22/12/2021
ঝাড়গ্রামের পরিবেশবান্ধব শাল পাতা
*********************************************
সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভারতে বিভিন্ন উদ্ভিদের পাতা থালা-বাটি, সেলাই করা ডাইনিং লিফ প্লেট, খাবারের মোড়ক এবং খাদ্য প্যাকেজিং উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর মধ্যে বাংলায় কলা পাতা ও শাল পাতা বিশেষভাবে প্রচলিত। আর আমার জেলা ঝাড়গ্রামে সবচেয়ে জনপ্রিয় শাল পাতা। শাল (Shorea robusta) হল ডিপ্টেরোকার্পেসিয়ে পরিবারের অন্তর্গত একটি দীর্ঘাকার, পর্ণমোচী প্রকৃতির মূল্যবান গাছ। সংস্কৃত শব্দ 'শাল' (অর্থাৎ ঘর) থেকে এই গাছের নামকরণ হয়েছে। এই গাছ আবার 'শাখুয়া', 'শরাই' প্রভৃতি নামেও পরিচিত। শাল গাছ হিন্দু, জৈন এবং বৌদ্ধদের জন্য অপরিসীম ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করে। ভারতীয় উপমহাদেশের একটি স্থানিক উদ্ভিদ প্রজাতি হল শাল এবং ঝাড়গ্রাম জেলায় ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়। জঙ্গলমহল অঞ্চলে শাল প্রধান বৃক্ষ, যার ধর্মীয় গুরুত্বও রয়েছে। শাল গাছ হল সত্যের প্রতীক। শাল গাছের নিচে মারাং বুরু, জাহের ইরা, তান্ডবারো, পিলচু হারাম, পিলচু বুড়ি, সিং বোঙ্গা সহ আদিবাসী জনজাতির ঠাকুর-দেবতার অধিষ্ঠান। প্রাচীন বিশ্বাস অনুসারে, সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য শাল গাছের নিচে শাল ফুল ও শাল পাতা দিয়ে পূজা করা হয়।
ঝাড়গ্রাম জেলা পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন গন্তব্যগুলির মধ্যে একটি এবং ঝাড়গ্রামের শাল জঙ্গল খুব জনপ্রিয়। আমরা যদি ঝাড়গ্রাম জেলার উপগ্রহ চিত্রটি দেখি, তবে দেখতে পাবো অধিকাংশ এলাকাই শাল-প্রধান অরণ্যাঞ্চল। তাই এই জেলার আরেক নাম 'অরণ্য সুন্দরী'। ঝাড়গ্রাম জেলার শাল বনাঞ্চল সংলগ্ন বসবাসকারী ভূমিহীন, প্রান্তিক এবং বন-নির্ভর উপজাতিদের জন্য সারা বছর বন থেকে শাল পাতা সংগ্রহ করা একটি রাজস্ব-উৎপাদনমূলক কার্যক্রম। তবে শুধুমাত্র ঝাড়গ্রাম নয়, জঙ্গলমহলের অন্যান্য জেলাগুলিতেও অরণ্যসংকুল গ্রামীণ জনগণের আয়ের উৎস হল শাল পাতা। ঝাড়গ্রাম জেলার প্রায় ৭০ শতাংশ শাল জঙ্গলের অন্তর্গত। অধিকাংশ প্রান্তিক মানুষ অল্প-স্বল্প চাষাবাদের সঙ্গে শাল পাতার প্লেট তৈরি করে বাড়তি আয়ের প্রচেষ্টা করেন। আর যাদের চাষ করার জন্য জমি নেই, তাদের জন্য একমাত্র ভরসা এই শাল গাছ। একটি শাল পাতার দৈর্ঘ্য ১০-২০ সেমি এবং ১০-১৫ সেমি চওড়া। শাল পাতা আকারে আয়তাকার, গোড়ায় ডিম্বাকৃতি এবং শীর্ষে সরু। পর্ণমোচী শাল গাছের পাতা ফেব্রুয়ারি-মার্চে ঝরে যায়। বেনে ঘাসের কাঠি দিয়ে শাল পাতা সেলাই করে প্লেট তৈরি করা হয়।
ঝাড়গ্রাম জেলার মোট জনসংখ্যা ১১.৩৬ লক্ষ (২০১১ জনগণনা অনুসারে)। শুধুমাত্র ঝাড়গ্রাম জেলাতে সাড়ে ৬ লক্ষ এবং সারা রাজ্যে প্রায় ৩২ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে শাল পাতার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ঝাড়গ্রাম জেলায় প্রায় ৮ হাজার স্ব-সহায়ক দল রয়েছে যাঁরা শাল পাতা নিয়ে থালা-বাটি তৈরির কাজ করেন। ২০১৯ সালে মার্চ মাসে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার কর্তৃক প্রায় ৮০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ঝাড়গ্রামের বাঁদরভুলা মৌজায় ২১ হাজার ৭৫০ বর্গফুট এলাকা জুড়ে নির্মিত তিনতলা শাল ও সাবাই প্রশিক্ষণ ও উৎকর্ষ কেন্দ্র প্রদর্শনশালার উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানে শাল পাতার গবেষণা থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ, জিনিস তৈরি এবং বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। ঝাড়গ্রামের তৈরি শাল পাতা আন্তর্জাতিক বাজারজাত করার জন্য অনলাইন ট্রেডিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ট্রেডমার্ক, লোগো, বারকোডিং সকল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বনজ সম্পদ শাল পাতা থেকে উৎপাদিত সামগ্রী বিপণনের জন্য 'শাল্বী'র ট্রেডমার্কের উদ্বোধন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি হাজার শাল পাতার থালার ৭০০ টাকা দামও নির্ধারণ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ খাদি দপ্তর খড়্গপুর আইআইটির প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে শাল পাতার হস্তশিল্প সামগ্রী এবং বুফেতে খাওয়ার জন্য শাল পাতার থালাকে শক্তপোক্ত করার চেষ্টা করছে। ভারতের বড়ো বড়ো শহরগুলিতে এবং বিদেশের বাজারে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব শাল পাতাকে তুলে ধরা হচ্ছে।
ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানে শাল পাতার প্লেটে খাবার পরিবেশন করার প্রচলন রয়েছে। অন্নপ্রাশন-উপনয়ন-বিবাহ এবং শ্রাদ্ধানুষ্ঠানেও শাল পাতার প্লেটে খাবার পরিবেশনের প্রথা একটি বিশুদ্ধ ও উত্তম প্রথা হিসেবে বিবেচিত হয়। প্লাস্টিক আমাদের জীবন দখল করার আগে গ্রামীণ অঞ্চলে শাল পাতা ব্যাপকভাবে খাবার, কাঁচা মাংস এবং মুদির দোকানে মোড়কের কাজে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হত। আজও ঝাড়গ্রাম জেলার কিছু গ্রামে এই প্রথা প্রচলিত রয়েছে। শাল গাছ ও শাল পাতাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য মানুষের জীবিকা। ঝাড়গ্রাম জেলার বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে শাল পাতা মা-বোনদের অন্যতম জীবিকা হয়ে উঠেছে। যদিও এটি প্রাচীন অখণ্ড ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় সূত্রে বাঁধা। দৈনন্দিন জীবনে শাল পাতার ব্যবহারিক গুণাগুণ পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা একে জীবিকা বানিয়েছেন। মূলত অরণ্যকেন্দ্রিক গ্রামগুলিতে মহিলারা সহজেই পাতা সংগ্রহ করতে পারেন। তাছাড়া বনবিভাগ কর্তৃক গাছকাটা নিষেধ হলেও পাতা সংগ্রহে কোনো আপত্তি নেই। সাধারণত ছোটো শাল গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করা হয়। তবে অনেকসময়, বড়ো গাছ থেকে আঁকশি ব্যবহার করে পাতা সংগ্রহ করা হয়। কাঁচা শাল পাতা সংগ্রহ থেকে শুরু করে পাতা তৈরির যাবতীয় কাজ মহিলারাই করে থাকেন। এতে সাধারণত পুরুষদের তেমন ভূমিকা নেই। প্রায় সব বয়সের কাজের মেয়েরাই এই জীবিকার সাথে যুক্ত। তবে অবিবাহিত মেয়েরা এবং নববধূরা পাতা আনতে জঙ্গলে যায় না। সাধারণত ৩৫-৫৫ বয়সী মহিলারাই জঙ্গল থেকে শাল পাতা তোলান কাজ করে থাকেন। পাতা বাড়িতে আনার পর দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে অবসর সময়ে বাড়ির সব মেয়েরাই একসাথে বসে পাতা সেলাই করে থাকেন। শাল পাতা তৈরির জন্য কাঁচা শাল পাতা এবং সূক্ষ্ম শক্ত কাঠির প্রয়োজন হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাতা সেলাই বেনে কাঠি ব্যবহার করা হয়।
কাঁচা শাল পাতার গুণমানের ওপর প্লেটের গুণমান নির্ভর করে। পুরু, মাঝারি শক্ত, পরিষ্কার ও চকচকে ভাবযুক্ত কাঁচা শাল পাতা প্লেট তৈরির জন্য উপযুক্ত। কচি পাতা ব্যবহার করলে সেলাইয়ের সময় প্লেটটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। একদিনে একটি পরিবার গড়ে ১০০-৩০০ পাতা সেলাই করে থাকে। সেলাই করা পাতা হালকা রোদে কয়েকদিন ধরে শুকনো করা হয়। এরপর আধুনিক ডাইস মেশিন দ্বারা শাল পাতার প্লেট তৈরি করা হয়। শাল পাতার থালা-বাটি মহাজনের নিকট বা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয়। পাতার চাহিদা এবং জঙ্গলে কাঁচা পাতার জোগানের ওপর শাল পাতার তৈরি প্লেটের মূল্য ওঠানামা করে। ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজনের মতো শপিং সাইটগুলিতে অনেক বেশি দামে শাল পাতার থালা-বাটি বিক্রি হয়। সে তুলনায় প্রান্তিক এই মানুষজন খুব বেশি দাম পান না। অরণ্য নির্ভর এই কুটির শিল্পকে আরও উন্নত ও লাভজনক করা দরকার। শাল পাতার থালা-বাটি পরিবেশ বান্ধব, যা প্লাস্টিক বা থার্মোকলের থালা-বাটির মতো পরিবেশ দূষণ করে না। বরং শাল পাতা ব্যবহার অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর। এই কুটির শিল্প বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক মানুষের উপার্জনের উৎস। আমরা প্লাস্টিক/থার্মোকলের পরিবর্তে এই শাল পাতা অধিক হারে ব্যবহার করলে, পরিবেশ দূষণ হ্রাসের পাশাপাশি প্রান্তিক অরণ্যকেন্দ্রিক মানুষদের জীবিকা উন্নততর হবে। আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে শাল পাতা আধুনিক জীবনেও উপযোগী ও ব্যবহার্য। আশা রাখি, আগামী দিনে ঝাড়গ্রামের পরিবেশবান্ধব শাল পাতা দেশবিদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
**********************************************
লেখিকাঃ- সোনালী দন্ডপাট (মানিকপাড়া, ঝাড়গ্রাম)
[লেখিকা ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল স্নাতকোত্তর বিভাগের ছাত্রী]
তথ্যসূত্রঃ- এই সময় ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; Wikipedia ; Official Website of Jhargram District / West Bengal ; স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে লেখিকা কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য