16/04/2024
**** একটি গ্রাম্য রূপককথা ***
এ গল্পের প্রধান চরিত্র দুটি । তাদের আগে পরিচয় দিই, -
মকরন্দবাবু এককালে ছিলেন জমিদার । হাতে মাথা কাটতেন । কিন্তু সে দিন গেছে । এখন তালপুকুরে ঘটি ডোবে না । জমিদার বাড়ির পলেস্তারা খসে পড়েছে , সারাবার সামর্থ্য নেই । জমিজমা গেছে বিক্রমপুরে । ঘরে হাঁড়ি চড়ে না । এককালে গাড়িবারন্দায় দাঁড়িয়ে থাকত ফোর্ড গাড়ী । এখন সেটা লজঝড়ে । স্টার্ট নেয় না । বলদ জুড়ে সেটিকেই টানান বাবুমশাই । আমরা ওটাকে বলি অক্সফোর্ড । বাবুর সে মান আর নেই । আমরা মকরন্দের নামের প্রথম দু অক্ষর নিয়ে আড়ালে ওকে মাকুদা বলে ডাকি ।
গল্পের দ্বিতীয় চরিত্রটি আমাদের খেন্তিপিসির । আগে হাটে গেঁড়ি-গুগলি বেচত , কঠোর পরিশ্রমে হয়ে উঠেছিল মাছের আড়তদার ।
একজনের পতন , আরেকজনের উত্থান । - জগতের নিয়ম । স্বাভাবিক ভাবেই এদের বনিবনা থাকার কথা নয় । অন্ততঃ আমরা তাই জানি । তবে দুর্জনে বলে , খেন্তিপিসি মাঝেসাঝে মাকুদাকে ঘরে ডেকে মাছভাজা খাওয়ায় ! কেন , কে জানে !
তবে কিনা , চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায় । আড়তদার হওয়ার পরেই খেন্তির মতিচ্ছন্ন হয়েছিল । বাজারে অন্য কাউকে মাছ বেচতে দিতে চাইল না , পচা মাছ বেচতে শুরু করল মর্জিমত দামে , ওজনে ফাঁকি , দামে চুরি । প্রতিবাদ আটকাতে গুন্ডা লেঠেল পুষল । আড়তদার জমিদার হতে চাইল । আমাদের বাধ্য হয়ে বেশি দামে পচা মাছ খেতে হচ্ছিল । আমরা কিন্তু তলে তলে জোট বাঁধছিলাম ।
এ গল্প এমন সময়কার এক দিনের । ঠিকঠাক বলতে গেলে একদিন নয় , দেড়দিনের ।
সেদিন হল কি , মাকুদার সখ হল , - ফের গাড়ী চড়বে । সেই অক্সফোর্ড । গাড়ী তো কিছুতেই স্টার্ট নেয় না । …. খেন্তি তার পচা মাছের ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছিল হাটে । মাকুদা ইশারায় ডাকল তাকে । - একটু ঠেলে দে না ! খেন্তি এদিক ওদিক দেখল । কেউ নেই আশেপাশে । ( আমি ছিলাম গাছের আড়ালে । সেই রবিঠাকুরের আমল থেকে নিন্দুকেরা গাছের আড়ালেই থাকে । ) খেন্তি বলল , - কেন ঠেলব রে ড্যাকরা মিনসে ?
মাকুদা বলল, - ওরে বাবা , আমার গাড়ী স্টার্ট নিলে তুইও নাহয় হাটের পথে একটু এগিয়ে যাবি । বাকিটা পরে বোঝাব । এখন ঠেল তো !
পচা মাছের ঝুড়ি ওই অক্সফোর্ডের সীটে রেখে খেন্তিপিসি বেদম ঠেলল । গাড়ীটা কোনমতে চলল । হেঁচকি তুলতে তুলতে ওদের নিয়ে পৌঁছুল অধীর মিস্তিরির গ্যারেজে । সে আর এক অভাবী মানুষ । লোকের সাইকেল কেনার পয়সা নেই , গাড়ী সারাবে কে ? মাকুদা বলল , - মিস্তিরি , বাকী বকেয়া সব ভুলে যাও । আমার এই গাড়ীটা একটু জুত করে দিলে তোমাকে খুশী করে দেব । অধীর একটু ভাবল , তারপর হেল্পারকে হাঁক পাড়ল , - “হাতকাটা “ !
হাতকাটার আসল নাম মান্নান । কি এক বেয়াদপিতে জমিদার মকরন্দ-ই ওর ডান হাতের পাঞ্জা কেটে দিয়েছিল । তারও রাগ আছে মাকুর ওপর । কিন্তু এখন সেসব ভাবার সময় নয় । বন্যার তোড়ে ভেসে যাওয়া কাঠের গুঁড়ি আঁকড়ে সাপে- শিয়ালে সহাবস্থানে বেঁচে থাকে । ওরা লেগে পড়ল মেরামতির কাজে , যদি চলনসই করা যায় খাটারাটাকে !
মাকুদা একটা আধপোড়া বিড়ি ধরিয়ে খেন্তিকে একটা গাছের তলায় ডাকল , - শোন খেন্তি , বাজারে নতুন মাছওয়ালারা এসে গেছে । তোর ব্যাবসার হাল আমি জানি । ডুববি । গ্রামের লোকেরা ওদের দিকেই যাবে । ভেসে থাকতে হলে আমার গাড়ীটা চলনসই করতেই হবে । তাতে তোরও লাভ , আমারও লাভ ।
- কিরকম ?
- আরে , আমার লাভ প্রাসঙ্গিকতা । তোর মাথায় অত ঢুকবে না । কেউ আর এখন জমিদার বলে পোঁছে না । গ্রামের এমাথা ওমাথা গাড়ী হাঁকিয়ে সেটাই যেটুকু ফেরানো যায় ! আর তোর লাভ কি জানিস ? তোর আমার নকল ঝগড়ায় লোকের নজর তোর পচা মাছ , তোর চুরি , তোর গুন্ডার দলের থেকে যদি কিছুটা সরানো যায় , সেটাই তোর লাভ । ঢুকল কিছু মাথায় ?
খেন্তি মিশিমাখা দাঁত বের করে বলল , - বেড়ে বুদ্ধি করেছ দাঠাউর ! ওইজন্যিই তোমার পথেই ব্যাবসা করছি এতটা কাল !
মাকুদা বলল , - তবে শোন , এখানেই শেষ না । কাল ভোর থেকে সন্ধ্যে অবধি আমি বেদম খিস্তি করব তোকে , - আমার গাড়ীর সীটে পচা মাছের জল ফেলেছিস বলে । তুইও চেঁচিয়ে পাড়া মাত করবি । লোকে ভাববে আমরা খুব লড়ছি । এভাবেই আমার প্রাসঙ্গিকতা ফিরবে , আর তোকেও লোকে , সবাই না হোক , কেউ কেউ , ভাববে , - আহারে খেন্তিপিসি বড় লড়াকু !! চোর ইমেজের থেকে লড়াকু ইমেজে ফেরার তোর ওই একটাই রাস্তা ।
*************
🖋️ Gopal Som
Copy from Siddhartha Roy Chowdhury Dada.