14/06/2023
চাঁদের নিজের দেশে
মহাশ্বেতা দেবী
কেউ যায়নি। সে দেশ কেমন হবে, কারও জানা নেই। কিন্তু অমরেন্দ্র চক্রবর্তী এক জাদু-লেখক। 'আমাজনের জঙ্গলে' লিখে তিনি আমাদের মস্ত উপকার করেছেন। বইটি পড়ে জানলাম 'আমাজনই চাঁদের নিজের দেশ'। বইটি না পড়লে এর জাদু জানা যাবে না। মনে হচ্ছে, দীর্ঘকাল পরে বাংলা সাহিত্যের একটা মস্ত প্রয়োজন মেটাতে অমরেন্দ্র কলম ধরেছেন।
এ কথা সবাই জানেন, ছোটদের লেখার আগ্রহী পাঠক হচ্ছেন বড়রা, যাঁরা একটি ভালো ছোটদের লেখার জন্য পিপাসার্ত হয়ে থাকেন। তাঁদের মধ্যে আমিও আছি। ভালোলাগা বই/লেখা বার বার পড়া যায়। আমি আবার খুবই দুঃখে অনুভব করি, গল্প বলার দিন এখন থাকলে প্রত্যন্ত গ্রামে আর সামান্য কিছু লোকবৃত্তে থাকলেও থাকতে পারে। গল্প বলা আর গল্প শোনার দিন চলে গেছে। মুখে বা কলমে গল্প বলা। সে গল্প শুনে বড় হওয়া। তারপর গল্পের বই পড়া। ব্যাপারটাই চলে গেল। বাড়িতে দিদিমা-ঠাকুমা জাতীয় লোকজন হয় নেই, নয় তাঁরা গল্প বলেন না। আমি শৈশবে খুব নিবিষ্ট গল্প শুনিয়ে ছিলাম। একটু বড় হয়ে খুব ভালো গল্প বলিয়ে ছিলাম। নিজের প্রশংসা নিজেই করলাম, কেন না গল্প বলা বা লেখার ব্যাপারটি বাঙালি ভুলে যাচ্ছে।
অমরেন্দ্র জাদু-গল্পকার। আমি ওঁর ‘হীরু ডাকাত' ‘শাদা ঘোড়া' 'গৌর যাযাবর' 'আমাজনের জঙ্গলে ফিরে ফিরে পড়েছি। 'আমাজনের জঙ্গলে' পড়ে মনে হয়েছে, এমন নিষ্পাপ রোমান্টিকতা, শৈশবের এমন জাদুছবি, সেই সঙ্গে অরণ্য ও অরণ্যবাসী মানুষজনের এমন পরিচয়, এ যেন মনে পড়ায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অমরেন্দ্র কি বিভূতিভূষণের সমান মাপের লেখক? তিনি এই সময় ও যুগের এক অন্যরকম চারণিক। তিনি তাঁর নিজের মাপের লেখক।
কিন্তু নিষ্পাপ শিশুমনকে অরণ্য, নদী ও অরণ্যসন্তানদের কাছে নিয়ে যাওয়া যে খুব দরকার, তা বুঝেই তো তিনি 'আমাজনের জঙ্গলে' লেখেন। তার মধ্য দিয়ে আজকের দুনিয়ার নির্মম সত্যও জানিয়ে দেন। অরণ্যসন্তানরা বোতোর আশ্রয়ে থাকে। গাছপালা-ফলমূলের বিষয়ে সব জানে তারা। ভারতে একজনকেই জানি, আদিবাসীদের ঐতিহ্যলব্ধ জ্ঞান নিয়ে তাঁর ভীষণ চিন্তা। অমরেন্দ্র তাঁকে জানেন না। কিন্তু তিনিও তো আমাদের না-জানা এক চিরসত্যের কথাই লিখেছেন। উবারা আকাশ-মাটি-নদী-গাছপালা পশুপাখির পাঠশালায় যে জ্ঞান অর্জন করেছে, সে জ্ঞান তো হাতিয়ার। প্রকৃতিকে বিনষ্ট করে না ওরা। 'লোভ' বা ‘লালসা' ওদের শব্দকোষে নেই বলেই মনে করি।
আবার এই জগৎটি তো আমাদের হাতেই বিপন্ন। ওই জঙ্গল ও নদী থেকে গল্প কথকের কাকা রত্ন আহরণ করেন। হেলিকপ্টার আকাশ থেকে অরণ্য জরিপ করে। ওই জঙ্গল ওরা কেটে ফেলবে। গল্পের কথক বালককে ওরা নিয়ে যায় জোর করে। কেন না কোনও সভ্য মানুষ কি জংলীদের সঙ্গে থাকতে পারে?
এ তো নিদারুণ সত্য। যার কথা আমি লিখি। প্রত্যহ দেখতে পাই। আমাদের আদিবাসী জগৎ সম্পর্কে অন-আদিবাসীরা কিছুই জানেন না। কেন না, তাঁরা জানতে চাননি। না জেনেই পৃথিবীজুড়ে আদিবাসী সমাজ-কৃষ্টি, বিশ্বাস-জ্ঞানকে বিনষ্ট করা হয়েছে।
'আমাজনের জঙ্গলে' সে কথাও বলা হয়েছে। আমাজন উপত্যকায় জঙ্গল ও মানুষ ধ্বংসের কাজ বহুদিন আগেই শুরু হয়েছে। অমরেন্দ্র সেদিকে শিশুদের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছেন।
শিশুর মন হচ্ছে কুমারী মৃত্তিকা। অরণ্য-আরণ্য-নদী-প্রকৃতি বিষয়ে ভালোবাসা সৃজনের বীজ শিশুমনেই রোপণ করতে হয়। তা করতে হয় গল্প বলে। বড়ই সহজ সে পন্থা। কিন্তু সহজ কাজটা করার মানুষ নেই।
আমি তো চাইব, অমরেন্দ্রর বই ও বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য অধুনা অ-পঠিত ক্লাসিক, এগুলির ক্যাসেট প্রবর্তন করা শুরু হোক। শিশুরা শুনুক প্রবীণ-প্রবীণাদের গলায় ‘অনে-ক দিন আগে কী হয়েছিল, সে সব গল্প। গল্পবলিয়ে মানুষ তরুণ সমাজেও অনেক। ছোট্ট পথচলতি ঘটনাকেও তারা সরস বর্ণনাগুণে জমাট গল্প বানিয়ে দেন।
আর চাইব, গল্পের সঙ্গে সঙ্গে এত সত্য কথা যাতে আছে, সেই বইটি ভারতের নানা ভাষায় অনুবাদ হোক। সকল ভাষার শিশুরা পড়ুক। কোনও দিন কোথাও অন্য কোনও রাজ্যে কোনও ভিনভাষী শিশু আমাকে জিজ্ঞেস করুক, তুমি কি উবার গল্প পড়েছ?
সেদিন কাছে আসুক।
আজকাল, ২০ জুলাই, ২০০২