25/01/2024
উত্তরবঙ্গের ডায়েরি
মহানন্দা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি
উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং অথবা কালিম্পং যেদিকেই যাই না কেন গাড়িটা যখন চলতে শুরু করে তখন মনে একটা ছোট্ট আশা থাকে যে হঠাৎ করে একটা সবুজ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়িটা ছুটবে। দুধারে শাল ,সেগুন, খয়েরের জঙ্গল ।আর তার একটু বাদে একটা বড় করে হোডিং বোর্ড আসবে তাতে লেখা থাকবে মহানন্দা wild life স্যাংচুয়ারি ।
সুকনার জঙ্গলটা পার হলেই এই জঙ্গল শুরু হয়ে যায়। আমি বার তিনেক নিয়ে গেছি। আর প্রতিবারই মোহিত হয়েছি মহানন্দা জঙ্গলের অপূর্ব সৌন্দর্যে ।কিন্তু খুব কম মানুষ মহানন্দা অভয়ারণ্যকে এখনো পর্যন্ত এক্সপ্লোর করেছে ।তাই উত্তরবঙ্গের ডায়েরিতে আজকে মহানন্দা অভয়ারণ্যের কথা একটু বলি।
হিমালয়ের পাদদেশে পূব দিকে তিস্তা এবং পশ্চিমে মহানন্দা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত মহানন্দার এই মিষ্টি অভয়ারণ্য। এটি পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের অনেকগুলো অভয়ারণ্যের মধ্যে অন্যতম। এর প্রধান বিশেষত্ব এটাই যে এটা প্রায় ১৬০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই অরণ্যের বিভিন্ন এলাকায় তার বিভিন্ন রকম উচ্চতার বৈচিত্র্য । বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে উচ্চতা দক্ষিনে সুকনার জঙ্গলের উচ্চতা ২০০ ফুট আবার উত্তরে লাটপাঞ্চার যেখানে খুব ভালো পাখিদের দেখা যায় সেটার উচ্চতা প্রায় ৪ হাজার ৫০০ ফুট ।
উচ্চতার তারতম্যের জন্য বন্যজীবনের এত বৈচিত্র মহানন্দার জঙ্গলকে এক অন্য উচ্চতায় বা এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। মহানন্দার জঙ্গল অভয়ারণ্য তকমা পায় 1958 সালে প্রধানত বাঘ ,হাতি এবং বাইসন তথা ইন্ডিয়ান গৌর সংরক্ষণের জন্য ।
মূলত ছোট ছোট বনভূমি দিয়ে তৈরি এর অভয়ারণ্য। কালিঝোরা লাটপাঞ্চার ,গুলমা ,তড়িবারি ,সেবক সুকনা ,সাতমাইল ,লাটলং এই ধরনের ছোট্ট ছোট্ট জঙ্গল দিয়ে এই বিশাল মহানন্দা জঙ্গল ।
প্রত্যেকটাই উত্তরবঙ্গের এক একটা সুন্দর সুন্দর পর্যটন হিসেবে স্বীকৃত ।
মহানন্দার জঙ্গলে অনেক আগে হাতি চালানোর বা এলিফ্যান্ট সাফারির ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এই অভয়ারণ্যের মধ্য দিয়ে জংলি হাতি যাতায়াত করত তাই জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুনকি হাতের সাথে জংলি হাতির লড়াইয়ে পর্যটকরা ভীষণভাবে নাজেহাল হত এছাড়াও এলিফ্যান্ট সাফারিতে অনেক রকম সমস্যা দেখা দেয়, বিশেষত যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাতিদের দিয়ে কাজ করানো হয় তারা সেভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মাহুত বা যারা চালায় তারা ঠিকমতো সেই হাতিদের সাথে ব্যবহার করে না ভীষণভাবে তাদের উপর অত্যাচার করে । একটা সত্যি কথা এটাই মানুষ তার নিজের বিনোদনের জন্য প্রকৃতির সন্তান বা অরন্যের নিরীহ প্রাণী গুলোকে অত্যাচার করবে এই জিনিসটা বা এই ধারনাটা অতি ভয়ানক তাই জন্য ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট এবং অরণ্য বিভাগের এই জঘন্য প্রথাটি খুব দ্রুত উঠিয়ে দেওয়া উচিত। মানুষের বিনোদনের জন্য অরণ্যের নিরীহ প্রাণীদের অত্যাচার করা বা এবং শারীরিকভাবে নিগ্রহ করা কোনটাই কাম্য নয় এই ব্যাপারে অরণ্য বিভাগ কঠিন সিদ্ধান্তে উপনীত হোক সেটাই কাম্য ।
এই বিশাল অভয়ারণ্যের জৈব বৈচিত্র্য দেখলে বেশ অবাক হতে হয় এই অভয়ারণ্যে প্রায় ৩৪০ প্রজাতির উদ্ভিদ লক্ষ্য করা গেছে যার মধ্যে খয়ের ,শিশু, লালি, শিমুল ,জারুল ,গামার ,সেগুন, সাল এবং প্রচুর পরিমাণে অর্কিডের দেখা পাওয়া যায়। প্রায় ৩৬ টি ভিন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এখানে পাওয়া যায় তার মধ্যে হিমালয়ান ব্লাক বিয়ার, লেপার্ড ,মাউন্টেন গোট, গোল্ডেন ক্যাট ,সম্বর ,চিতল হরিণ , বার্কিং ডিয়ার, ইন্ডিয়ান লেঙ্গুর, হিমালয়ান কাঠবিড়ালি ,পিপীলিকাভুক মেঘলা চিতা বা ক্লাউডেড লেপার্ড লক্ষ্য করা গেছে।
মহানন্দা জঙ্গলের লাটপাংচার বলে একটি অংশ আছে যেটি পক্ষী প্রেমীদের কাছে একটা স্বর্গ বলা যেতে পারে দেশ ও পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে আসে এবং পাখির ছবি তোলে বিলুপ্তপ্রায় অনেক পাখিদের দের এখানে লক্ষ্য করা যায় Babbler, Wagtail, Egret, Roller, Robin, Hornbill, Oriole, Himalayan monal blood pheasant নানান ধরনের পাখি দেখা যায়।
এই বিশাল জঙ্গলের মধ্যে যারা ঘুরতে যায় এবং বন্যপ্রাণীদের দেখতে যায় তাদের জন্য প্রায় পাঁচটি ওয়াচ টাওয়ার তৈরি হয়েছে।
লালটং ওয়াচ টাওয়ার -এটা তিস্তা নদীর লাল টং গ্রামে অবস্থিত এই ওয়াচ টাওয়ারটি তৈরি হয়েছিল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে মূলত বন্যপ্রাণী বিশেষ করে বুনো হাতির চলাচল এবং বুনো হাতি র করিডরের মধ্যে তে যাওয়ার নজর রাখতেই এই ওয়াচ টাওয়ার তৈরি হয়েছিল ।
মহানন্দা ওয়াচ টাওয়ার- এই ওয়াচ টাওয়ার টি মহানন্দা নদীর ধারে ঘন জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত। মহানন্দার জঙ্গলের একটা মূল সমস্যা হল চোরা শিকারি অর্থাৎ পোচার্স এরা অবৈধভাবে সাল সেগুন শিশু এই সমস্ত গাছ কেটে নিয়ে চলে যায় তাই এই সমস্ত চোরা শিকারিদের হাত থেকে বন্যপ্রাণী এবং এবং বিশাল বিশাল গাছদের বাঁচাতে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট এই ওয়াচ টাওয়ার তৈরি করেছিল ।
তড়িবারি ওয়াচ টাওয়ার -এটা গুল্মা নদীর ধারে অবস্থিত যারা পাখি ভালোবাসে তাদের জন্য আদর্শ ওয়াচ টাওয়ার। এখানে বসে খুব ভালো পাখি পর্যবেক্ষণ করা যায় ।
গুলমা ওয়াচ টাওয়ার- পরিত্যক্ত গুল্মা রেলস্টেশনে একটি পুরানো রেলের কেবিন কে ওয়াচ টাওয়ারে পরিণত করা হয়েছে ।এটিও গুলমা নদীর ধারে এখানে বসে খুব ভালো করে হরিণ সম্বর বাইসন লক্ষ্য করা যায়।
গোলাঘাট ওয়াচ টাওয়ার -মহানন্দা নদী থেকে অনেকটা দূরে সুকনা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে গোলাঘাটে অবস্থিত। এখান থেকেও খুব ভালো বন্যপ্রাণীদের দেখা যায় ভাগ্য ভালো থাকলে বাইসনের দলও দেখা যেতে পারে যখন নদীতে যখন জল খেতে আসে ।এছাড়াও জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মাসে অনেক পাখির দেখা মেলে এই ওয়াজ টাওয়ারে বসে।
তাহলে আর দেরী কেন ব্যাকপ্যাক করে নিন চলুন বেড়িয়ে পড়ি , এইবারের গন্তব্য মহানন্দা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি ।🥰🥰🥰🥰