18/02/2024
#ভবঘুরে মন
02-12-2023
নেতারহাট, ছোটনাগপুর মালভূমির রানি।
"ইয়ে লাইফ বহুত ছটি হ্যায় দোস্ত, so go on and break the rules, forgive quickly....,kiss slowly....,love truly...., laugh uncontrollable....,and never regret anything.. that made you smile..." এটা কথা থেকে উধৃত বলুন তো?একটু চেষ্টা তো করে দেখুন!..এই কথা গুলো যখন মনে হয়, তখন হৃদয়ে এক অন্য অনুভূতির জন্ম হয়।আজও যখন সাইকেল চালিয়ে আমার প্রাইমারি স্কুলের সামনে দিয়ে যায় তখন চোখে পড়ে,সস্তার লজন্সে লাল হয়ে যাওয়া ছোট্ট ছোট্ট জিভ।।।বা কারেন্ট নুন,বা ভাস্কর লবণ খেয়ে কালো ছোপ ধরা দাঁত।।।কিন্তু তার ফাঁকে উজ্জ্বল এক হাঁসি।।তখন নিজের দিকে তাকাই।।।একটু ভয় ধরে যায় তখন ।।যেনো রামগরুড়ের ছানা মনে হয় নিজেকে।আর মনে হয় এই তো কদিন আগেই এই মাঠ দাপিয়ে খেলতাম আমরা,এখন সেখানেই আমাদের ছেলেমেয়েদের দেখি ।সময় আর জীবন যেনো চোখের পাতা ফেলতে না ফেলতেতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।তাই জীবনের স্বাদ টা কে চেটে পুটে উপভোগ করবো বলে,আবার বেরিয়ে পড়বো বলে ঠিক করলাম।।গন্তব্য পালামৌ, বেতলা,নেতার হাট,বা ছোট নাগরপুর মালভূমি,এই সমস্ত জায়গা সম্পর্কে আমরা অনেক ছোটবেলা থেকেই শুনেছি,পড়েছি,আর যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছি।।পালামৌ এর নাম জেনেছিলাম প্রথম সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে, বেতলা কে জেনেছি "আরণ্যের দিন রাত্রি "থেকে। নেতারহাট কে জেনেছি বিভিন্ন বিখ্যাত ভ্রমণ কাহিনী থেকে।কিন্ত জেনেছি মাত্র,,পাওয়া হয়ে উঠে নি।।তাই এগুলি কে একেবারেই নিজের করে পাওয়ার আসায় আবার সবাই মিলে বেরিয়ে পড়লাম।।তবে বাইক রাইডিং এর প্ল্যানিং আজকের নয়,তিন মাস আগের।বিগত তিন মাস ধরে চলেছে আলোচনা, আর টুর প্ল্যানিং।কারণ এইবারের রাস্তা অনেক বেশি, এবং দুর্গম।বাড়ি থেকে রাঁচি হয়ে লোহারধাগা হয়ে লোধ জলপ্রপাত, এবং ওখান থেকে নেতারহাট,ওখানে কিছু দ্রষ্টব্য জিনিস দেখে হোটেল এ চেক ইন করবো।রাস্তা প্রায় ৬২০ কিলোমিটার।এটা আমদেরকে অতিক্রম করতে হবে প্রথম দিনে ,দ্বিতীয় দিনে যাব নেতার হাট থেকে পালামৌ এর জঙ্গল অতিক্রম করে যাবো বেতলা,ওখানে জঙ্গল সাফারি এবং অন্যতম কিছু দ্রষ্টব্য দেখে বিকেলের মধ্যে ফিরে আসবো নেতারহাটে, কয়েল ভিউ পয়েন্ট, পাইন গাছের জঙ্গল,দেখে যাবো মেগনলিয়া সানসেট পয়েন্ট এ।ওখানে সূর্যাস্ত দেখে হোটেল এ ফিরবো।রাস্তা প্রায় ৩০০ কিলোিটারের।এর পর তৃতীয় দিন অর্থাৎ শেষ দিন বাড়ি ফিরবো এবং রাস্তায় যে সমস্ত দ্রষ্টব্য জিনিস পড়ে দেখবো,,এবং রাঁচি তে এই দিনের সবচেয়ে উত্তজনা পূর্ণ জিনিস হবে সবার হৃদয়ের হিরো মাহি ,বা এমএসডি এর বাড়ি যাওয়া,আর যদি একবার সচক্ষে দেখা যায় ক্রিকেট এর ভগবান কে তাহলে তো আর কথায় নেই...., রাস্তা প্রায় ৬০০ কিলোিটারের।
অবশেষে দিনটি চলে এলো,,,২রা ডিসেম্বর,,সবাই তাড়াতাড়ি খেয়ে শুতে গেলাম।।বুকের মাঝে ধুকপুকানি,কি জানি কাল কি হবে।রাস্তার কথা কিছু বলা যায় না।।।যদি কুয়াশা হয় তাহলে তো টাইম ঘেঁটে ঘ হয়ে যাবে,আর রিস্ক ফ্যাক্টর ও বেড়ে যাবে।রাত্রি ২ টো তে বিশ্বজিৎ এর ফোন।।।,,"উঠে পড় রেডী হ,,দেরি করে লাভ নেই"।তার পর পুস্পেন্দু দার কল।।"কি রে রেডী তো"।আমি বললাম হুম।মাল পত্তর আগের দিন সন্ধ্যায় বাইক এ বাঁধা হয়ে রেডী ছিল।সুতরাং জ্যাকেট, রাইডিং গিয়ার, পরে বেরিয়ে গেলাম। দেওড়া তে সবাই মিট করবে ।এই বারের সফর সঙ্গী হচ্ছে আমি অনুপম,চন্দন,বিশ্বজিৎ,আর আমাদের প্রিয় দাদা পুস্পেন দা। পুষ্পেন্দু দা এই নিয়ে দ্বিতীয় বার আমাদের সাথী।সবাই যথা সময়ে দেওড়া চলে এলাম।বড় বাবার মন্দিরে পুজো দিয়ে ভোর ৩.০০ টে তে যাত্রা শুরু করলাম সবাই।এই বার কিন্তু বিধি বাম হলো না, বরং সাথ দিল।খুব ঠাণ্ডা পেলাম না। আর কুয়াশা ও পেলাম না।একেবারে বাইক চালানোর জন্য আদর্শ পরিবেশ।সবাই ভাবলাম এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী খড়গপুর এর চৌমাথা পেরিয়ে চা খাওয়ায় জন্য দাঁড়ানোর কথা।কিন্তু এখানে একটা সমস্যা হলো।দেখি ভোর রাতে প্রচুর ট্রাক এর লাইন।কিন্তু কারণ বুঝতে পারলাম না। আগত্যা বাইক ফুটপাত দিয়ে নিয়ে যেতে থাকলাম কোনো মতে।।সামনে গিয়ে দেখি বীভৎস দুর্ঘটনা হয়েছে দুটো ট্রাক এর মধ্যে।পুলিশ পুরো রাস্তা ঘিরে দিয়েছে। রাস্তায় ভর্তি হয়ে আছে ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো।তার উপর দিয়ে কোনো রকমে বাইক পার করিয়ে ফাঁকা রাস্তায় পড়লাম।যেহেতু ট্রাক বা অন্য গাড়ি পাস করতে পারছে না তাই সামনের রাস্তা পুরো ফাঁকা।তাই স্টপ না নিয়ে বেশ কিছু টা এগিয়ে যাবো ঠিক করলাম।স্টপ নিলাম লোধাসুলী,ঘাটসিলা পেরিয়া।চা দোকানে দাঁড়িয়ে গরম গরম চা,বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া ডিমসেদ্ধ, বিস্কুট,আর খাজুর দিয়ে টিফিন সারলাম।রাস্তা যেহেতু অনেক তাই বেশি স্টপ নেওয়া যাবে না। অপূর্ব দলমা পাহাড় এর উপত্যকা পেরিয়ে দ্বিতীয় স্টপ নিলাম টাটা নগর এ তখন সকলের আলো ফুটছে সবে।ঠাণ্ডা এইদিকের চেয়ে একটু বেশি। দোকানে লোকজন এর ভিড় নেই।একটু চা,কেক, আর ডিমসেদ্ধ দিয়ে টিফিন করলাম।একটু হাঁটা চলা করে কোমর টা একটু সড়গড় করে নেওয়া হলো। তারপর আবার পুর দমে যাত্রা শুরু।কারণ এখনো রাঁচি পৌঁছতে ১৫০ কিলোমিটার বাকি।সবাই প্রায় ননস্টপ গাড়ি চালিয়ে যখন রাঁচি পৌঁছলাম তখন প্রায় সকাল ১০ টা বাজে। শরীর অবসন্ন,ক্লান্ত।কিন্তু মনে আনন্দ পরিপূর্ণ কারণ আমরা প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার অতিক্রম করেছি সকল ১১ টার মধ্যে।বাকি আছে এর ১৫০ কিলোমিটার এর মত,রাঁচি রিং রোড ধোরে কিছু টা এগিয়ে আমরা বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে এক পাঞ্জাবি ধাবা তে দাড়ালাম।ধাবাতে দাঁড়ানোর একটাই কারণ আমরা প্রায় সারারাত ঘুমাই নি,,তার উপর একটানা বাইক চালানোর কষ্ট। সবারই শরীর আর বইছিল না,,আর ধাবার সুবিধা হলো ওখানে খাটিয়া থাকে,একটু কোমর সোজা করে গড়িয়ে নেওয়া যায়।আর দ্বিতীয় সুবিধা হলো গরম গরম সদ্য প্রস্তুত খাবার।তবে সরদার জির ধাবার খাবার,পরিষেবা , আতিথেয়তা আমাদের সারা জীবন মানে থাকবে।তন্দুরি রুটি, বটার দিয়ে তৈরি তরকা, চীজ গার্নিশ করা মিক্স ভেজ,এর বাড়ি থেকে আমার স্ত্রীর দেওয়া মিষ্টি দই।সবাই খুব পরিতৃপ্ত ভাবে খেলাম।কিন্তু বাঙালী তো একমুঠো ভাতের জন্য প্রাণ আঁকুপাঁকু করে,কিন্তু ভাত খাওয়া যাবে না কোনো মতে,আবার খুব পেট ভোরেও খাবার খাওয়া যাবে না,,,পাছে ক্লান্তি, আর শ্রান্তি তে চোখ লেগে যায়,,,অত্যন্ত সচেতন, আর সাবধানতার সঙ্গে এবং একত্রিত ভাবে ড্রাইভ করতে হবে সবাই কে।ধাবা তে আধা ঘণ্টা বিশ্রাম করে সবাই একটু রিফ্রেশ হয়ে যাত্রা শুরু করলাম লোহারধাগা এর পথে।ওখান থেকে যাবো লোধ্ জলপ্রপাত,লোহারধাগা অতিক্রম করার পর আশেপাশের দৃশ্যপট এর বিপুল পরিবর্তন শুরু হলো।চারিদিকে ছোট বড় পাহারের সারি,ছোট ছোট আদিবাসীদের জনপদ,রাস্তার দুই ধারে সারিবদ্ধ শাল, সেগুন,মহুয়া গাছ।সে এক অপূর্ব মনোরম দৃশ্য।লোধে পৌঁছলাম বিকাল ৩.০০ টে নাগাদ।অপূর্ব তার মন মাতানো রূপ।বহু উপর থেকে পৃথিবীর বুকে ধেয়ে আসছে সাদা ফেনিল জলধারা।এটাই ঝাড়খণ্ডের সর্বোচ্চ জলপ্রপাত।কিন্তু বেশি সময় দিতে পারলাম না।ওখান থেকে নেতার হাট এর দূরত্ব প্রায় ৬০ কিমি।এবং শেষ ২৮ কিমি পুরোটাই পাহাড়ি পথ,আর আমরা কোনো ভাবেই চাই না ওই দুর্গম পথ সূর্যাস্তের পর পাড়ি দিতে।সুতরাং সবাই বেরোলাম নেতার হাট এর উদ্দেশে।কিছু টা যাওয়ার পার অনুভব করলাম।যেনো রাস্তাটা পুরোপুরি দার্জিলিং বা সিকিম এর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।সেই একই পাহাড় কেটে সর্পিল রাস্তা।রাস্তার ধারে পাইন গাছের জঙ্গল,রাস্তার গার্ড রেল এর উপর বসে থাকা হনুমান আর বাঁদর এর দল,,একমনে খেলায় ব্যস্ত,একই রকম ভাবে কানে তালা লাগা উচ্চতা জনিত কারণে।যত উচ্চতা বাড়ছিল তত ঠান্ড বাড়তে লাগলো,আরো ঘন হয়ে এলো পাইন গাছের জঙ্গল।দৃশ্য এতই মনোরম ,যে মনে হচ্ছে পাহাড়ের প্রতি বাঁকে দাঁড়িয়ে ছবি তুলি।কিন্তু এত সময় নেই আমাদের হাতে।অবশেষে বিকাল ৪.০০ টে নাগাদ পৌঁছলাম হোটেলে।দারুন সুন্দর এই হোটেল সানরাইজ।পাইন আর নাশপাতি বাগানের মাঝে হোটেল টা এবং এর আরো দুটি সুবিধা আছে।এক বাইক বা চার চাকা রাখার জন্য বিরাট পার্কিং আর দ্বিতীয় টা হলো এটা একদম সানরাইজ পয়েন্ট এর সামনে অবস্থিত। পায়ে হেঁটে সূর্যোদয় দেখেতে যাওয়া যায়।হোটেলে চেক ইন করে একটু রিফ্রেশ হয়ে সবাই বেরিয়ে পড়লাম লোকাল সাইট সিন দেখতে।প্রথম গেলাম নেতার হাট স্কুল দেখতে। খুব ঐতিহাসিক এবং বিখ্যাত এই স্কুল।ঠাণ্ডা পাইন এর জঙ্গলে ঘেরা ব্রিটিশ দের তৈরি করা স্কুল।দারুন এর পরিবেশ, পাহাড় এর মধ্যে উপত্যকার মতো এর খেলার মাঠ,ইচ্ছা হচ্ছিল ব্যাট বল নিয়ে আবার ছোটবেলার মতো একবার খেলি।ওখান থেকে গেলাম চরলোট হাউস এ।তখন সন্ধ্যা নেমে আসছে পাহাড় জুড়ে।পাইন আর নাশপাতির জঙ্গল হাল্কা কুয়াশার চাদরে মুড়ে নিচ্ছে নিজেকে।পাখির দল বাসায় ফিরছে দল বেঁধে।আমরাও বেশ ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত।এখানে দার্জিলিং এর মতো ম্যাল নেই,কিন্ত ম্যাল এর মতো সন্ধ্যায় একটা ছোট বাজার বসে।সেখানে বেশ কিছু ফার্স্ট ফুড এর দোকান ,এবং টুকিটাকি কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায়।সমস্ত হোটেল এর টুরিস্ট রা সন্ধ্যায় এখানে খাওয়া দাওয়া করতে,আর আড্ডা দিতে এখানে আসে।আমরাও একটা দোকান দেখে খেতে বসলাম। ম্যাগি আর ডিম ভাজা। হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা আর ধোঁয়া ওঠা ম্যাগি,দারুন লাগলো খেতে সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা।তারপর বাজার থেকে গোটা একটা মুরুগী কিনে সেটা ছাড়িয়ে দোকান থেকে কশে নিয়ে গেলাম হোটেলে সঙ্গে নিলাম রুটি আর স্যালাড।সারাদিন পর ভরপেট খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি শুতে চলে গেলাম সবাই।কারণ কাল আরো একটা লম্বা রাইড এ বেরোতে হবে আমাদের কে।সবাই ভোর ৪.০০ টে নাগাদ ঘুম থেকে উঠে গেলাম।ফ্রেশ হয়ে বাইক গুলো স্টার্ট দিয়ে গরম করে নেওয়া হলো।তারপর ব্রাশ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম সানরাইজ পয়েন্ট এ।সূর্য তখনও ওঠে নি, চারিদিক অন্ধকার,দারুন ঠান্ডায় জাকেট থেকে হাত বের করা দায়।আমরা গুটি গুটি পায়ে পৌঁছলাম সানরাইজ পয়েন্ট এ।দেখলাম কিছু লোক জমা হয়েছে আগেই,আর কিছু লোক আসছে।আমরা সবাই ব্যালকনি মতো পাহাড় এর খাঁজে দাঁড়িয়ে পড়লাম।ধীরে ধীরে আকাশ রঙতে লাগলো ।দিগন্তে শুরু হলো বিচিত্র রঙের খেলা।অবশেষে পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে দেখা দিল রাঙা সূর্য।অপূর্ব সূর্যোদয় দেখে তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে বাইক রেডি করলাম।আমাদেরকে যেতে হবে বেতলা জাতীয় উদ্যান , পালামৌ, বেতলা পৌঁছতে হবে সকাল ১০.০০ টা নাগাদ রাস্তা ১৫০ কিলোমিটার, অগত্যা ভোরের ঠাণ্ডাতেই বেরোতে হলো হোটেল থেকে।কিছুটা জঙ্গল আর পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে একটা ছোট্ট আদিবাসীদের পাড়াতে দাঁড়িয়ে পড়লাম দোকানের সামনে।একটু চা খাওযায় নেশায়। ছাগলের দুধের চা,আর ঘুঁটের আঁচে পোড়া লিট্টি,কি অপূর্ব তার স্বাদ,সবাই খেলাম পেট ভোরে।তারপর শুরু হলো যাত্রা।কিন্তু একটা ছোট সমস্যা দেখা দিল।দূরত্ব হিসাব করে মোটামুটি আমাদের বাইক এ তেল ভরা থাকে।।।কিন্তু পাহাড়ে উঠানামা যে বেশি তেল খেয়েছে বাইক, সেই হিসাব আমাদের ছিল না।আর একটা জিনিস আমরা জানতাম না যে, নেতারা হাট থেকে বেতলা যাওয়ার যে প্রায় ১৫০ কিলোমিটারে রাস্তা সেই রাস্তায় কোনো পেট্রোল পাম্প নেই।কিছুটা গিয়ে টেনসন হতে লাগলো যদি কোনো ভাবে পেট্রোল কম পড়ে যায়!!।।কিন্তু সেই সমস্যার সমাধান হলো কিছুটা এগিয়ে,..দেখি এক আদিবাসী কিশোরী দোকানে পেট্রোল বিক্রি করছে।আমরা সবাই দাঁড়িয়ে পেট্রোল নিলাম।মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে জানলাম সে ক্লাস ফাইভ এ পড়ে।এবং একমুখ হাঁসি নিয়ে তার স্কুল টিও সে তর্জনী নির্দেশে দেখিয়ে দিল,মাটির এক চেলে ছোট্ট একটা কামরার স্কুল,তার দেওয়াল রংবাহারি ছবিতে ভর্তি।তারপর বাইক ছুটে চললো বেতলা ন্যাশানাল পার্ক এর উদ্দেশে।সত্যি বলতে কি এইযা বত কাল যত বাইক রাইড করেছি তার বেস্ট এক্সপেরিয়েন্স হলো এই ১০০ কিলোমিটার এর রাইড এ।দুই দিকে বিস্তৃত এবং ঘন সবুজ জঙ্গল তার মাঝখান দিয়ে উঁচু নিচু পাহাড়ি রাস্তা,এবং কিছু দূর অন্তর পাহাড়ি ঝর্না নেমে এসেছে রাস্তার উপর দিয়ে।সেই নিবিড় বনানী আর পাখির কলতান।জনমানব শূন্য সেই জঙ্গল। আমাদের মাত্র তিনটি বাইক এর ইঞ্জিন এর শব্দ প্রাণের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে যেন।বেতলা পৌঁছলাম সকাল ৯ টা নাগাদ।এরপর একটা জিপসি ভাড়া করে জঙ্গল সাফারি।সাফারি শেষ করে বেরোলাম ২ ঘণ্টা পর।বাঘের দেখা না মিললেও জঙ্গলের সৌন্দর্য আমদের কে মুগ্ধ করলো।সাফারি শেষ করে আমরা গেলাম কমল দীঘি দেখতে।গভীর জঙ্গলের মাঝে সরু ,উঁচু নিচু , আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে প্রায় ৯ কিলোমিটার বাইক চালিয়ে পৌঁছে গেলাম কমল দীঘি তে।গভীর জঙ্গল এর মাঝে এক সুদৃশ্য জলাশয় ,সঙ্গে বন্য প্রাণী দেখার একটা ওয়াচ টাওয়ার।বন্য প্রাণী রা ওই দীঘির জল খেতে আসে।বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ,কিছুটা রিফ্রেশ হয়ে সবাই বেরোলাম পুরোনো কেল্লা দেখার উদ্দেশ্যে,খুব বেশি রাস্তা নয় ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম পুরনো কেল্লায়।ভগ্নপ্রায় জীর্ণ অবস্থা,খুব সাবধানে পা ফেলে পৌঁছে গেলাম কেল্লার উপরে।কি অপূর্ব দৃশ্য চারিদিকের সবুজ পাহাড় ঘিরে রয়েছে, পাহাড়ের চূড়া গুলি একের পার এক মাথা উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সবচেয়ে আশ্চর্য লাগলো পাহাড় গুলোর উপর দিয়ে তৈরি করা সুউচ্চ প্রাচীর ,দেখে চীনের প্রাচীর এর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল,আর মনে করিয়ে দিচ্ছিল অতীত এর গৌরবো জ্জ্বল অধ্যায়ের কথা।প্রাচীর মাঝে মাঝে ভেঙে হেলে গেছে,ভয়ে পা সিড়সিড় করতে লাগলো সবার,বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলাম না ।অবশেষে সকাল ১২ টা নাগাদ বেতলা কে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম নেতার হাটের উদ্দেশ্যে।কারণ নেতার হাটের কিছু জায়গা তখনও আমাদের দেখা বাকি,রাস্তা ১৫০ কিলোমিটার, যতটা তাড়াতাড়ি পৌঁছব ততটা ভালো হবে।গভীর জঙ্গলের রাস্তা পেরিয়ে কোয়েল নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম সবাই।কারণ স্নান করতে হবে সবাই কে।নেতার হাট এর অপূর্ব নদী এই কোয়েল। শীতের সময় তাই পাহাড়ি নদীতে স্রোত নেই। খুব স্বচ্ছ আর পরিস্কার জল।সবাই স্নান সেরে ,পড়ে থাকা কিছু খাবারের সঠিক ব্যাবহার করে বেরিয়ে পড়লাম নেতার হাটের পাইন ফরেস্ট এবং কোয়েল ভিউ পয়েন্ট এর উদ্দশ্যে।ওখানে পৌঁছলাম প্রায় বিকাল ৪ টে নাগাদ।খুব সুন্দর আর ঘন পাইন এর জঙ্গল।সবচেয়ে অবাক করলো পাইন জঙ্গল এর অপূর্ব গন্ধ।মনে হবে যেনো পুরো জঙ্গল টায় কেউ সুগন্ধি ফ্লোর ক্লিনার ছড়িয়ে দিয়েছে।সবাই কিছু ফটো ক্লিক করে বেরিয়ে পড়লাম।কিন্তু পেটে প্রচন্ড খিদের জ্বালা,একে তো সারাদিন কোনো ভারী খাবার পেটে পড়ে নি,তার উপর ভোর থেকে বাইক চালানোর ধকল, পাহাড়ে ওঠার ধকল।পাইন এর জঙ্গলের পাশে একটা আদিবাসী কাকিমার দোকানে সবাই খাবো বলে ঠিক করলাম,খাবার বলতে ,ডিমের অমলেট ,ডিম সেদ্ধ,আর ম্যাগি,খুব তৃপ্তি ভরে খেলাম সবাই।সবচেয়ে ভালো লাগলো খাবার পরিবেশন করা দেখে,কারণ খাবার দেওয়া হয়েছে গাছের কাঁচা পাতায়।খাওয়া দাওয়া করতে বেশ কিছুক্ষণ সময় নস্ট হলো,সূর্য তখন প্রায় অস্তাচলের পথে।সবাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম সানসেট পয়েন্ট এর উদ্দেশ্য।রাস্তা বেশি নয় কিন্তু প্রচুর গাড়ির ভিড়,কোনমতে পৌঁছলাম মগ্নোলিয়া সানসেট পয়েন্ট এ।কি অপূর্ব রঙের খেলা চলেছে তখন সারা আকাশ জুড়ে।লাল,গেরুয়া,সোনালী,আর নীলাভ রঙে রাঙিয়ে আছে সারা আকাশ।তার ই আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়েছে প্রেমিক যুগলের মুখে।তারই সামনে তাদের প্রিয় ঘোড়ার মূর্তি।তার পিঠে চড়তে ব্যস্ত কচি কাঁচার দল।গোধূলির লাল আভায় আর প্রচন্ড ঠাণ্ডা হাওয়ায় মনটা যেনো উদাস হয়ে গেলো।মনে মনে বললাম "বেঁচে থাক তোমাদের ভালোবাসা আর প্রেমের গল্প ,আবার যদি কোনো দিন ফিরে আসি,এখানেই যেনো দেখতে পাই তোমাদের" বন্ধুদের হাঁক ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম ।একটা তেলে ভাজা দোকান খুঁজে পেয়েছে.... ওখানে গরম গরম পেয়াঁজি আর ফুলুরি অর্ডার করেছে সকলে।দারুন লাগলো খেতে,আর সঙ্গে যোগ হলো গরম গরম ঘন দুধের চা।ওখানেই চেয়ার এ বসে সবাই একসাথে আড্ডা চললো ,চললো খুনসুটি।অবশেষে সন্ধ্যা নামলো পাহাড়ের বুক জুড়ে।পাইনএর জঙ্গলে ফিরে আসতে লাগলো পাখির দল।মন আমদের ও একটু বিষণ্ণ কারণ আমদের কেও হোটেলে ফিরতে হবে আর ভোরে লাগেজ পত্র বেঁধে বেরোতে হবে বাড়ির উদ্দেশে।হোটেলে পৌঁছে রিফ্রেশ হয়ে খাবারের অর্ডার দিলাম।যেহেতু কাল আবার ৬৫০ কিলোমিটারে রাইড তাই আজ নিরামিষ খাবার ঠিক হলো।মিক্স ভেজ,এর ফুলকফির তারকারি সঙ্গে রুটি আর স্যালাড।সবাই ভোর ৩.০০ টে অ্যালার্ম সেট করে শুয়ে পড়লাম সন্ধ্যা ৯ টা নাগাদ।ভোরে সবাই রিফ্রেশ হয়ে বাইক রেডী করে ভোর ৪ টে তে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির উদ্দেশ্যে।পাহাড় এর পাইন বানের তখনও ঘুম ভাঙ্গেনি ,মনে মনে বিদায় জানলাম তাদের ,ঠাণ্ডা ও বেশ। খুব সাবধানে বাইক নিয়ে নিচে নামতে থাকলাম পাহাড় থেকে,মাঝে মাঝে ঘন কুয়াশার আস্তরণ।ভোর ৫.৩০ টা নাগাদ আমরা পাহাড় থেকে নামা শেষ করলাম,আবার কিছু টা মালভূমির মতো চড়াই উতরাই রাস্তা,এখানে আর ভয় নেই।একটা মন্দিরের সামনে দোকান দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম চা খাবার উদ্দেশ্যে ।দেখি এক বয়স্ক দাদু কম্পিত হস্তে চা তৈরি করছে।সবাই দু কাপ করে চা খেলাম আর খেলাম দাদুর হতে বানানো গরম গরম লাড্ডু,যায় স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।এর পর রাঁচির উদ্দেশ্যে যাত্রা।রাঁচি পৌঁছলাম সকাল ৯ টা নাগাদ । মাহিন্দ্র সিং ধোনির বাড়ি খুঁজতে আমদের কিছু মাত্র কষ্ট হলো না,সবাই জানে মাহির বাড়ি "ভারা সিমালিয়া" প্রাসাদ সমান সেই বাড়ি,জোয়ান দের নিরাপত্তা বলয় দিয়ে ঘেরা,কিন্তু সবাই আমাদের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করলেন,কিন্তু এমএসডির দেখা পেলাম না।অগত্যা তার বাড়ির সামনে সবাই সেলফি আর গ্রুপ ফটো তুলে সবাই বেরিয়ে পড়লাম ।সামনে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে রুটি আর সবজি দিয়ে টিফিন করলাম সবাই।এবার টাটা নগর জামশেদপুর এর দিকে যাত্রা ।।টাটা নগর পৌঁছে তিনদিন পর প্রথম ভাত খেলাম সঙ্গে মাছের ঝোল। কিন্তু ভরপেট নয় কারণ, বাড়ি পর্য্যন্ত অনেক রাস্তা বাকি।বেহেরাগরা যখন পৌঁছলাম তখন বিকেল হয়ে গেছে।কিছুটা এগিয়ে একটা চা দোকানে দাঁড়ানো হলো।সবাই প্রয়োজনীয় ফোন সেরে নিল।সবাই বেশ শ্রান্ত। ক্লান্তিতে,কিন্তু বন্ধুদের খুনসুঁটি তখনও জারি...হাঁসির দমকে চা উছলে পড়ছে জামায়....অকারণে এ ওকে জড়িয়ে ধরছে... ভাগ করে মসলা মুড়ি খাচ্ছে সবাই....মনটা ভারী হয়ে গেলো ....আবার কবে বেরোব জানি না ।আবার ভালোও লাগলো...এই ভেবে যে এই অনলাইন এর দুনিয়ার আমদের অফ লাইন বন্ধুত্ব বেঁচে আছে,,,বেঁচে আছে তার আবেগ , উষ্ণতা,আর ভালোবাসা নিয়ে।এবার বাড়ি ফেরার পালা। একরাশ আনন্দ ,পাইন বনের সুবাস,পাহাড়ের হিমশীতল সুনিবিড় ছায়া,আকাশ ভরা বিচিত্র রঙের খেলা,আর বেতলার সুনিবিড় জঙ্গল,নেশা ধরানো রাস্তা, তখনও মনকে আবিষ্ট করে রয়েছে পুরো মাত্রায়।বাড়ি পৌঁছলাম সন্ধ্যা ৭.৩০ নাগাদ। এবার বিশ্রাম,আর মেয়ের পা বুকে নিয়ে শ্রান্তির ঘুম।
:- সমাপ্ত-: