী দ্রব্য। আদরের শালীর আবদারে জামাইবাবুর পকেটে টান কিন্তু মুখে হাসি।
কিভাবে আসবেনঃ-
হাওড়া থেকে রাতের ট্রেনে-হাওড়া চক্রধরপুর ট্রেন ধরে চারটের সময় ছাতনাতে নেমে পড়ুন ওখান থেকে ট্রেকার বাস সব পাবেন। মাত্র দশ কিমিঃ শুশুনিয়া। নাইট সার্ভিস বাসেও ছাতনা আসতে পারেন। ভোরে নেমে শুশুনিয়া ট্রেকারে। ফেরার ট্রেন রূপসী বাংলা বিকাল পাঁচটাতে। কিংবা রাতের ট্রেন চক্রধরপুর হাওড়া
তথ্যসূত্রঃ- বাঁকুড়া বিচিত্রা।
প্রশান্ত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
সংগৃহীত
#শুশুনিয়াপাহাড়